শিশিরকুমার মিত্র

শিশিরকুমার মিত্র

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানের পাঠক্রমে প্রথম বেতার প্রযুক্তির ধারণাকে অন্তর্ভূক্ত করেছিলেন বিজ্ঞানী শিশিরকুমার মিত্র (Sisir Kumar Mitra)। ভারতে তিনিই প্রথম এই পাঠক্রম চালু করেন এবং তাঁর উদ্যোগেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বেতার-পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ চালু করা হয়। কলকাতার কাছে হরিণঘাটায় ১৯৫০ সালে তিনিই প্রথম আয়নোস্ফেরিক ফিল্ড স্টেশন তৈরি করেন। ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ‘ইসরো’র পাঠানো চাঁদের ছবিতে চাঁদের উত্তরাংশে একটি গহ্বরের নামকরণ করা হয়েছিল পদার্থবিজ্ঞানী শিশিরকুমার মিত্রের নামে। পরবর্তীকালে ২০১৯ সালের ২৬ আগস্ট চন্দ্রযান-২ আবারো ‘মিত্র’ নামের এই গহ্বরটির ছবি তুলে পাঠায়। বিখ্যাত বেতার-পদার্থবিদ শিশিরকুমার মিত্র ১৯৪৭ সালে তাঁর লেখা ‘দ্য আপার অ্যাটমোস্ফিয়ার’ গবেষণাপত্রের জন্য আজও স্মরণীয়। আন্তর্জাতিক স্তরে এই গবেষণাপত্রটি পরিচিতি পায় ক্রমশ এবং বহু ভাষায় অনুদিত হতে থাকে। ১৯৫৮ সালে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের উপরের দিকের অবস্থা বিষয়ে গবেষণার স্বীকৃতির জন্য লণ্ডনের রয়্যাল সোসাইটির সদস্য নির্বাচিত হন শিশিরকুমার মিত্র। ১৯৬২ সালে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে তিনি পদ্মভূষণ উপাধিতে ভূষিত হন।

১৮৯০ সালের ২৪ অক্টোবর অবিভক্ত বাংলার হুগলী জেলার কোন্নগরে শিশিরকুমার মিত্রের জন্ম হয়। তাঁর বাবার নাম জয়কৃষ্ণ মিত্র এবং মায়ের নাম শরৎকুমারী দেবী। জয়কৃষ্ণ এবং শরৎকুমারীর চতুর্থ সন্তান ছিলেন শিশিরকুমার। তাঁর পিতৃকুলের আত্মীয়রা সকলেই গোঁড়া হিন্দু ছিলেন, অন্যদিকে মাতৃকুলের সকলেই ছিলেন ব্রাহ্ম সমাজের সদস্য। শিশিরকুমারের বাবা জয়কৃষ্ণ মিত্র প্রথমে পেশায় স্কুলশিক্ষক ছিলেন, পরে ভাগলপুরে পৌরসভায় কেরানির কাজে যোগ দেন। অন্যদিকে তাঁর মা শরৎকুমারী পেশায় ছিলেন ডাক্তার। কলকাতার ক্যাম্পবেল মেডিকেল কলেজ থেকে পাশ করে ভাগলপুরের লেডি ডাফরিন হাসপাতালে যুক্ত ছিলেন তিনি।

ভাগলপুরে থাকাকালীন ভাগলপুর জেলা স্কুলে শিশিরিকুমার মিত্রের প্রাথমিক পড়াশোনা শুরু হয়। তাঁর বাড়িতে জগদীশচন্দ্র বসুর বহু বই ছিল। রামচন্দ্র ব্যানার্জি নামে এক ভদ্রলোক কলকাতার গড়ের মাঠে বেলুনে চড়ে বসিরহাটে গিয়ে নামেন। এই খবর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে আর এই খবরেই উৎসাহিত হয়ে বায়ুমণ্ডলীয় বিজ্ঞানের উপর আগ্রহী হয়ে ওঠেন শিশিরকুমার। ইতিমধ্যে বাবা মারা গেলে সাংসারিক দায়ভার একা হাতে তাঁর মা সামলাতে থাকেন। এন্ট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ভাগলপুরের টিএনজে কলেজে ভর্তি হন তিনি এবং এই কলেজ থেকেই এফ.এ পাশ করেন। তারপরে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন শিশিরকুমার মিত্র ১৯০৮ সালে। এখানে জগদীশচন্দ্র বসু, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় প্রমুখের সান্নিধ্যে আসেন তিনি। ১৯১২ সালে স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান অর্জন করেন তিনি। ঠিক এরপরেই জগদীশচন্দ্র বসু তাঁকে গবেষণার সহকারী হিসেবে কাজ করার প্রস্তাব দেন। কিন্তু সে সময় গবেষক হিসেবে কোনো বৃত্তি দেওয়া হতো না আর জগদীশচন্দ্র বসুও কয়েকদিনের মধ্যেই অবসর নেওয়ার কথা। ফলে আর্থিক নিশ্চয়তার কথা ভেবে ছাব্বিশ বছর বয়সে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অধ্যাপনার আহ্বান গ্রহণ করেন শিশিরকুমার। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপাচার্য তখন স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। এরপরেই সি.ভি রামনের তত্ত্বাবধানে আলোকবিজ্ঞানের উপর কাজ শুরু করেন তিনি।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিএসসি ডিগ্রি অর্জন করেন শিশিরকুমার ১৯১৯ সালে। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল – ‘ইন্টারফিয়ারেন্স অ্যাণ্ড ডিফ্র্যাকশান অফ লাইট’। ১৯২০ সালে প্যারিসের সারবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা ও গবেষণার সুযোগ আসে শিশিরকুমারের কাছে। এই প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে বিদেশ যাত্রা করেন তিনি এবং এই বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়ে অধ্যাপক চার্লস ফেব্রির তত্ত্বাবধানে তামার বর্ণালী নিয়ে কাজ করেন। এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই ১৯২০ সালে তিনি দ্বিতীয়বার ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। ইতিমধ্যে মাদাম কুরির সঙ্গে রেডিয়াম ইনস্টিটিউটে এবং পরে অধ্যাপক গুটেনের সঙ্গে প্যারিসের ন্যান্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করেন শিশিরকুমার। অধ্যাপইক গুটেনের সঙ্গে বেতার ভাল্বের গবেষণাকালীন সময়ে বেতার তরঙ্গ নিয়ে গভীরভাবে আগ্রহী হয়ে পড়েন তিনি। ধীরে ধীরে বেতার-পদার্থবিদ্যার ব্যাপারে দীর্ঘ গবেষণা করেন তিনি এবং কলকাতায় ফিরে আশুতোষ মুখোপাধ্যায়কে একটি চিঠিতে শিশিরকুমার জানান যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বেতার-পদার্থবিদ্যার পাঠক্রম চালু করা উচিত। আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের অনুমোদনে বিদেশ থেকে ফিরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে খয়রা অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন তিনি ১৯২৩ সালে। ফলে শিশিরকুমার মিত্রের হাত ধরেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তথা সমগ্র ভারতে প্রথম রেডিও-ফিজিক্স কিংবা বেতার-পদার্থবিদ্যা বিষয়ে পাঠক্রম এবং গবেষণা শুরু হল। তারপরে ভারতে বেতার-সম্প্রচারের ব্যাপারে উৎসাহিত হয়ে পড়েন তিনি। ইতিমধ্যে কলকাতায় সদ্যস্থাপিত ‘রেডিও ক্লাব অফ বেঙ্গল’-এর সদস্যপদ গ্রহণ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে একটি ট্রান্সমিটার বানিয়ে শিশির মিত্র নিজে থেকে সম্প্রচার শুরু করেন আর এই সম্প্রচারের নাম দেন তিনি ‘রেডিও টুসিজেড’ (Radio 2CZ)। ১৯২৭ সালের আগে পর্যন্ত শিশিরকুমার মিত্র এবং রেডিও ক্লাব এই দুটি জায়গা থেকেই বেতার সম্প্রচার হতো। বিদেশে এই সময় স্যার এপলটন বায়ুমণ্ডলের বিভিন্ন স্তর সম্পর্কে গবেষণা করছিলেন আর এতে উৎসাহিত হয়ে শিশিরকুমার মিত্র আয়নোস্ফিয়ার থেকে বেতার তরঙ্গ ফিরে আস্তে কত সময় লাগছে তা হিসেব করে এর একটি পরীক্ষা করেন যাতে সম্ভাব্য প্রতিফলক তলের অস্তিত্ব প্রমাণিত হবে। কলকাতায় তাঁর গবেষণাগারে রাখা ট্রান্সমিটার থেকে ৭৫ মাইল দূরে একটি গ্রাহকে বেতার তরঙ্গ পাঠিয়ে আয়নোস্ফিয়ারে একটি প্রতিফলক স্তর ধরা পড়ে। এপল্‌টন আবিষ্কৃত ডি-স্তর ছিল এই দৃষ্টান্তটি, এরপরে শিশিরকুমার নিজ চেষ্টায় ই-স্তর এবং সি-স্তরও আবিষ্কার করে ফেলেন। তাঁরই পরিকল্পনায় ভারতে প্রথম রেডিও রিসার্চ বোর্ড গঠিত হয় ১৯৪২ সালে। কলকাতার অনতিদূরে কল্যাণীর হরিণঘাটায় শিশিরকুমার স্থাপন করেন ভারতের প্রথম আয়নোস্ফেরিক ফিল্ড স্টেশন। বায়ুমণ্ডলের উপরে নাইট্রোজেন গ্যাসের উৎপত্তির কারণ ব্যাখ্যাপূর্বক একটি গবেষণাপত্র লিখেছিলেন শিশিরকুমার। পরীক্ষাগারে কাজ করার সময় প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি নিজেই তৈরি করে ফেলতেন তিনি। এর ফলে দেশীয় বৈজ্ঞানিক সরঞ্জাম তৈরির স্বপ্নও দেখতেন শিশিরকুমার।

বিজ্ঞান গবেষণার পাশাপাশি বিজ্ঞান সংগঠন গড়ার কাজে প্রথমে ১৯৩৪ সালে ইণ্ডিয়ান সায়েন্স কংগ্রেস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নির্বাচিত হন তিনি। তাঁরই উদ্যোগে কলকাতায় এই সংগঠনের সম্মেলন আয়োজিত হয়। ১৯৫৪ সালে এই সংগঠনের বরোদা সমাবেশে সভাপতিত্ব করেছিলেন তিনি। এর পাশাপশি চিকিৎসক মহেন্দ্রলাল সরকারের প্রতিষ্ঠিত ‘ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দি কাল্টিভেশন অফ সায়েন্স’-এর সম্পাদক, সভাপতি পদেও আসীন ছিলেন শিশিরকুমার মিত্র। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বেতার-পদার্থবিদ্যার পাঠক্রম যেমন চালু হয়েছিল, তেমনি ১৯৪৮ সালে তাঁরই উদ্যোগে পৃথকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি বেতার-পদার্থবিদ্যা বিভাগ চালু হয়। মেঘনাদ সাহা ও আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় প্রতিষ্ঠিত ‘ইণ্ডিয়ান সায়েন্স নিউজ অ্যাসোসিয়েশন’-এর সঙ্গেও বহুদিন যুক্ত ছিলেন শিশিরকুমার। ১৯৫১ সালে প্রথম এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্যপদ লাভ করেন তিনি।

বায়ুমণ্ডলীয় বিজ্ঞানচর্চার উপর তাঁর লেখা সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ এবং এই বিষয়ে একমাত্র নির্ভরযোগ্য বই ‘দি আপার অ্যাটমোস্ফিয়ার’। তাঁর আগে ভারতে কেউই এই বিষয়ের উপর এত গভীর গবেষণালব্ধ জ্ঞান প্রয়োগ করে বই লেখেননি। ১৯৩৫ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত এক দীর্ঘ সময় ধরে বই লেখা শেষ হয় তাঁর। কিন্তু বইটি প্রকাশ করার সময় কোনো প্রকাশক এগিয়ে আসেননি। অবশেষে তৎকালীন এশিয়াটিক সোসাইটির সভাপতি মেঘনাদ সাহার উদ্যোগে এশিয়াটিক সোসাইটি থেকেই প্রকাশিত হয় শিশিরকুমার মিত্রের প্রথম বই। ১৯৫৫ সালে রুশ ভাষায় অনুদিত হয় এই বইটি। রাশিয়ান কৃত্রিম উপগ্রহ স্পুটনিক-১ এর উৎক্ষেপণের আগে একমাত্র শিশিরকুমারের বইটিই রাশিয়ান মহাকাশবিদদের কাছে তথ্যভাণ্ডার ছিল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৫ সালে অবসর গ্রহণের পরে পশ্চিমবঙ্গের মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা পর্ষদের দায়ভার প্রাপ্ত হন শিশিরকুমার মিত্র। ১৯৬২ সাল পর্যন্ত এই পদে কর্মরত থাকাকালীন ১৯৫৭ সালেই উচ্চমাধ্যমিকের পাঠক্রমে বদল ঘটান তিনি।

জীবনে কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ বহু পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন শিশিরকুমার মিত্র। ১৯৩৫ সালে কিং জর্জ সিলভার জুবিলি মেডেল, ১৯৪৩ সালে জয়কৃষ্ণ মুখার্জি স্বর্ণপদক, ১৯৫৬-তে এশিয়াটিক সোসাইটির সায়েন্স কংগ্রেস পদক লাভ করেছেন শিশিরকুমার। লণ্ডনের বিখ্যাত রয়্যাল সোসাইটির সদস্যপদ লাভ করেছেন তিনি ১৯৫৮ সালে। ১৯৬২ সালে ভারতের রাষ্ট্রপতি তাঁর হাতে তুলে দেন রাষ্ট্রপতি পুরস্কার ও পদ্মভূষণ সম্মানে ভূষিত করা হয় শিশিরকুমার মিত্রকে। ঐ বছরই ভারতের জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হন তিনি।

ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ‘ইসরো’র পাঠানো চাঁদের ছবিতে চাঁদের উত্তরাংশে একটি গহ্বরের নামকরণ করা হয়েছিল পদার্থবিজ্ঞানী শিশিরকুমার মিত্রের নামে। পরবর্তীকালে ২০১৯ সালের ২৬ আগস্ট চন্দ্রযান-২ আবারো ‘মিত্র’ নামের এই গহ্বরটির ছবি তুলে পাঠায়।

১৯৬৩ সালের ১৩ আগস্ট শিশিরকুমার মিত্রের মৃত্যু হয়।

One comment

আপনার মতামত জানান