ভারতীয় বিচারালয়ের ইতিহাসে অনেক এমন মামলার হদিশ পাওয়া যায়, যার প্রভাব সরাসরি ভারতের সংবিধানের ওপর গিয়ে পড়েছিল। মাধব রাও সিন্ধিয়া বনাম ভারত মামলা সেই তালিকারই অন্তর্ভুক্ত। ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতীয় রাজাদের শাসন ক্ষমতা এবং তার স্বীকৃতি স্বাধীনতার পরেও বিশেষ চুক্তির দ্বারা আদালতে স্বীকৃত হয়। সরকার কর্তৃক সেই রাজাদের পেনশনের ব্যবস্থা করা হয় এবং তাঁদের রাজ্যের বেশ কিছু সম্পত্তির মালিকানা অর্থাৎ প্রিভি পার্সকে মান্যতা দেওয়া হয়। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর আমলে রাষ্ট্রপতির বিশেষ ক্ষমতার দ্বারা প্রণয়ন করা একটি আদেশের নমুনা বিশেষত গোয়ালিয়রের রাজা মাধব রাও সিন্ধিয়ার ওপর লাগু করা হয় এই মর্মে যে, রাজা হিসেবে তাঁর শাসকের স্বীকৃতি কেড়ে নেওয়া হবে, সেই সঙ্গে প্রিভি পার্স সহ সমস্ত সুযোগ সুবিধা বিলোপ করা হবে। এই আদেশের পরেই সুপ্রিম কোর্টে পাল্টা পিটিশন দায়ের করেন মাধব রাও সিন্ধিয়া। শুরু হয় মাধব রাও সিন্ধিয়া বনাম ভারত মামলা (madhavrao scindia vs union of india) । দীর্ঘ শুনানির পরে আদালত প্রাথমিকভাবে রাজার তরফেই রায় দিলেও পরবর্তী সময়ে সংবিধান সংশোধনের জন্য সরকার পদক্ষেপ নিয়েছিল।
মাধব রাও সিন্ধিয়া বনাম ভারত মামলা সম্পর্কে বিশদে জানতে হলে প্রথমে প্রিভি পার্সের সূচনাটি বুঝে নেওয়া প্রয়োজন। অখন্ড একটি রাষ্ট্রকে ভারত এবং পাকিস্তান, এই দুই আলাদা রাষ্ট্রে বিভক্ত করে ব্রিটিশরা উভয়কেই স্বাধীনতা হস্তান্তর করেছিল। কিন্তু তখনও উপমহাদেশে এক তৃতীয়াংশেরও বেশি নেটিভ রাজ্যের অস্তিত্ব ছিল, যেগুলির শাসনভার মূলত ছিল একজন ভারতীয় রাজার ওপর। ১৯৪৭ সালের ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্ট অ্যাক্ট দ্বারা ব্রিটিশ তাদের আধিপত্য ত্যাগ করলে এই সমস্ত রাজ্যগুলির কাছে পড়ে থাকল দুটি পথ, হয় তারা পাকিস্তান বা ভারতের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাবে নচেৎ স্বাধীনভাবে থাকবে। কিন্তু সেইসব নেটিভ রাজ্যগুলি সরকারের ওপরে এতটাই নির্ভরশীল ছিল যে যোগদান করা ছাড়া তাদের উপায় রইল না। স্বাধীনতার প্রাক্কালে বেশিরভাগ রাজ্যই ভারতের সঙ্গে যোগদানের (পড়ুন ইনস্ট্রুমেন্ট অব অ্যাক্সেশন) দলিলপত্রে স্বাক্ষর করেছিল, পাকিস্তানের দলিলে সই করেছিল গুটিকয়েক। অবশ্য এই যোগদানের ক্ষেত্রে ভৌগলিক অবস্থানকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। ব্রিটিশরা ভারত ত্যাগ করার পর মাত্র কয়েকটি রাজ্য সম্পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত ছিল। বল্লভভাই প্যাটেল এবং ভিপি মেননের কূটনীতির কারণে, ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্টের আগে ত্রাভাঙ্কোর, ভোপাল এবং যোধপুরও যোগদানের দলিলপত্রে স্বাক্ষর করে।
সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের অধীনে একটি রাজ্য মন্ত্রক গঠন করা হয়েছিল এবং সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল যে, এই দেশীয় রাজ্যগুলির প্রয়োজনীয় প্রতিরক্ষা, যোগাযোগ এবং বৈদেশিক সম্পর্কের বিষয়গুলির দায়িত্ব নেবে ভারত সরকার এবং রাজ্যের অন্তর্গত শাসনের ভার থাকবে সেই রাজাদের হাতেই। এই সমস্ত রাজ্যে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলিও চালু করে দেওয়া হয় এবং ১৯৪৯ সালে রাজ্যগুলি নতুন রাজ্য গঠনের জন্য ভারতের সঙ্গে সম্পূর্ণরূপে সংযুক্ত হয়। ১৯৪৭ সাল থেকেই চুক্তি অনুযায়ী স্থির হয় দেশীয় রাজ্যের রাজারা প্রিভি পার্স হিসেবে রাজ্যের ব্যক্তিগত বড় অঙ্কের সম্পত্তি নিজেদের অধীনে রাখতে পারবেন। ১৯৪৯ সাল থেকে ভারতীয় সংবিধানের ২৯১ এবং ৩৬২ অনুচ্ছেদের অধীনে বলা হয় এই প্রাক্তন রাজা এবং তাঁর উত্তরাধিকারেরা করমুক্ত প্রিভি পার্স ভোগ করবার সুযোগ পাবেন এবং ভারত সরকারের তহবিল থেকে এই শাসক পরিবারগুলিকে ধর্মীয় বা অন্যান্য অনুষ্ঠানে ব্যয়ের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ প্রদান করা হবে। এটি অনেকটা পেনশনের মতো মনে করা যেতে পারে।
এই প্রিভি পার্স নিয়ে আপত্তি তুলেছিল তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সরকার। এই ব্যবস্থাটি বাতিল করার জন্য ১৯৭০ সালে সংসদে একটি প্রস্তাব আনা হয়। লোকসভাতে প্রয়োজনীয় সমর্থনসহ সেই প্রস্তাব পাসও হয়ে যায় কিন্তু রাজ্যসভায় মাত্র একটি ভোটের অভাবে প্রয়োজনীয় দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় পৌঁছতে ব্যর্থ হয়। ফলে তখনকার মতো সেই প্রস্তাব কার্যকরী হয়নি। তবে তৎকালীন সরকার এত সহজে ছেড়ে দিতে চাননি এই বিষয়টিকে। ১৯৭০ সালের ৬ সেপ্টেম্বর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি সংবিধানের ৩৬৬(২২) ধারায় বর্ণিত তাঁর বিশেষ ক্ষমতা প্রয়োগ করে একটি আদেশ পাস করেন এবং নেটিভ রাজ্যগুলির রাজাদের শাসক হিসেবে যে স্বীকৃতি এতদিন ছিল তা কেড়ে নেন। এরফলে প্রিভি পার্স-সহ সরকারী ভাতার যাবতীয় সুযোগসুবিধা বন্ধ হয়ে যায়। রাষ্ট্রপতি এই আদেশের একটি নমুনা গোয়ালিয়রের সেই সময়কার রাজা মাধব রাও সিন্ধিয়া বাহাদুরের ওপর আরোপ করেন। এই আদেশ অবশ্য মাধব রাওয়ের মতো অন্যান্য নেটিভ রাজ্যের শাসকদের জন্যেও ঘোষণা করা হয়েছিল।
রাষ্ট্রপতির এরকম আদেশের পরে ১৯৭০ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর মাধব রাও সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩২-এর অধীনে পাল্টা একটি পিটিশন দায়ের করেন সুপ্রিম কোর্টে এবং আপিল করেন প্রথমত, রাষ্ট্রপতির আদেশকে যেন অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হয়, দ্বিতীয়ত তাঁকে গোয়ালিয়রের শাসক হিসেবে মান্যতা দেওয়া হয় এবং তৃতীয়ত প্রিভি পার্স-সহ ব্যক্তিগত সুযোগ সুবিধাগুলি যেন অব্যাহত থাকে। মাধব রাও-সহ অন্যরাও দাবি করেন যে, রাষ্ট্রপতি আইনের কর্তৃত্ব ছাড়াই এ-আদেশ দিয়েছেন এবং এটির মাধ্যমে সংবিধানের ১৪, ১৯ এবং ৩১ ধারা লঙ্ঘিত হয়েছে। তাঁরা এও জানান যে, ভারত সরকার এবং দেশীয় রাজাদের মধ্যে চুক্তির মাধ্যমে, সংবিধান স্বীকৃত আইন অনুযায়ী এই প্রিভি পার্স এবং ব্যক্তিগত সুযোগ-সুবিধার ব্যপারগুলি স্থির হয়েছিল। সর্বোপরি একজন রাষ্ট্রপতিই একজন ব্যক্তিকে এই প্রিভি পার্স ভোগ করার অধিকারী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল। অতএব সেই অধিকারে আরেক রাষ্ট্রপতি পুনরায় হস্তক্ষেপ করতে পারেন না। এই প্রসঙ্গে বলা হয় যে, রাষ্ট্রপতির, কোনো নেটিভ শাসককে স্বীকৃতি দেওয়া বা স্বীকৃতি প্রত্যাহার করে নেওয়ার অধিকার সংবিধানের কোনো বিধানে উল্লিখিত নেই। বলা হয় যে, একীভূতকরণ চুক্তি এবং চুক্তির বিধানগুলিকে সম্মান প্রদর্শন ও বাস্তবায়িত করা খোদ ভারত সরকারের দায়িত্ব।
আবেদনকারীদের এই সমস্ত যুক্তির বিরোধিতা করে পাল্টা কিছু যুক্তি সাজিয়েছিলেন বিবাদী পক্ষ। ভারত সরকারের যুগ্ম সচিবের পাল্টা হলফনামায় জানানো হয়, সংবিধানের ৩৬৩ অনুচ্ছেদের বিধান অনুসারে এই আবেদনটি গ্রহণ করবার কোনো এক্তিয়ারই নেই আদালতের। বিরোধী পক্ষ প্রথমেই জানিয়ে দেন যে, ভারত সরকারের সঙ্গে নেটিভ শাসকদের চুক্তিটি আসলে একটি রাজনৈতিক চুক্তিমাত্র। ভারত সরকার নেটিভ রাজাদের যে সমস্ত সুযোগ সুবিধা প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল সেগুলি নিতান্তই রাজনৈতিক একটি কাজ, এর সঙ্গে আইনের কোনো সম্পর্ক নেই। এছাড়া তাঁরা আরও জানান যে, যেহেতু এটি একটি রাজনৈতিক চুক্তি সেই কারণে এতে কথিত অধিকারগুলি বহুবর্ষজীবী হতে পারে না এবং জনগণের স্বার্থে রাষ্ট্রীয় নীতি অনুসারে তা প্রত্যাখান করা যেতে পারে। এছাড়াও বলা হয় যে, একত্রীকরণ চুক্তি সম্পর্কিত সংবিধানের কোনো বিধানই এই ধরনের নেটিভ রাজাদের কোনো আইনি অধিকার প্রদান করে না। বিবাদী পক্ষের মতে, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার মধ্যে অবশ্যই স্বীকৃতি প্রদানের ক্ষমতা এবং স্বীকৃতি কেড়ে নেওয়ার ক্ষমতাও রয়েছে। তাঁরা বলেন, একটি চুক্তির ভিত্তিতে সংবিধান আবেদনকারীকে কোনো মৌলিক অধিকার প্রদান করতে পারে না। তাছাড়া আজ ভারতের প্রেক্ষাপটে গণতন্ত্র, সমতা এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের সাথে বেমানান হয়ে উঠেছে এইরকম শাসন ও প্রিভি পার্সের ধারণাগুলি।
এইরূপ দীর্ঘ সওয়াল জবাবের পর সুপ্রিম কোর্ট যে রায় দিয়েছিল তা অবশ্য গিয়েছিল মাধব রাওদের পক্ষেই। প্রাথমিকভাবে কোর্ট জানিয়েছিল যে, ৩৬৬(২২) ধারাটি আসলে ৩৬২ এবং ২৯১-এর অধীনে অতিরিক্ত সার্বভৌম অধিকারের ভিত্তিতে সংজ্ঞায়িত একটি বিধান। এই ধারাটি রাষ্ট্রপতিকে “নিয়ন্ত্রক” শ্রেণী বাতিল করার অনুমতি দেয়নি। যে ৩৬৩ ধারার প্রসঙ্গ তুলে আদালতের এক্তিয়ার নিয়ে প্রশ্ন করেছিল সরকার পক্ষের আইনজীবীরা, কোর্ট সেখানে জবাব দিয়েছিল যে, রাষ্ট্রপতি অনুচ্ছেদ ৩৬৬ (২২) দ্বারা তাঁকে দেওয়া কর্তৃত্ব অতিক্রম করেছেন অতএব, ৩৬৩ ধারাটি এক্ষেত্রে প্রযোজ্যই নয়। এছাড়াও বিবাদীরা যুক্তি দিয়েছিল যে, ২৯১ ধারাটিতে ব্যক্তিগত অধিকারের কথা বলা নেই, আসলে সেটি অর্থ উৎপাদনের উৎস ও পদ্ধতি সম্পর্কিত একটি বিধান, যদিও আদালত তাঁদের এই ব্যাখা খারিজ করে দিয়েছিল। আদালত এও জানিয়েছিল যে, প্রিভি পার্স সিস্টেমে অর্থ প্রদান না করা আসলে ৩১ অনুচ্ছেদে বর্ণিত সম্পত্তির অধিকারকে লঙ্ঘন করা।
এইসব যুক্তির ভিত্তিতেই আদালত ১৯৭০ সালের ৬ ডিসেম্বরে জারি করা আদেশটিকে বিধান লঙ্ঘনের জন্য অসাংবিধানিক বলে ঘোষণা করে।
পরবর্তীকালে ১৯৭১ সালে পুনরায় এই প্রস্তাব সংসদের সামনে পেশ করা হয়েছিল, এবং ২৬তম সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে ৩৬৩-এ ধারা নিয়ে এসে প্রিভি পার্সকে বাতিল করে দেওয়া হয়।