মহাত্মা গান্ধী

মহাত্মা গান্ধী

মহাত্মা গান্ধী (Mahatma Gandhi) অহিংসা ও সততার দ্বারা ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনকে আসমুদ্র হিমাচল পর্যন্ত ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। কর্মসূত্রে তিনি আইনজীবি হলেও তাঁকে আমরা ঔপনিবেশ বিরোধী জাতীয়তাবাদী, রাজনৈতিক নীতি নির্ধারক এবং অহিংস সত্যাগ্রহ আন্দোলনকারী হিসেবেই চিনি। তিনি ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর নামকরণ করেন ‘মহাত্মা’, পরবর্তীকালে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু আজাদ হিন্দ বেতারে তাঁকে ‘জাতির জনক’ (Father of the Nation) বলে আখ্যায়িত করেন।

মহাত্মা গান্ধীর পুরো নাম মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী (Mohandas Karamchand Gandhi)। ১৮৬৯ সালের ২ অক্টোবর পোরবন্দরে (বর্তমানে ভারতস্থিত গুজরাট) তাঁর জন্ম হয়। মহাত্মা গান্ধীর বাবা করমচাঁদ গান্ধী ছিলেন পোরবন্দরের দেওয়ান। তাঁর মা পুতলিবাঈ (Putlibai) আধ্যাত্মিকতায় নিজেকে সমর্পণ করেছিলেন। মহাত্মা গান্ধী ছিলেন তাঁর পিতার চতুর্থ স্ত্রীর সর্ব কনিষ্ঠ সন্তান। ধর্মীয়ভাবে গান্ধীজির পরিবার উদার মনোভাব সম্পন্ন ছিল। তাঁর পিতা ছিলেন বৈশ্য বর্ণের বেনিয়া মোধ সম্প্রদায়ভুক্ত ও মা ছিলেন প্রণামী বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের। মহাত্মা গান্ধীর উপর মায়ের প্রভাব বেশি ছিল তাই পারিবারিক বৈষ্ণব ভক্তিতেই বড় হয়েছিলেন। তাঁর মা নিয়মিত উপবাস রাখতেন এবং কঠিন ব্রত পালন করতেন যার প্রভাবে মহাত্মা গান্ধী অহিংস, নিরামিষাশী হয়ে ওঠেন এবং আত্মশুদ্ধির উদ্দেশ্যে উপবাস করতে থাকেন।

শৈশবে তিনি প্রাথমিক শিক্ষার উদ্দেশ্যে বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেখানে ধুলোর উপর আঙুল দিয়ে বর্ণমালা লিখতেন শিশুরা। ইতিমধ্যে তাঁর বাবা রাজকোটের দেওয়ান নিযুক্ত হন। শৈশবে গান্ধী বিভিন্ন বৃত্তি এবং পুরষ্কার লাভ করলেও পড়াশোনায় তিনি ছিলেন মাঝারি মানের এক ছাত্র। ১৮৮৩ সালের মে মাসে তিনি ১৪ বছর বয়সী কস্তুরবাঈ মাখনজী কাপাডিয়া (Kasturbai Makhanji Kapadia) ওরফ কস্তুরবাকে বিবাহ করেন। যার জন্য তিনি ১ বছর বিদ্যালয়ে যেতে পারেননি । ১৮৮৭ সালে মোহনদাস ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় বম্বে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃতকার্য হন এবং ভাবনাগরে শ্যামলদাশ কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু তিনি সেখানে তাঁর উচ্চ শিক্ষা সমাপ্ত না করেই তাঁর পরিবারের কাছে পোরবন্দরে চলে আসেন। ১৮৮৮ সালের জুলাই মাসে তাঁর স্ত্রী কস্তুরবা তাঁদের প্রথম সন্তান হরিলালের জন্ম দেন। ইতিমধ্যে মাভজি দাভে যোশিজী (Mavji Dave Joshiji) নামে গান্ধী পরিবারের এক শুভানুধ্যায়ী এবং বন্ধু তাঁকে লন্ডনে আইন পড়ার পরামর্শ দেন। তবে গান্ধীজির মা গান্ধীর পরিবার এবং স্ত্রীকে রেখে বিলেতে পড়তে যাওয়ায় সম্মত ছিলেন না। তিনি তাঁর মাকে মদ, মাংস এবং স্ত্রীলোককে পরিহার করার কথা দেন । মহাত্মা গান্ধীর ভাই যিনি ইতোমধ্যেই আইনজীবী ছিলেন তিনি লন্ডনে গান্ধীর আইন পড়ার বিষয়ে উৎসাহিত ছিলেন। অবশেষে গান্ধীজী তাঁর মায়ের থেকে সম্মতি ও আশীর্বাদ লাভ করেন। গান্ধীজী ১৮৯১ সালের জুন মাসে ২২ বছর বয়সে আইনসভা থেকে ডাক পান এবং তিনি লন্ডন ত্যাগ করে ভারতের দিকে রওনা দেন। লন্ডনে আইন পড়াকালীনই তাঁর মা মারা যান যা তাঁর পরিবার তাঁর পড়াশোনার ক্ষতি হবে বলে লুকিয়ে রেখেছিল।

ভারতবর্ষে ফিরে মহাত্মা গান্ধী রাজকোট ও বম্বেতে আইনচর্চায় ব্যার্থ হওয়ার পর ১৮৯৩ সালে এক মুসলিম ব্যবসায়ী গান্ধীজির সঙ্গে যোগাযোগ করেন। সেই ব্যবসায়ীর নাম আব্দুল্লাহ। তাঁর বিশাল জাহাজের কারবার ছিল দক্ষিণ আফ্রিকায়। তাঁর দুঃসম্পর্কের আত্মীয়ের একজন আইনী পরামর্শদাতার প্রয়োজন ছিল । গান্ধীজি সেই প্রস্তাবে সম্মত হন এই জেনেই যে তাঁকে এক বছর ব্রিটিশ শাসক দ্বারা পরিচালিত নাতাল উপনিবেশে থাকতে হবে।

দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়ে তাঁকে বিভিন্ন সমস্যায় পড়তে হয় যেগুলি মূলত বর্ণবাদ এবং আভিজাত্যের জাত্যাভিমানজনিত সমস্যা। ১৮৯৩ সালের ৭ জুন প্রিটোরিয়া ভ্রমণকালে রেলগাড়িতে এক সাদা চামড়ার মানুষ গান্ধীজির প্রথম শ্রেণির কামরায় ভ্রমণ করার বিরুদ্ধে সরব হন ও তাঁকে নেমে যেতে বলেন। যদিও তাঁর বৈধ টিকিট ছিল। গান্ধীজি তা অস্বীকার করায় তাঁকে বলপূর্বক পরবর্তী স্টেশনে নামিয়ে দেওয়া হয়। তাঁকে বর্ণবাদের কারণে প্রচুর অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছিল। ডারবান বিচারালয়ে এক ইওরোপীয়ান বিচারক তাঁর পাগড়ি খুলে ফেলার হুকুম দেন। তিনি প্রত্যাখ্যান করেন এবং বিচারালয় ত্যাগ করেন। ১৮৯৯ সালে বোয়ার (Boer) যুদ্ধে তিনি ১১০০ স্বেচ্ছাসেবক নিযুক্ত করেন যাঁরা ব্রিটিশদের সাহায্য করে। এই যুদ্ধে ব্রিটিশদের জয় দক্ষিণ আফ্রিকায় থাকা ভারতীয়দের কিছুটা নিশ্চিন্ততা দেয়। ১৯০৬ সালে ট্রান্সভাল সরকার নির্দিষ্টভাবে ভারতীয় জনগণের জন্য হাস্যকার এক আদেশ জারী করে। ভারতীয়রা তার বিরুদ্ধে ১৯০৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে জোহানেসবার্গে এক বিশাল গণ প্রতিরোধ সভা আয়োজন করে। সেখান থেকেই জন্ম হয় সত্যাগ্রহ আন্দোলনের।

গান্ধীজি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ঠিক আগে ১৯১৪ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা ত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন। তিনি এবং তাঁর পরিবার লন্ডনে কিছুকাল কাটাবার পর অবশেষে ডিসেম্বরে ইংল্যান্ড ত্যাগ করেন। জানুয়ারীর প্রথমদিকে ১৯১৫ সালে বম্বে বন্দরে তাঁরা পৌঁছান। এরপর ভারতে বিভিন্ন আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে গান্ধীজি নেতা রূপে আত্মপ্রকাশ করেন। ১৯১৭ সালের চম্পারণ সত্যাগ্রহ আন্দোলন ভারতে আসার পর তাঁর প্রথম বড় আন্দোলন। তিনি অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটান। এই আন্দোলন মূলত ভারতে ঔপনিবেশিক শক্তি ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে। কেবলমাত্র বিদেশী পণ্য নয় এছাড়াও ব্রিটিশদের তৈরী সমস্ত কিছু বর্জনের ডাক দেন তিনি। দেশি বস্ত্রে সাবলম্বী হওয়ার জন্য তিনি চরকা কাটার প্রচলন করেন। গান্ধীজি প্রবর্তিত অহিংস সত্যাগ্রহ আন্দোলন বিদ্যুৎবেগে ছড়িয়ে পরে সমগ্র ভারতবর্ষে। ১৯২০ সালে তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের দায়িত্ব নেন এবং ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসকে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের মুখ করে তোলেন। ১৯৩০ সালের ২৬ জানুয়ারি কংগ্রেসের পক্ষ থেকে তিনি পূর্ণ স্বরাজের ডাক দেন। ১৯৩০ সালেই আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করেন ও প্রতীকী হিসেবে লবণ সত্যাগ্রহ বা ডান্ডি মার্চ করেন। এই মার্চের সময় তিনি ২৫ দিনে প্রায় ৩৮৮ কিলোমিটার পদযাত্রা করেন এবং বহু মানুষ তাঁর যাত্রা পথে অংশ নেয়।

১৯৪২ সালে তিনি ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ডাক দেন। গান্ধী হিন্দু মুসলমান ঐক্যের পক্ষে ছিলেন। তাই ১৯৪৭ এর দেশভাগের বিনিময়ে স্বাধীনতা তাঁকে হতাশ করেছিল। ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি প্রার্থনাসভায় যোগ দেওয়ার পথে উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদী নাথুরাম গোডসে গান্ধীজিকে গুলি করে হত্যা করেন।

মহাত্মা গান্ধীর প্রভাব শুধু ভারতে নয় গোটা বিশ্বেই পরিলক্ষিত হয়। বিভিন্ন দেশের নেতা তাঁর প্রচলিত নীতি অহিংস ও সত্যাগ্রহের পথ নিজের জীবনেও বেছে নিয়েছেন। তাঁর জন্মদিনেই সারা বিশ্ব জুড়ে পালিত হয় আন্তর্জাতিক অহিংসা দিবস। তিনি ১৯৩৭ থেকে ১৯৪৭ সালের মধ্যে ৫ বার নোবেল পুরষ্কারের জন্য মনোনীত হলেও নোবেল পুরষ্কার পাননি। ১৯৪৮ সালেও তিনি মনোনীত হয়েছিলেন কিন্তু চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগেই তাঁর মৃত্যু হয়, নোবেল কমিটি সেই বছর নোবেল শান্তি পুরষ্কার দেয়নি এবং কারণ হিসেবে উল্লেখ করে – ‘কোন যোগ্য জীবিত মানুষ ছিল না’ (there was no suitable living candidate), যা মনে করা হয় ময়াত্মা গান্ধীর উদ্দেশ্যেই বলা।

37 comments

আপনার মতামত জানান