প্রতিবছর প্রতিমাসের নির্দিষ্ট কিছুদিনে বিভিন্ন দেশেই কিছু দিবস পালিত হয়ে থাকে। এই নির্দিষ্ট দিনে অতীতের কোনো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে স্মরণ করা বা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরি করতেই এই সমস্ত দিবস পালিত হয়ে থাকে। বিশ্বে পালনীয় সেই সমস্ত দিবসগুলির মধ্যে একটি আন্তর্জাতিক জাতিগত বর্ণ বৈষম্য বিলোপ দিবস (International Day for the Elimination of Racial Discrimination)।
প্রতি বছর ২১ মার্চ সারা বিশ্বে আন্তর্জাতিক জাতিগত বর্ণ বৈষম্য বিলোপ দিবস পালন করা হয়।
১৯৭৯ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ প্রথম ২১ মার্চ দিনটিকে আন্তর্জাতিক জাতিগত বর্ণবৈষম্য বিলোপ দিবস হিসাবে পালন করার আহ্বান জানিয়েছিল। এই দিনটি পালনের অন্তরালে রয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকার মানুষদের সাথে ঘটে যাওয়া এক করুণ ইতিহাসের গল্প।
বর্ণবৈষম্যের সূত্রপাত শুরু দক্ষিণ আফ্রিকায়। দক্ষিণ আফ্রিকার শার্পভিলে ১৯৬০ সালে “জাতিগত বর্ণবৈষম্যের বিল পাশের” বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ আফ্রিকার রাস্তায় এক শান্তিপূর্ণ মিছিলের আয়োজন করে। যেখানে পুলিশ বিনাকারণে তাদের উপর গুলি চালায়। যার ফলে ৬৯ জন নিরীহ মানুষ প্রাণ হারান ও ১৮০ জন মানুষ আহত হন। এই ঘটনার পরে ১৯৬৬ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ পৃথিবীর সমস্ত দেশগুলি থেকে জাতিভেদ ও বর্ণবৈষম্যের মত ভয়াবহ রোগকে নির্মূল করার প্রয়োজন বোধ করে এবং এই বিষয়ের উপর জাতিসংঘ নানা কর্মসুচি শুরু করে। অবশেষে ১৯৭৯ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ দ্বারা ২১ মার্চ দিনটি আন্তর্জাতিক জাতিগত বর্ণ বৈষম্য বিলোপ দিবস হিসাবে ঘোষিত হয়।
পৃথিবীর সমস্ত দেশের সাধারণ জনগণেরই কোনো বৈষম্য ছাড়া কতগুলি মৌলিক অধিকার ভোগ করার স্বাধীনতা রয়েছে। কিণ্তু সমাজের কিছু অদৃশ্য শক্তির দ্বারা সেগুলি কার্যকর হয় না এবং ভেদাভেদের সৃষ্টি হয়। বর্ণবাদের বিষয় সামনে এলে সবার প্রথমে উঠে আসে দক্ষিণ আফ্রিকার নাম যেখানে গায়ের রঙের পার্থক্যের কারণে মানুষকে নানা বৈষম্যের শিকার হতে হয়। কৃষ্ণাঙ্গ অর্থাৎ কালো চামড়ার মানুষেরা বেশী আক্রান্ত হয় শ্বেতাঙ্গ অর্থাৎ সাদা চামড়ার মানুষ দ্বারা। গায়ের রঙের কারণে এই বর্ণবাদের ঘটনা আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়ায় বেশি ঘটে থাকে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশগুলিতেও জাতিধর্ম নির্বিশেষে নানা ধরণের মানুষ বসবাস করে। সেখানেও ধর্ম, বর্ণ, পেশাকে কেন্দ্র করে নানা বৈষম্য দেখা যায়। ২০১৪ সালে বাংলাদেশের সরকার ‘বৈষম্য বিলোপ আইন ২০১৪’ অনুমোদন করেছে যার দ্বারা যেকোন ভেদাভেদকে কেন্দ্র করে সাধারণ মানুষ বৈষম্যের শিকার হলে এই আইনের মাধ্যমে অভিযোগ ও মামলা করতে পারবেন।
২০০১ সালে জাতিগত ভেদাভেদ ও বর্ণবাদ বিরোধী বিশ্বসম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। পরবর্তী ২০০৯ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার ডারবান শহরে আবার একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় যার লক্ষ্য ছিল বিশ্বব্যাপী জাতি – বর্ণের এই সমস্যাকে দূরীভূত করা এবং নতুনভাবে বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে এক আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতি নেওয়া।
পৃথিবীর সমস্ত দেশগুলিকে জাতিগত ও বর্ণবাদের মতো বৈষম্যের অভিশাপ থেকে মুক্ত করাই এই দিবসের মূল লক্ষ্য। প্রতিবছর একটি প্রতিপাদ্য বিষয়কে (Theme) কেন্দ্র করে এই দিবস উদযাপন করা হয়। ২০১৯ সালের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল ‘ক্রমবর্ধমান জাতীয়তাবাদী জনবহুলতা এবং চরম আধিপত্যবাদী মতাদর্শের প্রতিরোধ’। ২০২০ সালের প্রতিপাদ্য বিষয় ‘জাতিগত বৈষম্য মোকাবিলায় সহনশীলতা এবং ঐক্য ও বৈচিত্র্যের প্রতি শ্রদ্ধা বাড়ানো’। ২০২১ সালের প্রতিপাদ্য বিষয় হল ‘জাতিগত বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে যুব সম্প্রদায়’। ২০২২ সালের প্রতিপাদ্য বিষয় – ‘জাতিগত বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া’ (Voices for action against racism । ২০২৩ সালের প্রতিপাদ্য বিষয় – ‘জাতিগত বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের আশু প্রয়োজনীয়তা’ (The urgency of combating racism and racial discrimination. )।