সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ (Syed Waliullah) একজন প্রখ্যাত বাংলাদেশী কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক, ও নাট্যকার। তাঁর লেখায় ধর্মীয় গোঁড়ামি, ভন্ডামি, কুসংস্কার প্রভৃতি সমাজের প্রচলিত অনাচার বারে বারে বিষয়বস্তু হিসেবে উঠে এসেছে। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘লালসালু’ তাঁকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে খ্যাতি এনে দেয়। 

১৯২২ সালের ১৫ আগস্ট চট্টগ্রামের শোলাশহরে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহের জন্ম হয়।  তাঁর বাবা সৈয়দ আহমদুল্লাহ পেশায় ছিলে উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী। মা নাসিম আরা খাতুনও ছিলেন উচ্চশিক্ষিত।  চার ভাই ও তিন বোনের মধ্যে ওয়ালীউল্লাহ ছিলেন বাবা মায়ের দ্বিতীয় সন্তান। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহের স্ত্রী আন্-মারি লুই রোজিতা মার্সেল তিবো ছিলেন একজন ফরাসিনী। বিয়ের পর তাঁর নাম হয় আজিজা মোসাম্মত নাসরিন। তাঁদের দুই সন্তান, মেয়ে সিমিন ওয়ালীউল্লাহ এবং ছেলে ইরাজ ওয়ালীউল্লাহ।

শৈশব থেকে শুরু করে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহের জীবনের অনেকটা সময় কেটেছে তাঁর বড় মামা খানবাহাদুর সিরাজুল ইসলামের সান্নিধ্যে। তাঁর সাহিত্য জীবনের প্রাথমিক প্রেরণা তিনি এই মামার কাছ থেকেই  পেয়েছেন। সিরাজুল ইসলাম পেশায় আইন সচিব ছিলেন। তাঁর স্ত্রী রাহাত আরা বেগম ছিলেন বিখ্যাত উর্দু লেখিকা ও রবীন্দ্র সাহিত্যানুরাগী। রবীন্দ্রনাথের ‘ডাকঘর’ নাটকটির উর্দু  অনুবাদ করেন তিনি। মামাবাড়ির এই সাহিত্যিক পরিমণ্ডল সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহকে ,পরবর্তীকালে সাহিত্যিক হওয়ার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল বলা যেতে পারে।  

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

বাবার বদলির চাকরির হওয়ার ফলে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ সমস্ত পূর্ব বাংলা জুড়েই বিভিন্ন স্কুলে পড়েছেন। কুড়িগ্রাম উচ্চ বিদ্যালয় থেকে তিনি ১৯৩৯ সালে ম্যাট্রিক পাস করার পর ১৯৪১ সালে ঢাকা কলেজ থেকে তিনি ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। স্কুল শিক্ষার পাঠ চুকিয়ে এরপর তিনি ১৯৪৩ সালে আনন্দ মোহন কলেজে ভর্তি হন বিএ পড়তে। স্নাতক স্তর শেষ করে ১৯৪৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিষয় নিয়ে এমএ তে ভর্তি হয়েও শেষ পর্যন্ত পড়া শেষ করতে পারেননি বাবার হঠাৎ মৃত্যুর কারণে। 

বলা যায় শিক্ষা জীবন, সাহিত্যচর্চা এবং কর্মজীবন প্রায়ই একই সাথে চালিয়েছেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ । ১৯৪৫ সালের মার্চ মাসে তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘নয়নচারা’ প্রকাশিত হয়। এই একই বছরে তিনি কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘দ্য স্টেটসম্যান’ পত্রিকায় সহ-সম্পাদক হিসেবে যোগদান করেন। তিনিই ছিলেন এই ঐতিহ্যশালী পত্রিকার প্রথম অহিন্দু সদস্য। 

১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ কলকাতা ছেড়ে পূর্ব পাকিস্তানে চলে যান এবং  রেডিও পাকিস্তানের সম্পাদক হিসেবে কাজে যোগ দেন।  এই বছরেই তিনি তাঁর জীবনের প্রথম উপন্যাস ‘লালসালু’ লেখা শুরু করেন। ১৯৪৮ সালে ‘লালসালু’ প্রকাশিত হয় ঢাকার কমরেড পাবলিশার্স থেকে। মূলত এই উপন্যাসের মাধ্যমেই সাহিত্যিক হিসেবে তিনি পরিচিতি লাভ করেন । এই উপন্যাসের মূল বিষয় যুগযুগ ধরে চলে আসা কুসংস্কার,অন্ধবিশ্বাস ও ধর্মীয় গোঁড়ামি।  ১৯৬০ সালে পাকিস্তানের করাচি থেকে এই উপন্যাসটির উর্দু অনুবাদ প্রকাশিত হয়। ঐ বছরেই প্যারিস থেকে ওয়ালীউল্লাহের স্ত্রী লালসালু উপন্যাসটির ফরাসি অনুবাদ প্রকাশ করেন।  ১৯৬৭ সালে লন্ডন থেকে ‘ট্রি উইদাউট রুটস’(Tree Without Roots) শিরোনামে তাঁর এই উপন্যাসটির ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে উপন্যাসটি আরবি,জার্মান,চেক,ইন্দোনেশীয়,জাপানী সহ বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে।

‘রেডিও পাকিস্তান’-এ কর্মরত অবস্থাতেই ১৯৫১ সালে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ প্রথমবার বিদেশ ভ্রমণ করেন। এরপর পাকিস্তান দূতাবাসের ‘প্রেস অ্যাটাশে’ হিসেবে ওয়ালীউল্লাহ অস্ট্রেলিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ফ্রান্স, পশ্চিম জার্মানি ও ভারতে কাজ করেছেন।  ১৯৫৪ সালে ঢাকায় ফিরে এলেন তথ্য অফিসার হিসেবে ঢাকাস্থ আঞ্চলিক তথ্য-অফিসে কাজ করেন। ১৯৫৫ সালে ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার তথ্য পরিচালকের পদে যুক্ত হন। ১৯৬১ সালে ‘প্রেস অ্যাটাশে হিসেবে প্যারিসের বাংলাদেশ দূতাবাসে কাজ করেছেন। এরপর ১৯৬৭ সালে ইউনেস্কোতে চুক্তিভিত্তিক প্রোগ্রাম স্পেশালিস্ট পদে যোগ দেন তিনি। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাকিস্তান সরকারের চাপে তিনি চাকরি ছাড়তে বাধ্য হন।

তাঁর রচিত উল্লেখযোগ্য উপন্যাসগুলি হল ‘চাঁদের অমাবস্যা’, ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ প্রভৃতি। তিনি চারটি নাটকও লিখেছিলেন – ‘বহিপীর’ ‘তরঙ্গবঙ্গ’ ,‘উজানে মৃত্যু’ ও ‘সুড়ঙ্গ’।

সাহিত্য চর্চার পাশাপাশি ছোটো থেকে ছবি আঁকার শখ ছিলো ওয়ালীউল্লাহের। তাঁর বেশ কয়েকটি বই যেমন ‘চাঁদের অমাবস্যা’, ‘দুই তীর ও অন্যান্য গল্প’, ‘কাঁদো নদী কাঁদো’, ‘লালসালু’র ইংরেজি অনুবাদ ‘Tree Without Roots’-এর প্রচ্ছদ তিনি নিজেই এঁকেছেন।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ।  বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে জনমত তৈরির চেষ্টা করেছেন। সামর্থ্য অনুযায়ী টাকা পাঠিয়েছিলেন কলকাতার মুক্তিযুদ্ধ তহবিলে। 

 সাহিত্য জীবনে বেশ কিছু পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন ওয়ালীউল্লাহ। ঢাকায় পি.ই.এন ক্লাবের উদ্যোগে এক আন্তর্জাতিক লেখক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় সেখানে বাংলা নাটক প্রতিযোগিতায় ‘বহিপীর’ দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে পুরস্কৃত হয়। এছাড়া ১৯৬১ সালে ‘লালসালু’ উপন্যাসের জন্য বাংলা একাডেমি পুরস্কার, ১৯৬৫ সালে ‘দুই তীর ও অন্যান্য’ গল্পের জন্য আদমজী পুরস্কার, ১৯৮৩ সালে একুশে পদক এবং ২০০১ সালে ‘লালসালু’ চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ কাহিনীকার হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন তিনি। 

১৯৭১ সালের ১০ অক্টোবর প্যারিসে মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণের ফলে তাঁর মৃত্যু হয়। 

আপনার মতামত জানান