চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারী

চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারী

ভারতীয় রাজনীতির ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারী (Chakravarti Rajagopalachari)। তবে কেবলমাত্র একজন রাজনীতিবিদই ছিলেন না তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামের একজন অক্লান্ত কর্মীও ছিলেন তিনি, আবার একাধারে একজন নামকরা আইনজীবী এবং লেখকও ছিলেন চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারী। সকলে তাঁকে ভালবেসে ‘রাজাজী’ বলে সম্বোধন করতেন। ভারতবর্ষের সর্বশেষ রাষ্ট্রপাল এবং এই পদে অধিষ্ঠিত প্রথম বাঙালিও ছিলেন রাজাগোপালাচারী। গান্ধীজীর খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলেন তিনি। বিভিন্ন সময়ে ভারতের বিবিধ প্রশাসনিক পদের দায়িত্ব সামলেছেন তিনি দক্ষতা এবং নিষ্ঠার সঙ্গে। জীবনব্যাপী নানা কৃতিত্বের জন্য তাঁকে ‘ভারতরত্ন’ সম্মানে ভূষিত করা হয়।

১৮৭৮ সালের ১০ ডিসেম্বর মাদ্রাজের (বর্তমান তামিলনাড়ু) সালেম জেলার হোসুর তালুকের অন্তর্গত থোরাপল্লী গ্রামে আইয়াঙ্গার তামিল পরিবারে চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারীর জন্ম হয়। তাঁর বাবার নাম ভেঙ্কাটারিয়া আইয়াঙ্গার এবং মায়ের নাম সিঙ্গারাম্মা আইয়ার। ভেঙ্কাটারিয়া আইয়াঙ্গার থোরাপল্লী গ্রামের একজন মুন্সেফ ছিলেন। ছোটবেলা থেকেই খুব দুর্বল এবং অসুখে জর্জরিত রাজাগোপালাচারীকে নিয়ে বাবা-মায়ের চিন্তার শেষ ছিল না এবং তাঁদের আশঙ্কা ছিল এই ছেলে বেশিদিন বাঁচবে না। ১৮৯৭ সালে আলামেলু মঙ্গলাম্মাকে বিবাহ করেন রাজাগোপালাচারী। পাত্রীর বয়স তখন দশ বছর মাত্র। আলামেলু তেরো বছর বয়সে প্রথম সন্তান জন্ম দেন। এই দম্পতির মোট পাঁচ সন্তানের মধ্যে ছিল তিনজন পুত্র এবং দুই কন্যা। তিন পুত্রের নাম যথাক্রমে সি.আর নরসিমহাঁ, সি.আর কৃষ্ণস্বামী, সি.আর রামাস্বামী এবং দুই কন্যা হলেন লক্ষ্মী গান্ধী ও নামাগিরি আম্মাল। ১৯১৬ সালে রাজাগোপালাচারীর স্ত্রী মারা যান। 

একেবারে ছোটবেলায় প্রথমে থোরাপল্লী গ্রামের স্কুলে পড়াশোনার জন্য ভর্তি হন চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারী। পরবর্তীকালে পাঁচ বছর বয়সে পরিবারের সঙ্গে তিনি চলে আসেন হোসুর জেলায় এবং ভর্তি হন সেখানকার আর. ভি গভর্নমেন্ট বয়েজ হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলে। ১৮৯১ সালে তিনি ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় পাশ করেন এবং ১৮৯৪ সালে ব্যাঙ্গালোরের সেন্ট্রাল কলেজ থেকে কলা বিভাগে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন তিনি। পরবর্তীকালে মাদ্রাজের প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে আইন নিয়ে পড়াশোনা করে ১৮৯৭ সালে তিনি স্নাতক উত্তীর্ণ হন। 

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

জনগণের কাজে এবং রাজনীতিতে রাজাগোপালাচারীর আগ্রহ দেখা দিয়েছিল মূলত ১৯০০ সাল থেকে সালেমে আইনের অনুশীলন করবার সময়ে। ২৮ বছর বয়সে তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে যোগদান করেন। তখন থেকেই সরাসরি স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন রাজাজী। ১৯০৬ সালে কলকাতা সেশনের একজন প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দেন তিনি। স্বাধীনতা সংগ্রামী বাল গঙ্গাধর তিলক তাঁকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছিল সেই সময়। ১৯১১ সালে তিনি সালেম পৌরসভার সদস্য হন এবং পরবর্তীকালে ১৯১৭-তে সেই পৌরসভারই চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারী। সেবছরই তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামী পি. ভারাদারাজুলু নাইডুর পক্ষে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। এর দুবছর পর রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে সামিল হন তিনি। প্রখ্যাত স্বাধীনতা সংগ্রামী অ্যানি বেসান্ত এবং সি. বিজয়ারাঘবাচারিয়া তাঁর অকুন্ঠ প্রশংসা করেছিলেন।

১৯১৯ সালটি ‘রাজাজী’র জীবনের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই বছরেই মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ স্থাপন হয় রাজাগোপালাচারীর। এই সম্পর্কই আইনজীবীর পেশা ছেড়ে আসতে এবং সম্পূর্ণভাবে স্বাধীনতা সংগ্রামের কাজে যোগদান করতে উদ্বুদ্ধ করেছিল তাঁকে। এই সম্পর্ক এতই দৃঢ় ছিল যে গান্ধীজী রাজাগোপালাচারীকে বলতেন নিজের ‘বিবেকের রক্ষক’। রাওলাট বিরোধী আন্দোলন ছাড়াও তিনি গান্ধীজীর নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলন, ভাইকম সত্যাগ্রহ ইত্যাদি নানারকম সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ১৯২১ সালে চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারী কংগ্রেসের ওয়ার্কিং পার্টিতে নির্বাচিত হন এবং পার্টির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব লাভ করেন। গান্ধীজী যখন কারারুদ্ধ, তখন রাজাগোপালাচারী ‘নো চেঞ্জার্স’  দলের নেতৃত্ব দান করেছিলেন। ১৯২৩ সালে কংগ্রেস যখন বিভক্ত হয়ে যায়, তিনি তখন আইন অমান্য তদন্ত কমিটির (Civil Disobedience Enquiry Committee) একজন সদস্য ছিলেন। ১৯২৪-২৫ সালে অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে ভাইকম সত্যাগ্রহে অংশ নিয়েছিলেন তিনি। 

১৯৩০ সালের প্রথমদিকে চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারী তামিলনাড়ুর একজন অন্যতম প্রধান নেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। ১৯৩০ সালে গান্ধীজী যখন ডান্ডি মার্চ সংগঠিত করছিলেন, তখন নাগাপট্টিনামের নিকটবর্তী ভেদারান্যামে স্বাধীনতাকর্মী সর্দার ভেদারত্নমের সঙ্গে একযোগে লবণ আইন ভঙ্গ করেছিলেন তিনি। তাঁকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয় এবং ত্রিচিনোপল্লী কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ১৯৩৫ সালে তিনি তামিলনাড়ু কংগ্রেস কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন। ৫৯ বছর বয়সে মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের আসন জিতে মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির প্রথম প্রিমিয়ার হিসেবে পরিষদে প্রবেশ করেন তিনি। ১৯৩৯ সালে তিনি মন্দিরে প্রবেশের অনুমোদন এবং ক্ষতিপূরণ আইন (Temple Entry Authorization and Indemnity Act 1939) জারি করে দলিত এবং শানারদের হিন্দু মন্দিরে প্রবেশের নিষেধাজ্ঞা সরিয়ে দিয়েছিলেন। ১৯৩৮ সালের মার্চ মাসে কৃষকদের ওপর ঋণের বোঝা কমানোর জন্য কৃষি ঋণ ত্রাণ আইন (Agricultural Debt Relief Act) প্রবর্তন করেন। মাদ্রাজের মুখ্যমন্ত্রী (১৯৩৭-৩৯) হিসেবে সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজাগোপালাচারী হিন্দি শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করেছিলেন। মদ্যপানের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন তিনি, ফলে সরকারি তহবিলে বিপুল আর্থিক ক্ষতি হয় এবং প্রায় একশোটি সরকারি স্কুল অর্থসংকটের কারণে বন্ধ হয়ে যায়। ফলে বিপুল সমালোচনার শিকার হতে হয় তাঁকে। 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে রাজাগোপালাচারী ভারতের ভাইসরয়ের যুদ্ধ ঘোষণার বিরোধিতা করে সমস্ত সদস্যসহ মন্ত্রীসভা ত্যাগ করেন। ১৯৪০ সালে প্রতিরক্ষা বিধি অনুসারে তিনি গ্রেপ্তার হন এবং এক বছর কারাদণ্ড ভোগ করেন। তিনি ভারত ছাড়ো আন্দোলনের বিরোধিতা করে ব্রিটিশদের সঙ্গে আলোচনার পক্ষপাতী ছিলেন। এসময় তার শান্তিবাদী অবস্থান এবং ‘সি.আর ফর্মুলা’ জাতীয় কংগ্রেসে তাঁর সহকর্মীদের ক্ষুব্ধ করে তোলে। গান্ধীজী এবং জিন্নাহর মধ্যে আলোচনা শুরুর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি। ১৯৪৪ সালে ভারতীয় সাংবিধানিক জটিলতা সমাধানের প্রস্তাব করেন তিনি। ১৯৪৬ থেকে ১৯৪৭ সালের মধ্যে জওহরলাল নেহেরুর নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারে শিল্প, সরবরাহ, শিক্ষা এবং অর্থ বিভাগের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারী। 

১৯৪৭-৪৮ সালে রাজাজী পশ্চিমবঙ্গের গভর্নর নিযুক্ত হন। স্বাধীনতার পর ১৯৪৮ সালে লর্ড মাউন্টব্যাটেনের পরে ভারতের প্রথম ভারতীয় রাষ্ট্রপাল হিসেবে নিযুক্ত হন তিনি। ১৯৫০ সালে জওহরলাল নেহেরুর মন্ত্রীসভায় তাঁকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে মনোনীত করা হয় এবং সেখানে দশ মাস সেই দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫২ সালে পুনরায় মাদ্রাজের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হন তিনি৷ ১৯৫৩ সালে তিনি প্রাথমিক শিক্ষার সংশোধিত স্কিম (Modified Scheme of Elementary education, 1953) চালু করেন। ফলে প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে ক্লাসের সময় পাঁচ ঘন্টা থেকে কমে হয় তিন ঘন্টা। নেহেরু সরকারের সঙ্গে মতবিরোধের ফলে চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারী কংগ্রেস ত্যাগ করেন এবং ১৯৫৯ সালে গড়ে তোলেন কংগ্রেস বিরোধী ‘স্বতন্ত্র পার্টি’। ১৯৬৭ সালের সাধারণ নির্বাচনে ডিএমকে এবং ফরোয়ার্ড ব্লকের সঙ্গে জোট বেঁধে ৪৫টি আসন জিতে ‘স্বতন্ত্র পার্টি’ একক বৃহত্তম বিরোধী দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

কেবল রাজনীতি নয়, সাহিত্যেও তার অবদান অনস্বীকার্য। তিনি সালেম সাহিত্য সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা এবং সেখানকার নিয়মিত সদস্য ছিলেন। ১৯১৬ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তামিল সায়েন্টিফিক টার্মস সোসাইটি। ১৯২২ সালে তিনি ‘সিরাইয়িল তাভাম’ (Siraiyil Tavam) প্রকাশ করেন যেটি ঔপনিবেশিক শাসনে তাঁর কারাবাসের দৈনন্দিন যাপনের খুঁটিনাটি বর্ণনায় ভরপুর। ১৯৫১ সালে তিনি মহাভারতকে সংক্ষিপ্ত আকারে ইংরেজিতে লিখেছিলেন এবং ১৯৫৭ সালে একইভাবে লেখেন রামায়ণও। ১৯৬১-এর শুরুতে তিনি কম্বার লেখা তামিল রামায়ণ ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। ‘ভাগবত গীতা’ এবং ‘উপনিষদ’-এর ওপরও ইংরেজি ভাষাতে বই লিখেছিলেন চক্রবর্তী রাজাগোপালচারী। ১৯৫৮ সালে তামিল সাহিত্যে অবদানের জন্য মূলত রামায়ণের জন্য ‘সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার’ লাভ করেন তিনি। ১৯৫৯ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর লেখা ‘হিন্দুইজম: ডকট্রিন অ্যান্ড ওয়ে অফ লাইফ’ । এছাড়াও ভগবান ভেঙ্কটেশ্বরকে উদ্দেশ্য করে একটি ভক্তিমূলক গান ‘কুরাই ওনরুম ইল্লাই’ রচনা করেছিলেন রাজাগোপালাচারী।

১৯৫৪ সালে ভারত সরকার কর্তৃক প্রদত্ত ‘ভারতরত্ন’ পুরস্কারের প্রথম প্রাপক ছিলেন চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারী। 

১৯৭২ সালের ২৫ ডিসেম্বর ৯৪ বছর বয়সে চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারীর মৃত্যু হয়। 

2 comments

আপনার মতামত জানান