জাতীয় মৃগীরোগ দিবস

১৭ নভেম্বর ।। জাতীয় মৃগীরোগ দিবস (ভারত)

প্রতিটি বছর প্রতি মাসের নির্দিষ্ট কিছু দিনে বিভিন্ন দেশেই কিছু দিবস পালিত হয়। ঐ নির্দিষ্ট দিনে অতীতের কোন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে স্মরণ করা বা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরী করতেই এই সমস্ত দিবস পালিত হয়। ভারতের পালনীয় সেই সমস্ত দিবসগুলির মধ্যেই একটি হল জাতীয় মৃগীরোগ দিবস পালন (National Epilepsy Day )

প্রতি বছর ১৭ নভেম্বর জাতীয় মৃগীরোগ দিবস পালন করা হয়। মৃগী রোগ সম্পর্কে জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে এই দিনটি পালিত হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে সারা পৃথিবীতে প্রায় ৫০মিলিয়ন লোক মৃগী রোগে আক্রান্ত। তার মধ্যে বেশীরভাগই আর্থিকভাবে অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশের বাসিন্দা। ভারতে মৃগী রোগীর সংখ্যা প্রায় দশ মিলিয়ন । যদিও মৃগীরোগ সম্পূর্ণরূপে নিরাময় সম্ভব, কিন্তু বেশীরভাগই উপযুক্ত চিকিৎসার থেকে বঞ্চিত।

মৃগী হল একটি স্নায়ুবিক রোগ। বারংবার স্নায়ুগত কারণে অজ্ঞান হয়ে যাওয়া বা খিঁচুনি এই রোগের প্রধান উপসর্গ। মৃগী রোগ মূলত মস্তিকে আঘাত জনিত কারণ বা স্ট্রোক, মাথায় টিউমার বা সংক্রমণ, জন্মগত কোন ত্রুটির কারণে হতে পারে বলে অনুমান করা হয়। এগুলি ছাড়াও জিনগত মিউটেশন ও মস্তিকে সেরেব্রাল কর্টেক্সের স্নায়ুকোষের অস্বাভাবিক ও মাত্রাতিরিক্ত ক্রিয়ার কারণেও মৃগী রোগ হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা জানান। এছাড়াও মস্তিকে সঠিক পরিমাণে অক্সিজেনের সরবাহ না হলেও মৃগী রোগ হতে পারে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাযায় মৃগী রোগকে ‘নিউরোলোজিক্যাল ডিজিজ’ বলে।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

সদ্যজাত শিশু থেকে যে কোন বয়সের মানুষই এই রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। সদ্যজাত শিশুদের ক্ষেত্রে ক্যালসিয়ামের অভাব থাকলে বা শরীরে শর্করা বৃদ্ধি পেলে মৃগী রোগে আক্রান্ত হয়। তাছাড়াও যদি জন্মের সময় কোন শিশুর সমস্যা দেখা যায় তাহলেও এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভবনা থাকে। দুটি ভাগ রয়েছে মৃগী রোগের। প্রাইমারি এবং সেকেন্ডারি। প্রথম ক্ষেত্রে ইলেকট্রিক্যাল ইমপাল্সের কোন ত্রুটি হলে এই রোগ দেখা যায়। আর দ্বিতীয় ক্ষেত্রে সোডিয়ামের পরিমাণ কমে গেলে মৃগী রোগে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা থাকে। মস্তিকে প্রদাহ বা অতিরিক্ত জ্বরের থেকেও এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

এই রোগে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে ঝগড়া করার প্রবণতা, অস্বাভাবিক রকমের খিটখিটে হয়ে যাওয়া, আত্মকেন্দ্রিকতা এবং একই বিষয়ে অতিরিক্ত মাত্রায় চিন্তা করার প্রবণতা, কাজে অমনোযোগী হওয়া প্রভৃতি লক্ষণগুলি দেখা যায়। দীর্ঘদিন ধরে মৃগী রোগে আক্রান্ত ব্যাক্তিদের মধ্যে বুদ্ধির ঘাটতি দেখা যায়। বিষাদগ্রস্ত হয়ে আত্মহত্যা করার প্রবণতাও প্রবল হয়ে ওঠে।

মৃগীরোগে হঠাৎ যে কোন সময়ে বা যে কোন স্হানেই খিঁচুনি শুরু হতে পারে। সাধারণত আধ মিনিট থেকে এক মিনিট অবদি খিঁচুনির স্হায়ীত্ব হয়। এরপরে নিজে থেকেই ঠিক হয়ে যায়। কিন্তু খিঁচুনি যদি পাঁচ মিনিটের বেশী স্হায়ী হয় তাহলে তৎক্ষণাৎ ডাক্তার ডাকা উচিত। শিশুদের ক্ষেত্রে খিঁচুনি ছাড়াও চোখের পাতা স্হির হয়ে যায়। খিঁচুনির সময় রোগীকে স্পর্শ না করে তার পাশে থাকা প্রয়োজন। তিনি যাতে কোনরকম আঘাত না পান সেইদিকে লক্ষ্য রাখা উচিত। সেই কারণে কোনরকম শক্ত বা ধারালো জিনিস রোগীর হাতের নাগালের বাইরে রাখা প্রয়োজন। যাতে খিঁচুনির প্রভাবে তিনি নিজেকে আঘাত করতে না পারেন। এইসময়ে কোন তরল খাদ্যবস্তু যাতে মুখের মধ্যে প্রবেশ না করে সেইদিকেও খেয়াল রাখা প্রয়োজন। আক্রান্ত রোগীর বেল্ট, টাই খুলে দিয়ে তাকে যথাসম্ভব স্বস্তিতে রাখা দরকার। যদি সুযোগ হয় তবে আক্রান্ত রোগীর মাথার নীচে একটি বালিশ দেওয়া প্রয়োজন। খিঁচুনির পরেও রোগীর স্বাভাবিক অবস্থায় আসতে কিছুক্ষণ সময় লাগে। সেই সময়ে তার পাশে থাকা প্রয়োজন। এই সময়ে রোগীর কিছুটা স্মৃতিভ্রম হতে পারে, তাই তাকে অত্যন্ত যত্নের সাথে সঙ্গ দেওয়া প্রয়োজন। খিঁচুনি বন্ধ হলে রোগীকে পাশ ফিরিয়ে শুয়ে দেওয়া প্রয়োজন। কখনও কখনও খিঁচুনির প্রভাবে মুখের মধ্যে দাঁতের কামড়ে জিহ্বা ক্ষত বিক্ষত হয়ে যায়। তাই এই সময়ে কোনভাবেই রোগীর মুখের মধ্যে আঙুল বা চামচ জাতীয় জিনিস প্রবেশ করানো উচিত নয়। এতে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। রোগীর আশেপাশে বেশী ভিড় জমতে দেওয়া উচিত নয় যাতে বায়ু চলাচল বাধাপ্রাপ্ত না হয়। খিঁচুনি শেষে রোগীর নাড়ীর স্পন্দন পরীক্ষা করা প্রয়োজন। মৃগী রোগীদের খিঁচুনি আরম্ভ হলে আতঙ্কিত না হয়ে তাদের যত্ন নেওয়া প্রয়োজন। তাহলেই এই রোগীদের বড় বিপদের হাত থেকে বাঁচানো সম্ভব হয়। অনেক ক্ষেত্রে মৃগী নিয়ে অনেক ধরনের কুসংস্কার দেখা যায়। আত্মা বা ভূত প্রেতের কাহিনীও শোনা যায়। কিন্তু মৃগী একটি স্নায়বিক রোগ। সমস্ত রকমের কুসংস্কার থেকে মুক্ত হয়ে মৃগী রোগীদের পাশে থাকা প্রয়োজন।

ভারতে ‘এপিলেপসি ফাউন্ডেশন’ জাতীয় মৃগী রোগ দিবস পালন করে। ২০০৯ সালে মহারাষ্ট্রের মুম্বাই শহরে ডাঃ নির্মল সূর্য এই সংস্হার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মৃগী রোগীদের সম্বন্ধে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধিই হল এই সংস্হার উদ্দেশ্য। ২০০৯ সাল থেকেই এই সংস্হা ‘মৃগী দিবস’ পালন করে আসছে।

দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ১৭ নভেম্বর দিনটি বিশেষ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পালন করা হয়। আক্রান্ত দুস্থ মৃগী রোগীদের জন্য বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ক্যাম্পেনের ব্যবস্থা করে তাদের বিনামূল্যে চিকিৎসার করে। বিভিন্ন হাসপাতাল গুলিতেও এই দিনটিতে বিনামূল্যে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। মৃগীরোগ সংক্রান্ত বিতর্ক, আলোচনাসভা, বিভিন্ন রকমের সচেতনতামূলক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দিনটি পালন করা হয়। কোন কোন জায়গায় মৃগী রোগ সংক্রান্ত আঁকা প্রতিযোগিতা, রক্তদান শিবির আয়োজন করা হয়।

আপনার মতামত জানান