রাজীব গান্ধী হত্যাকাণ্ড

রাজীব গান্ধী হত্যাকাণ্ড

ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে নানান জনপ্রিয় ও প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীর রহস্যজনক মৃত্যু নানা সময়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। নাথুরাম গডসের হাতে মহাত্মা গান্ধীর হত্যার পর থেকে শুরু করে কংগ্রেসি রাজত্বে কখনও ইন্দিরা গান্ধী, কখনও রাজীব গান্ধী রহস্যজনকভাবেই দুষ্কৃতীদের হাতে মারা গিয়েছেন। রাজীব গান্ধী হত্যাকাণ্ড ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক শোকাবহ ঘটনা। ইন্দিরা গান্ধী হত্যাকাণ্ডের পরে কোনওরকম অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন ছাড়াই ভারতের প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন হন ইন্দিরা গান্ধীর সুযোগ্য পুত্র রাজীব গান্ধী। দেশের সপ্তম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর রাজীব গান্ধী শপথ গ্রহণ করেন। ইন্দিরা গান্ধীর পরে দুর্ভাগ্যজনকভাবে দুষ্কৃতীদের চক্রান্তে নিহত ভারতের দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তিনি।

ইন্দিরা গান্ধী এবং ফিরোজ গান্ধীর পুত্র রাজীব গান্ধী প্রাথমিকপর্বে এয়ার ইন্ডিয়ার একজন বিমানচালক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। কিন্তু ১৯৮০ সালে একটি বিমান দুর্ঘটনায় তাঁর ভাই সঞ্জয় গান্ধী মারা গেলে ইন্দিরার পরামর্শে তিনি রাজনীতিতে পদার্পণ করেন। ১৯৮১ সালের ১ আগস্ট তিনি সংসদের সদস্য হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। ঐ বছরই ডিসেম্বর মাসে ভারতীয় যুব কংগ্রেসের দায়িত্ব পান তিনি। ১৯৮৪ সালে ৩১ অক্টোবর ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যু হলে রাজীব প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন হন। এই সময় সমগ্র দেশজুড়েই শিখ-বিরোধী দাঙ্গা চলছিল। মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে ভারতের সর্বকনিষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অভিষেক ঘটেছিল রাজীব গান্ধীর। তাঁর প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন সময়েই ভারতীয় সংসদে ‘মুসলিম মহিলা আইন, ১৯৮৬’ পাশ হয় যা বহুচর্চিত শাহ বানো বিবাহ বিচ্ছেদ মামলার সমাপ্তি ঘটায়। ১৯৯১ সালের ২১ মে তামিলনাড়ুর শ্রীপেরুম্বুদুরে একটি আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণের মাধ্যমে রাজীব গান্ধীকে হত্যা করা হয়। শ্রীলঙ্কার তামিল বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন লিবারেশন টাইগার্স অফ তামিল এলাম (Liberation Tigers of Tamil Eelam)-এর সদস্য থেনমোজি রাজারত্নম ওরফে ধানুই মূলত এই আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিলেন। এছাড়াও তাঁর এই পরিকল্পনার সঙ্গী ছিলেন ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ খলিস্তান-এর ড. জগজিৎ সিং এবং খলিস্তান লিবারেশন ফোর্সের গুর্জন্ত সিং বুধসিংওয়ালা।

সেই সময় শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধে ভারতীয় শান্তিরক্ষা বাহিনীর সংযোগ প্রত্যাহৃত হয়েছে। রাজীব গান্ধীর প্রধান হত্যাকারী ধানু ছিল লিবারেশন টাইগার্সের আত্মঘাতী স্কোয়াডের সদস্য। সেই সময়কার ‘এলটিটিই’ (LTTE) তথা লিবারেশন টাইগার্স অফ তামিল এলামের প্রধান ভেলুপিল্লাই প্রভাকরণের নির্দেশে ধানু শ্রীলঙ্কা থেকে নৌপথে ভারতের মাদ্রাজে এসেছিল ঘটনার দুমাস আগে। ঘটনার ঠিক এক বছর আগে ১৯৯০ সালে সানডে ম্যাগাজিন পত্রিকার একটি সংখ্যায় প্রকাশিত রাজীব গান্ধীর একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন যে পরবর্তী নির্বাচনে জয়লাভ করলে তিনি পুনরায় শ্রীলঙ্কায় ভারতীয় শান্তিরক্ষা বাহিনী পাঠাবেন। তাঁর আগে ইন্দিরা গান্ধী মদত দিয়েছিলেন এই এলটিটিই সংগঠনকে, তারা ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছ থেকেই প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রের যোগান পেত। কিন্তু রাজীব গান্ধী ক্ষমতায় আসার পর লক্ষ করেন সংগঠন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে এবং এই সংগঠনের সদস্যরা তখন ভারতীয়দের গ্রাহ্য না করে একটি পৃথক তামিল রাষ্ট্রের দাবিতে আন্দোলন করতে শুরু করেছিল। তামিলনাড়ুতে বসবাসকারী তামিলদের মধ্যেই এই আন্দোলনের বীজ বপন করেছিল তারা যার ফলে ভারতের মধ্যে একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী হাওয়া অনুভব করতে পেরেছিলেন রাজীব গান্ধী। সেকারণে তিনি শ্রীলঙ্কার বাহিনীর কাছে অর্থ ও অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করে দেন এবং প্রভাকরণকে দমনের উদ্দেশ্যে ভারতীয় শান্তিরক্ষা বাহিনী পাঠান। এতেই ক্ষুব্ধ হয়ে লিবারেশন টাইগার্স সংগঠন রাজীব হত্যার পরিকল্পনা করে। সংগঠনের সদস্যরা সিদ্ধান্ত নেন যে নির্বাচনের আগেই রাজীব গান্ধীকে হত্যা করবেন তাঁরা।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

১৯৯০ সালে এই পরিকল্পনামাফিক প্রভাকরণ তার চার সঙ্গীকে রাজীব গান্ধী হত্যাকাণ্ড অভিযানে সামিল করে। এই সদস্যদের মধ্যে ছিলেন বেবী সুব্রহ্মণ্যম, মুরুগান, মথুরাজা ও শিভারাসান। বেবি সুব্রহ্মণ্যমের তামিলনাড়ুতে নিজের ছাপাখানা ছিল। মুরুগান এই কাজে নিযুক্ত করে আরিভু, ভাগ্যনাথন ও তার নিজের বোন নলিনীকে। মথুরাজা আবার একজন চিত্রগ্রাহক হারিবাবুকে এই কাজে নিয়োগ করে। প্রত্যেকেকেই বোঝানো হয় যে রাজীব গান্ধী আবার ক্ষমতায় এলে পৃথক তামিল রাষ্ট্র গড়ার স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে। শিভারাসনের নির্দশে আরিভু এমন বোমা বানায় যা সহজেই আত্মঘাতী স্কোয়াডের ধানু নিজের শরীরে কাপড়ের ভিতরে রেখে দিতে পারবে। শ্রীপেরাম্বুদুরে ১৯৯১ সালের ২১ মে রাজীব গান্ধীর জনসভায় উপস্থিত হন সকলে। ঐ দিন দক্ষিণ ভারতে নির্বাচনী প্রচারে ব্যস্ত ছিলেন রাজীব গান্ধী। অন্ধ্রপ্রদেশের বিশাখাপত্তনমে প্রচারপর্ব সেরে সভার নির্ধারিত সময়ের দু ঘন্টা আগে একটা অ্যাম্বাসাডরে চড়ে মাদ্রাজ থেকে পেরাম্বুদুরে যান রাজীব গান্ধী। ঐ সভার মঞ্চে ওঠার আগেই তাঁর অনুরাগীরা অনেকেই তাঁর গলায় মালা পরিয়ে দিচ্ছিলেন। সেই মত রাজীব গান্ধীকে প্রণাম করতে যান ধানু। প্রথমে ধানুর উপর সন্দেহ হওয়ায় মহিলা সাব-ইন্সপেক্টর অনুসূয়া কুমারী ধানুকে বাধা দেন। হারিবাবুকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় তার কাজের ব্যাপারে। রাজীব গান্ধী এই ব্যাপারটা লক্ষ করে অনুসূয়া কুমারীকে নির্দেশ দেন যেন ধানুকে তার কাছে আসতে বাধা না দেওয়া হয়। ধানু চলে যান রাজীব গান্ধীর কাছে। নীচু হয়ে রাজীব গান্ধীকে প্রণাম করার সময়ই পেটে বেধে রাখা বোমাটি ফাটিয়ে দেন তিনি। বোমার বিস্ফোরণে তৎক্ষণাৎ রাজীব গান্ধীর মৃত্যু হয়, আত্মঘাতী হন ধানু এবং সভায় উপস্থিত আরও ১৪ জন মারা যান, গুরুতরভাবে আহত হন ৪৩ জন। চিত্রগ্রাহক হারিবাবু সেই বিস্ফোরণে মারা গেলেও তার ক্যামেরায় বিস্ফোরণের আগের বেশ কিছু ছবি তোলা ছিল। তা থেকেই পরবর্তীকালে দুষ্কৃতীদের ধরতে পারে ভারতীয় গোয়েন্দা বিভাগ। বিস্ফোরণের পরে রাজীব গান্ধীর ছিন্নভিন্ন দেহ বিমানে করে নিয়ে যাওয়া হয় দিল্লিতে এবং নয়া দিল্লির অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ মেডিকেল সায়েন্সে তাঁর দেহের ময়নাতদন্ত করার জন্য পাঠানো হয়। ১৯৯১ সালের ২৪ মে রাজীব গান্ধীর একটি অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার আয়োজন করা হয় যা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে সম্প্রচারিত হয়। যমুনা নদীর তীরে তাঁর সৎকার সম্পন্ন হয়েছিল। এই অঞ্চলের বর্তমান নাম ‘বীরভূমি’।

রাজীব গান্ধী হত্যাকাণ্ড মামলায় রাজীব গান্ধীর হত্যাকারীদের মধ্যে একমাত্র নলিনীকেই ভারতীয় তদন্তকারীরা জীবিত আটক করেছিলেন, কিন্তু বাকিদের অনেকেই সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেন। মাদ্রাজ উচ্চ আদালতে ১৯৯৮ সালে ২৬ জন অভিযুক্তের বিরুদ্ধে টাডা (TADA) আইনের অধীনে রাজীব গান্ধী হত্যা মামলা শুরু হয়েছিল। ১৯৯৯ সালে সেই ২৬ জনের মধ্যে থেকে সুপ্রিম কোর্ট ১৯ জনকে নির্দোষ হিসেবে ছেড়ে দেয় এবং বাকি সাতজনের মধ্যে জয় কুমার, রবার্ট পায়াস এবং রবিচন্দ্রনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। অন্যদিকে নলিনী, মুরুগান, শান্তন এবং এ জি পেরিভালামের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি ঘোষণা করে সুপ্রিম কোর্ট। পরে সনিয়া গান্ধীর হস্তক্ষেপে নলিনীর মৃত্যুদণ্ড মকুব করে তাঁকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। সন্ত্রাসমূলক ও বিঘ্নসৃষ্টিকারী কার্যকলাপ আইনের (Terrorist and Disruptive Activities Act) অধীনে এই বিচার চলায় অভিযুক্তরা কেবলমাত্র সুপ্রিম কোর্টের কাছেই সাজা মকুবের আবেদন করতে পারতেন। সমগ্র বিচারপর্বটি চলেছিল বন্ধ দরজার আড়ালে এবং প্রত্যেক সাক্ষীর পরিচয় গোপন রাখা হয়েছিল। ২০১১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর দোষীদের মৃত্যুদণ্ডের দিন ঘোষিত হলেও মাদ্রাজ আদালতের হস্তক্ষেপে তা আট সপ্তাহ পিছিয়ে যায়। এই মামলা নিয়ে কম বিতর্ক তৈরি হয়নি ভারতে। সুপ্রিম কোর্টে এই মামলার প্রধান বিচারপতি ছিলেন জে. কে. থমাস। রাজীব হত্যার সঙ্গে সংযুক্ত এ জি পেরিভালামকে ৩২ বছর পর জামিন দেওয়া হয়েছিল। তাঁর মৃত্যুদণ্ড মকুব করে দেওয়ার পরে প্রথমে তাকে ভেলোর কারাগারে বন্দি করে রাখা হয়। পরে তামিলনাড়ু সরকার তার যাবজ্জীবন কারাবাসের প্রস্তাব বাতিল করে মুক্তির প্রস্তাব পাস করে। রাজীব গান্ধী হত্যা মামলা সংক্রান্ত ইতিহাসে এই ঘটনা একটি বড় অধ্যায়।

রাজীব গান্ধী হত্যাকাণ্ড পরবর্তীকালে বহু চলচ্চিত্র ও তথ্যচিত্রের বিষয় হয়ে উঠেছে। ‘মিশন নাইন্টি ডেজ’, ‘দ্য টেররিস্ট’, ‘সায়ানাইড’, ‘ম্যাড্রাস ক্যাফে’ ইত্যাদি তাদের মধ্যে অন্যতম। এছাড়া ‘বাইপাস : ফ্লস ইন দ্য ফরেন্সিক ইনভেস্টিগেশন অফ রাজীব গান্ধীজ মার্ডার’ নামে ভারতবর্ষে প্রথম একটি মুক্ত উৎস পূর্ণদৈর্ঘ্যের ছবিও (Open Source Feature Film) নির্মিত হয়।

আপনার মতামত জানান