উনিশ শতকের বাংলার এক স্বনামধন্য চিকিৎসক মহেন্দ্রলাল সরকার (Mahendralal Sarkar)। আ্যলোপ্যাথি ও হোমিওপ্যাথি–চিকিৎসাবিজ্ঞানের এই দুই ধারাতেই ছিল তাঁর অগাধ পান্ডিত্য। ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্সের প্রতিষ্ঠাতা জ্ঞানপিপাসু এই মানুষটিকে বাংলা তথা ভারতবর্ষের ইতিহাস কেবলমাত্র একজন যশস্বী চিকিৎসক হিসেবেই নয়, নিরলস বিজ্ঞান সাধক ও সমাজসংস্কারক রূপেও চিরকাল স্মরণে রাখবে।
১৮৩৩ সালের ২ নভেম্বর হাওড়া জেলার পাইকপাড়া গ্রামে মহেন্দ্রলাল সরকারের জন্ম হয়। বাবা তারকনাথ সরকার যখন মারা যান, তাঁর বয়স তখন মাত্র পাঁচ। মা অঘোরমণি দেবীর সঙ্গে মহেন্দ্রলাল কলকাতার নেবুতলা অঞ্চলের শশীভূষণ দে স্ট্রীটে মামারবাড়ি চলে আসেন। তবে কিছুদিনের মধ্যেই আবার বিপর্যয় নেমে আসে। ন’বছর বয়সে তিনি মাতৃহীন হন । এরপর মামা ঈশ্বরচন্দ্র ঘোষ ও মহেশচন্দ্র ঘোষের অভিভাবকত্বে শুরু হয় বালক মহেন্দ্রলালের জীবনসংগ্রাম।
মামারবাড়িতে জনৈক পন্ডিতমহাশয়ের কাছে প্রাথমিক শিক্ষায় হাতেখড়ি হয় মহেন্দ্রলালের। ছোট থেকেই অনেক প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যে থেকে তাঁকে পড়াশোনা শুরু করতে হয়েছে। মামারবাড়িতে দিনরাত পরিশ্রম করতে হত মহেন্দ্রলালকে। সন্ধেবেলা বেশীরভাগ দিন রাস্তার আলোয় পড়াশোনা করতেন। পরবর্তীতে ঠাকুরদাস দেবের কাছে তিনি ইংরেজি শিক্ষালাভ করেন। ইংরেজি ভাষার দক্ষতার জন্য ১৮৪০ সাল থেকে বিনামূল্যে কলকাতার হেয়ার স্কুলে পড়াশোনার দরবার উন্মুক্ত হল দারিদ্র্য,ভগ্নস্বাস্থ্য, পারিবারিক সমস্যার সঙ্গে সংগ্রাম করে জ্ঞানার্জনের তৃষ্ণা আর বইয়ের প্রতি ভালবাসাকে পাথেয় করে ১৮৪৯ সালে সর্বোচ্চ নম্বর ও বৃত্তিসহ হেয়ার স্কুলের শিক্ষা সমাপ্ত করে ভর্তি হলেন হিন্দু কলেজে। তাঁর মেধা দেখে মুগ্ধ হলেন অধ্যক্ষ সাটক্লিফ মহাশয় ও দর্শনের অধ্যাপক জেনস সাহেব। এরপর উচ্চতর বিজ্ঞান ও চিকিৎসাশাস্ত্র অধ্যয়নের জন্য ১৮৫৪সালে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হন।১৮৬০সালে সেখান থেকে এল এম এস ও ১৮৬৩ সালে দ্বিতীয় ছাত্র (চন্দ্র কুমার দে-প্রথম) হিসেবে এম.ডি.পাশ করেন।
ডাক্তারি পাশ করার পর তাঁর পসার জমতে সময় লাগেনি বিশেষ। কালক্রমে ব্রিটিশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের বঙ্গীয় শাখার সম্পাদক হলেন। কিন্তু তৎকালীন অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসার সীমাবদ্ধতা দেখে ও মর্গান লিখিত ‘Philosophy of Homeopathy’ বইটি পড়ে এবং তখনকার খ্যতনামা হোমিওপ্যাথ রাজেন্দ্র লাল দত্তের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ক্রমশ আগ্রহী হয়ে উঠলেন হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা ধারাতেই। প্রাথমিক ভাবে সফল না হলেও এই চিকিৎসা রীতিতেও তাঁর কর্মজীবনে সফলতা এল। বিদ্যাসাগর ,কেশব চন্দ্র সেন শ্রীরামকৃষ্ণ অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিই ছিলেন তাঁর রোগীর তালিকায়।
১৮৬৮ সালে হোমিওপ্যাথি বিষয়ে লেখালেখির জন্য প্রকাশ করলেন ‘ক্যালকাটা জার্নাল অফ মেডিসিন’। পরাধীন দেশে কুসংস্কার ও অশিক্ষাতে জর্জরিত সমাজে বিজ্ঞান শিক্ষা প্রসারের পাশাপাশি নারীশিক্ষার জন্যও ব্রতী ছিলেন মহেন্দ্র লাল। মাদ্রাজ মেডিকেল কলেজে চিকিৎসা শাস্ত্র অধ্যয়নের জন্য অবলা দেবীকে (Abala Bose) উৎসাহিত করা এবং ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর কাল্টিভেশন সায়েন্সের সান্ধ্য বক্তৃতাগুলিতে সরলা দেবী চৌধুরানীর অংশগ্রহণের ব্যবস্থাপনা করে দেওয়া ছিল এই কাজের জ্বলন্ত উদাহরণ। তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন আধুনিক বিজ্ঞানচর্চা না করলে ভারতীয়দের কোনও দিন উন্নতি সম্ভব নয়। ক্যালকাটা জার্নাল অব মেডিসিন চালু করার পর ১৮৬৯-এ সেখানে সম্পূর্ণ ভারতীয়দের পরিচালনায় লন্ডনের ‘রয়্যাল ইনস্টিটিউট’ বা ‘ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশন ফর দি অ্যাডভান্সমেন্ট অব সায়েন্স’ এর ধাঁচে প্রাকৃতিক বিজ্ঞান চর্চার জন্য একটি জাতীয় সভার প্রয়োজনীয়তার কথা জানান তিনি। ১৮৭০ সালের ৩ জানুয়ারী হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকায় বিজ্ঞানসভার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। তিন বছর পর বঙ্গদর্শন পত্রিকায় বিজ্ঞানসভা প্রতিষ্ঠার জন্য মুক্তহাতে দান করার অনুরোধ জানানো হয়। রাজেন্দ্রলাল মিত্র, রমেশচন্দ্র মিত্র, কেশবচন্দ্র সেন, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়, প্যারীমোহন মুখোপাধ্যায়, যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর, কাশিমবাজারের মহারাজ, পাতিয়ালার মহারাজ, রমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো অনেকে অর্থসংগ্রহের জন্য এগিয়ে এসেছিলেন।
১৮৭৬ সালের ২৯ জুলাই ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স’-এর উদ্বোধন হল কলেজ স্ট্রিট ও বৌবাজারের সংযোগস্থলে সরকার থেকে লিজ় নেওয়া একটি বাড়িতে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদনপ্রাপ্ত এই প্রতিষ্ঠানে জগদীশচন্দ্র বসু, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, চুনীলাল বসু, প্রমথনাথ বসু, গিরীশচন্দ্র বসুর মতো বহু খ্যাতনামা ব্যক্তি বক্তৃতা দিতেন। জগদীশচন্দ্র প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস পরিচালনা করতেন এবং পাশাপাশি গবেষণা চালাতেন। মহেন্দ্রলালের মৃত্যুর পরে সি.ভি রমন ও গবেষণার জন্য এই প্রতিষ্ঠানের অঙ্গ হয়ে ওঠেন। ১৯৪৬-৫১ মেঘনাদ সাহা সভাপতি থাকাকালীন বিজ্ঞানসভা বৌবাজার থেকে যাদবপুরে স্থানান্তরিত হয়। ততদিনে মহেন্দ্রলালের স্বপ্নের বিজ্ঞান সভা সর্বস্তরে বিজ্ঞান গবেষণার এক আলোকবর্তিকা হয়ে উঠেছে।
১৮৮৩ সালে ব্রিটিশ সরকার মহেন্দ্রলাল সরকারকে C.I.E এবং ১৮৮৭ সালে কলকাতার শেরিফ রূপে সম্মান জানান। ১৮৯০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে D.L.উপাধিতে ভূষিত করে।
১৯০৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ৭১বছর বয়সে প্রস্টেট গ্রন্থির রোগে মহেন্দ্রলাল সরকারের মৃত্যু হয়।
তথ্যসূত্র
- পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পীসংঘ-কলকাতা জেলা কমিটির পক্ষে অরিন্দম চট্টোপাধ্যায় কর্তৃক প্রকাশিত 'বঙ্গীয় নবজাগরণের অগ্রপথিক' পরিবর্ধিত ২য় সংস্করণ :মে দিবস ২০০৭ ;পৃষ্ঠা -২৭০-২৭৭
- মাসিক বসুমতী ১৭বর্ষ১ম সংখ্যা,কার্ত্তিক,১৩৪৫ পৃষ্ঠা-৪
- Palit, Chittabrata (2012). "Sircir, Mahendralal". In Islam, Sirajul; Jamal, Ahmed A. (eds.). Banglapedia: National Encyclopedia of Bangladesh (Second ed.). Asiatic Society of Bangladesh.
- https://en.wikipedia.org/
- https://www.anandabazar.com/
- http://dspace.wbpublibnet.gov.in:8080/ পৃষ্ঠা-৬৩-৬৪
One comment