ইন্দিরা গান্ধী

ইন্দিরা গান্ধী

ভারতের প্রথম এবং এখনও পর্যন্ত একমাত্র মহিলা প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা প্রিয়দর্শিনী গান্ধী (Indira Priyadarshini Gandhi)৷ তিনি একজন সাহসী এবং দৃঢ়চেতা রাজনৈতিক  ব্যক্তি ছিলেন। নিজের কার্যকালে রাষ্ট্রের উন্নতির জন্য অনেক  গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। তাঁর সময়ে ভারতে মহিলারা রাজনীতিতে যোগদান করলেও, তাঁদের গুরুত্বপূর্ণ পদ দেওয়া হত না। রাজনৈতিক দলগুলির অভ্যন্তরে পুরুষতন্ত্রের প্রভাব ছিল। ইন্দিরা গান্ধীর সুদৃঢ় নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক মহলে ভারতের সম্মান বৃদ্ধি হয়। ভারতে রাজনৈতিক মহলে নারীদের নেতৃত্ব নিয়ে সন্দেহের পরিবেশ পাল্টাতে শুরু করে। তিনি শুধুমাত্র ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন না, তিনি নেহেরুর মৃত্যুর পর ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি খুব দ্রুত দেশের নাগরিকদের কাছে রাজনৈতিক ব্যক্তি হিসেবে বিশ্বাসযোগ্য মুখ হয়ে উঠেছেন। শুধুমাত্র  রাজনৈতিক ক্ষেত্রেই নয়, সামাজিক ক্ষেত্রেও তাঁর অবদান রয়েছে।

ইন্দিরা গান্ধীর ১৯১৭ সালে ১৯ নভেম্বর এলাহাবাদে জন্ম হয়। তিনি কাশ্মীরি পণ্ডিত পরিবারের সন্তান ছিলেন। তাঁর বাবা পন্ডিত জওহরলাল নেহরু ও মায়ের নাম কমলা নেহেরু। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর নাম রাখেন ‘প্রিয়দর্শিনী’। পরবর্তী সময়ে তিনি পরিচিত হতে থাকেন ইন্দিরা প্রিয়দর্শিনী নেহেরু নামে। ইন্দিরা গান্ধী বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান ছিলেন৷ তাঁর বাবা জওহরলাল নেহরু ভারতে স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে যুক্ত থাকা গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তি ছিলেন। স্বাধীন ভারতে জওহরলাল নেহরু ছিলেন প্রথম প্রধানমন্ত্রী। ইন্দিরা গান্ধীর দাদু মতিলাল নেহেরু তাঁর সময়ের বিখ্যাত ভারতীয় আইনজীবী এবং রাজনৈতিক ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ইন্দিরা গান্ধী ছোটবেলা থেকেই রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন।           

ইন্দিরার প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়েছে ঘর থেকেই। তাঁকে বেশিরভাগ শিক্ষক বাড়িতেই পড়াতেন। তিনি ১৯৩৪ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। ইন্দিরা গান্ধী দিল্লির মডার্ন স্কুলের ছাত্রী ছিলেন৷ তিনি এলাহাবাদের সেন্ট সিসিলা এবং সেন্ট মেরিস খ্রিস্টান কনভেন্ট স্কুলে পড়েছিলেন৷ এরপর তিনি পড়েছিলেন জেনিভা আন্তর্জাতিক স্কুলে (International School of Geneva), বেক্সের ইকলো নওভেল ( Ecole Nouvelle, Bex), পুনা এবং মুম্বাইয়ের শিক্ষার্থীদের নিজস্ব স্কুলে যা মুম্বাই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে যুক্ত। তিনি এবং তাঁর মা কমলা নেহেরু বেলুড় মঠে চলে আসেন। এখানে তাঁদের অভিভাবক ছিলেন স্বামী রঙ্গনাথানন্দ। তিনি শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতীতে পড়াশুনো করতে আসেন। এক বছর পরে বিশ্বভারতী ছেড়ে তাঁর অসুস্থ মায়ের কাছে ইউরোপে চলে যান। এরপর তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনো চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন৷ তাঁর উচ্চশিক্ষার বিষয় ছিল – ইতিহাস, অর্থনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান। এই সময় তাঁর জীবনে চরম আঘাত আসে – তাঁর মায়ের মৃত্যু হয়। মায়ের মৃত্যুর পর ১৯৩৭ সালে সমারভেল কলেজে (Somerville College) ভর্তি হন। এখানে ভর্তি হওয়ার আগে তিনি ব্যাডমিন্টন স্কুলে ( Badminton School) ভর্তি হয়েছিলেন। ইন্দিরা গান্ধী ল্যাটিন ভাষায় দুর্বল ছিলেন। ইন্দিরা গান্ধী গ্রেট ব্রিটেনে থাকবার সময় ফিরোজ গান্ধীর সাথে দেখা করতেন। তাঁরা ১৯৪২ সালে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন। তাঁদের দুই পুত্র রাজীব গান্ধী ও সঞ্জয় গান্ধীর যথাক্রমে ১৯৪৪ এবং ১৯৪৬ সালে জন্ম হয়।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

ইন্দিরা গান্ধী ১৯৫০ সালে জওহরলাল নেহরুর সহকারী হিসেবে নিযুক্ত হলেন। এখান থেকেই তাঁর কর্মজীবন শুরু হল। নেহেরুর মৃত্যুর পর কংগ্রেসের দুর্দিনে দলের সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিলেন। পন্ডিত নেহেরুর মৃত্যুর পর তিনি প্রথম নির্বাচনে যান। তিনি ১৯৬৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত প্রথম প্রধামন্ত্রীত্বের সময়কাল কাটিয়েছিলেন৷ ইন্দিরা গান্ধী দ্বিতীয়বারের জন্য নির্বাচনে জিতে আসেন এবং ১৯৭১ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকেন৷ এরপর দেশে তাঁর বিরুদ্ধে বিরোধীরা এক জোট হয়। তিনি ১৯৭৫ সালে দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন৷ ১৯৭৭ সালে জরুরি অবস্থা তুলে নেন এবং লোকসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেই নির্বাচনে তিনি হেরে যান, তাঁর বিরোধীরা সকলে একত্রিত হয়ে সরকার গঠন করলেও তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ফলে ১৯৮০ সালে আবার নির্বাচন হয় এবং তিনি বিপুল জনপ্রিয়তাসহ তাঁর তৃতীয় দফার প্রধানমন্ত্রীত্ব শুরু করেন।

ইন্দিরা গান্ধীর সময়ে ভারত পররাষ্ট্রনীতিতে সফলতা অর্জন করে ছিল। তাঁর সময়ে বাংলাদেশের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরী হয়। তাঁর শাসনকালের মধ্যে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধে ভারত শুধু জয়লাভি করেনি, আন্তর্জাতিক স্তরে যথেষ্ট সমীহ আদায় করে নিয়েছিল। কাশ্মীরকে নিয়ে পাকিস্তান আর ভারতের বিবাদে, আরব সমর্থন করে পাকিস্তানকে। ইন্দিরা গান্ধী পাকিস্তানকে চাপে রাখতে, আরবের শত্রুপক্ষ ইজরাইলের সাথে মৈত্রী সম্পর্ক স্থাপন করেন। ইন্দিরা গান্ধী পাকিস্তানকে কোণঠাসা করবার জন্য রাশিয়া আর ইরাকের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন।

অর্থনৈতিক সংস্কারের পিছনেও ইন্দিরা গান্ধীর অবদান রয়েছে। ভারতের তিনটে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা তাঁর সময়েই সফল হয়েছিল। দেশবিরোধী বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তির বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ নিয়েছিলেন তিনি। নকশালদের বিরুদ্ধে অভিযান চলে। ইন্দিরা গান্ধী ভারতীয় অর্থনীতিতে খানিক বামপন্থা ঘেঁষা সমাজতান্ত্রিক পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। তাঁর আমলেই ব্যাঙ্কগুলোকে জাতীয়করণ করা হয়েছিল। তাঁর আমলেই সবুজ বিপ্লব সঠিক দিশা পায় যা ভারতের খাদ্য সমস্যা সমাধানের এক দৃঢ় পদক্ষেপ হিসেবে মনে করা হয়। এছাড়াও তাঁর আমলেই ভারতে প্রথমবার সফলভাবে পরমাণু বোমা পরীক্ষা করা হয় ১৯৭৪ সালে।

তাঁর ভাষাগত পদক্ষেপ বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তাঁর সময়ে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে হিন্দি এবং ইংরাজিকে সরকারী ভাষা হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং এর আগে ১৯৫০ সালে ঠিক হওয়া হিন্দিকে জাতীয় ভাষা করার নীতিকে বাদ দেন। তিনি সংবিধানে আঞ্চলিক ভাষা গুলির উপর গুরুত্ব দিয়েছেন। এরফলে অহিন্দিভাষী রাজ্যগুলি চাপিয়ে দেওয়া ভাষাগত সাম্রাজ্যবাদ থেকে রেহাই পায়। সংবিধানে ধর্মনিরুপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রকে গুরুত্ব দেওয়া হয়।

ইন্দিরা গান্ধী তাঁর সময়কালে ভারতবর্ষে সবচেয়ে বেশি আলোচিত রাজনৈতিক ব্যক্তি ছিলেন৷ তাঁর বেশ প্রতিটি পদক্ষেপ দেশকে কয়েক কদম এগিয়ে নিয়ে যায়৷ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইন্দিরা গান্ধী তাঁর রাজনৈতিক অবিচ্ছিন্নতা, দৃঢ়চেতা সিদ্ধান্ত, ক্ষমতার সুনিপুণ কেন্দ্রীকরণের জন্য বিখ্যাত ছিলেন। তাঁর পদক্ষেপগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সাহায্য করা। পাকিস্তান স্বাধীন বাংলাদেশের উপর নিজেদের সাম্রাজ্যবাদী শাসন চাপিয়ে দিয়েছিল। স্বাধীনচেতা বাঙালি জাতি পাকিস্তানের সাম্রাজ্যবাদ মেনে নিতে পারেনি। পাকিস্তান ১৯৭১ সালে বাংলাদেশীদের এই আন্দোলন দমিয়ে রাখবার জন্য নৃশংস ভাবে গণহত্যা চালায় । ইন্দিরা গান্ধী সেইসময় সীমান্তে আটকে থাকা মরণাপন্ন অসংখ্য বাংলাদেশীদের ভারতে আশ্রয় দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের মুক্তি যোদ্ধাদের অস্ত্র দিয়ে , যুদ্ধ বিমান, প্রশিক্ষণ দিয়ে সাহায্য করেছিলেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। ইন্দিরা গান্ধীর রাজনৈতিক জীবনে সেরা কৃতিত্বের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে ভারতবর্ষের গুরুত্ব বৃদ্ধি করা। তাঁর জীবনে আরেকটি আলোচিত পদক্ষেপ হল- ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৭ সালে দেশে জরুরি অবস্থার ঘোষণা। এইসময় বিরোধী রাজনৈতিক দলের, মতাদর্শের নেতাদের জেলে ভরা হয়, সংবাদপত্রের বা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সেন্সার করে বন্ধ করে দেওয়া হয়। এইসময় বহু বিখ্যাত লোকের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল। সেই সময় এমন একটা পদক্ষেপ নেওয়া সহজ ছিল না।

ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেস ১৯৭৭ সালে শিখ সম্প্রদায়ের অকালি দলের সাথে হাত মিলিয়ে পাঞ্জাবে ক্ষমতায় আসে। পাঞ্জাবের রাজনীতিতে চরমপন্থীদের প্রভাব বৃদ্ধি পেতে থাকে। জারনিল সিং ভৃন্ডালওয়ালে সেইসময়ের একজন জনপ্রিয় চরমপন্থী শিখ ধর্মীয় নেতা ছিলেন। তাঁর সংগঠনটি পাঞ্জাবে ক্ষমতার নামে অরাজকতা ছড়াতে শুরু করল । এরপর অবস্থা খুব তাড়াতাড়ি পাল্টায়। ভৃন্ডালওয়ালে প্রায় ২০০ জন অস্ত্রধারী শিষ্য নিয়ে অমৃতসরের স্বর্ণমন্দিরের কাছে গুরু নানক নিবাস নামে অতিথিশালায় গিয়ে ওঠেন। সেইসময় ১৯৮৩ সালে স্বর্ণমন্দিরে অস্ত্রধারী উগ্রপন্থীরা জড়ো হয়েছিল। যাদের দাবি ছিল শিখদের জন্য স্বতন্ত্র দেশের। ইন্দিরা গান্ধী দীর্ঘ সময় ধরে বিদ্রোহীদের সাথে কথা বলেও সফলতা পেলেন না। তিনি একপ্রকার বাধ্য হয়ে ভারতবর্ষের অখণ্ডতা রক্ষা করবার জন্য ১৯৮৪ সালের জুন মাসে ভারতীয় সেনাবাহিনী দিয়ে অভিযান চালালেন। এই অভিযানটি ইতিহাসের পাতায় ‘অপারেশন ব্লু স্টার’ নামে বিখ্যাত। এই অভিযানে স্বর্ণ মন্দিরে বিদ্রোহীদের সাথে সাথে বহু নিরীহ দর্শনার্থীর প্রাণ হারায়। স্বর্ণমন্দিরে রক্তপাত ধর্মপ্রাণ শিখ সম্পদায়ের অনুভূতিকে আঘাত করল। বিরোধীরা এই পদক্ষেপের নিন্দা করতে শুরু করে। ইন্দিরা গান্ধীর বিরুদ্ধে শিখ ধর্মসম্প্রদায়কে অপমান করবার অভিযোগ ওঠে । সেই কারণে তাঁর নিরাপত্তায় থাকা ব্যক্তিগত দুজন শিখ দেহরক্ষী তাঁকে গুলি করে হত্যা করেন। ইন্দিরা গান্ধী মারা যান ১৯৮৪ সালে ৩১ অক্টোবর৷ এই আক্রমণের তীব্রতা ভয়ঙ্কর। সাতওয়ান্ত সিং, বিয়ন্ত সিং এবং কেহার সিং ছিলেন ইন্দিরা গান্ধীর হত্যাকারী। ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুতে পুরো দেশ এবং আন্তর্জাতিক মহলে শোক ছড়িয়ে যায়।

পাকিস্তান যুদ্ধ জয়ের জন্য তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ভিভি গিরি ইন্দিরা গান্ধীকে ১৯৭১ সালে ভারতরত্ন পুরস্কারে সম্মানিত করেন। তাঁর কৃতিত্বের জন্য ২০১১ সালে তাঁকে মরণোত্তর ‘বাংলাদেশ স্বাধীনতা সম্মাননা’ দেওয়া হয়। তাঁকে ২০২০ সালে টাইমস ম্যাগাজিন গত শতকের একশজন ক্ষমতাশালী মহিলার তালিকায় স্থান দিয়েছে। নতুন দিল্লি বিমানবন্দরের নাম তাঁর সম্মানে ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর রাখা হয়। ইন্দিরা আবাস যোজনার মাধ্যমে গরীবদের গৃহ নির্মাণ প্রকল্পও তাঁর সম্মানে নামাঙ্কিত।

18 comments

আপনার মতামত জানান