প্যারীচরণ সরকার (Peary Charan Sarkar) উনিশ শতকের একজন পাঠ্যপুস্তক রচয়িতা ছিলেন যাঁর রচিত পাঠ্যপুস্তক সারা বাংলা তথা ভারতে বিপুল জনপ্রিয়তা পায় এবং দেশের অধিকাংশ প্রধান ভাষাগুলিতে তা অনূদিত হয়। তিনি একাধারে নারী শিক্ষার অগ্রদূত, শিক্ষাবিদ, সমাজসংস্কারকও ছিলেন।
১৮২৩ সালের ২৩ জানুয়ারি উত্তর কলকাতার চোরবাগানে প্যারীচরণ সরকারের জন্ম হয়৷ তাঁদের পরিবারের আদি নিবাস ছিল হুগলীর তারাগ্রামে। তাঁর বাবা ভৈরব চন্দ্র সরকার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে জাহাজের সরঞ্জাম বিক্রেতা হিসাবে কাজ করতেন৷ তাঁদের পারিবারিক পদবি ছিল ‘দাস’ যা পরবর্তীকালে উপাধিপ্রাপ্ত হয়ে ‘সরকার’ হয়। তাঁদের স্বচ্ছল সংসার প্যারীচরণের বাবা এবং তাঁর এক ভাইয়ের মৃত্যুতে আর্থিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে৷
প্যারীচরণের প্রাথমিক পড়াশোনা সম্পন্ন হয় ডেভিড হেয়ারের পটলডাঙ্গার পাঠশালা থেকে। ১৮৩৮ সালে প্যারীচরণ হেয়ার সাহেবের স্কুলে ভর্তি হন এবং তিনি জুনিয়র স্কলারশিপ পরীক্ষায় মাসিক আট টাকা বৃত্তি লাভ করেন। এরপর তিনি হিন্দু কলেজে ভর্তি হলে সেখানেও সিনিয়র স্কলারশিপ পরীক্ষায় মাসিক চল্লিশ টাকা বৃত্তি লাভ করেন। ১৮৪৩ সালে তাঁর হিন্দু কলেজের পড়াশেনা শেষ হয়৷
প্যারীচরণ সরকারের কর্মজীবন শুরু হয় হুগলীর একটি স্কুলে শিক্ষকতার মাধ্যমে। এরপরে ১৮৪৬ সালে তিনি বারাসত গভর্নমেন্ট স্কুলের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বে যোগদান করেন এবং ১৮৫৪ সাল পর্যন্ত এই স্কুলে কর্মরত থাকেন। ১৮৪৭ সালে বারাসাতের নবীন কৃষ্ণ মিত্র এবং কালীকৃষ্ণ মিত্র নামে দুই ভাই প্যারীচরণ সরকারের কাছে প্রস্তাব দেন তাঁরা বাংলার প্রথম বেসরকারী বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠানের জন্য অর্থদান করতে চান৷ এই বিদ্যালয় স্থাপন করতে গিয়ে প্যারীচরণকে অনেক বাধা বিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়৷ তবে বিদ্যালয়টি স্থাপন করা হয় যা পরবর্তীকালে কালীকৃষ্ণ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের নামে পরিচিত হয়৷ জন বেথুন ১৮৪৮ সালে এই বিদ্যালয় পরিদর্শনে গিয়ে এতটাই অভিভূত হয়েছিলেন যে তিনি এরপর এখান থেকে অনুপ্রেরণা পেয়ে ১৮৪৯ সালে বালিকাদের জন্য বেথুন স্কুল স্থাপন করেন। কলকাতায় কারিগরি এবং কৃষি বিদ্যালয় স্থাপনেও তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে৷ প্যারীচরণ কুলুটোলা ব্রাঞ্চ স্কুলের প্রধান শিক্ষকরূপে আট বছর দায়িত্ব পালন করেন এবং তাঁর উদ্যোগেই এই বিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তিত হয়ে হেয়ার স্কুল হয়। তিনি ১৮৬৩ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজের অস্থায়ী অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন এবং ১৮৬৭ সাল থেকে এখানে স্থায়ী অধ্যাপক হিসেবে নিয়োজিত হন।
প্যারীচরণ অনুভব করেছিলেন এদেশে পাঠ্য উপযোগী ইংরেজী বইয়ের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। তাই তিনি নিজেই উদ্যোগ নিয়ে লিখে ফেললেন পাঠ্য বই। ১৮৫০ সালে ‘স্কুল বুক প্রেস’ থেকে প্রকাশিত হয় তাঁর লেখা প্রথম পাঠ্যপুস্তক ‘ফার্স্ট বুক অফ রিডিং ফর নেটিভ চিলড্রেন’(First Book of Reading for Native Children)। পরে তিনি ১৮৫৩ থেকে ১৮৭০ সালের মধ্যে এই বইটির দ্বিতীয় থেকে ষষ্ঠ ভাগ অবধি প্রকাশ করেন। উনিশ শতকের এই কিংবদন্তি পাঠ্যপুস্তক পড়ে ইংরেজিতে হাতেখড়ি হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের। তাঁর লেখা ফার্স্ট বুক আজকাল আর কোন স্কুলে পড়ানো না হলেও তাঁর লেখা এই বই এর একটা কবিতা এখনো প্রচলিত ,”Thirty days have September,April, June and November,February has Twenty -Eight alone,And the rest have thirty-one.”
প্যারীচরণ সরকার কেবল লিখেই ক্ষান্ত থাকেননি নিজের প্রচেষ্টায় সেই বই ছাপাতেনও। উত্তর কলকাতায় ছিল তাঁর বাড়ি এবং ছাপাখানা। এখনও জরাজীর্ণ অবস্থায় সেই বাড়ির অস্তিত্ব বর্তমান। ১৮৬৬ সালে তিনি ‘এডুকেশন গেজেট ‘ পত্রিকার দায়িত্ব গ্রহণ করলেও এই দায়িত্বে তিনি বেশীদিন ছিলেন না। এরপরে তিনি ‘ওয়েল উইশার’ এবং ‘হিতসাধক’ নামে দুটি সংবাদপত্র প্রকাশ করেছিলেন।
কেবলমাত্র শিক্ষাকতার কাজেই তিনি নিজেকে আবদ্ধ রাখেননি বাংলার নবজাগরণেও তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন৷ স্ত্রীশিক্ষা প্রচারে তিনি একাধিক বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন৷ বিধবা-বিবাহ প্রচলনে তিনি বিদ্যাসাগর মশাশয়কে সহযোগিতা করেছিলেন৷ ১৮৬৯ সালে তিনি বিধবা বিবাহ তহবিলে (Widow remarriage Fund) আড়াই হাজার টাকা দান করেন যা তখনকার নিরিখে যথেষ্ট বেশী ছিল৷ এমনকি বেথুন স্কুলে যাতে মেয়েরা পড়তে যায় সেই বিষয়ে তিনি অভিভাবকদের যথেষ্ট প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছিলেন৷ নারী শ্রমিকদের সন্তানরা যাতে সুশিক্ষা লাভ করতে পারে সেজন্য তিনি কারিগরি বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন৷ ১৮৭৩ সালে তিনি কেশবচন্দ্র সেনের কমিটিতে যোগদান করেছিলেন৷ নারী শিক্ষাকে ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে ১২৮২- ১২৮৩ বঙ্গাব্দে ‘বঙ্গ মহিলা’ পত্রিকা প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি যা ঐ সময়ে কোনও স্কুলের তরফ থেকে উদ্যোগ হিসেবে খুবই বিরল ছিল। স্ত্রীশিক্ষার পাশাপাশি মহিলাদের নানা বিষয় নিয়েও লেখালেখি চলত মাসিক এই পত্রিকায়।
১৮৭৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর কলকাতায় নিজের বাড়িতে বাগানের কাজ করতে গিয়ে আঙুল কেটে ক্ষতস্থানে গ্যাংগ্রিন হয়ে তাঁর মৃত্যু হয়।
তথ্যসূত্র
- সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত ও অঞ্জলি বসু সম্পাদিত, সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, প্রথম খণ্ড, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, পৃষ্ঠা ২৮৬
- https://en.wikipedia.org/
- https://eisamay.indiatimes.com/
- http://www.dhaka18.com/