১৯৭৫ সালের জরুরি অবস্থাকে অনেকেই ভারতের গণতন্ত্রের সবথেকে অন্ধকারময় দিক বলে মনে করেন। রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য সেই সময় নাগরিকদের মৌলিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছিল, সরকার চলছিল সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছায় এবং খেয়ালে। ঠিক এই সময়েই ভারতে প্রকাশ্যে আসে এডিএম জব্বলপুর বনাম শিবকান্ত শুক্লা মামলা (ADM Jabalpur Vs. Shivkant Shukla Case)। এই মামলাতেই দেখা যায় একমাত্র বিচারপতি এইচ আর খান্নাই কেবল ভারতীয় নাগরিকের মৌলিক অধিকারের সুরক্ষার কথা সোচ্চারে জানিয়েছেন জরুরি অবস্থার সময়। কিন্তু আদালতের অন্যান্য বিচারপতিদের বক্তব্য ছিল জরুরি অবস্থা চলাকালীন কোনও প্রকার মৌলিক অধিকারকে প্রাধান্য দেওয়া হবে না। ফলে এই মামলায় বিচারপতির রায় ভারতীয় বিচার ব্যবস্থার ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ভারতের সুপ্রিম কোর্টের কাছেও এটি একটি যুগান্তকারী মামলা হিসেবে স্বীকার্য।
১৯৭৬ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্টে এডিএম জব্বলপুর বনাম শিবকান্ত শুক্লা মামলা শুরু হয়। ঐ বছরই ২৮ এপ্রিল এই বিখ্যাত মামলার চূড়ান্ত রায় ঘোষিত হয়। মামলার বিচারকদের মধ্যে ছিলেন এ এন রায়, হংস রাজ খান্না, এম হামিদুল্লাহ রাজ বেগ, ওয়াই ভি চন্দ্রচূড় এবং পি এন ভগবতী।
১৯৭৫ সালে আভ্যন্তরীণ গোলযোগের কারণে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর পরামর্শে রাষ্ট্রপতি ফখরুদ্দিন আলী ভারতীয় সংবিধানের ৩৫২ নং ধারার অধীনে সমগ্র দেশে জরুরি অবস্থা চালু করেন। এই সময় সংবিধানের ১৪, ২০ এবং ২২ নং ধারার অধীনে স্বীকৃত যে সমস্ত মৌলিক অধিকার ছিল, তা সব ৩৫৯ (১) নং ধারার অধীনে এই জরুরি অবস্থার সময় স্থগিত করা হয়। রাজনীতির ক্ষেত্রে বিপজ্জনক সন্দেহে এই সময় বহু রাজনৈতিক নেতাকে বিচার ছাড়াই গ্রেপ্তার করে আটক রাখা হয়। সরকারের এহেন স্বৈরতান্ত্রিক আচরণের বিরুদ্ধে সমস্ত দেশের বহু উচ্চ আদালতে অভিযোগপত্র জমা পড়ে যেগুলির বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অভিযোগকারীদের পক্ষেই রায় দেয় আদালত। এই সময়পর্বে ভারত সরকার সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয় আর এভাবেই শুরু হয় এডিএম জব্বলপুর বনাম শিবকান্ত শুক্লা মামলা। এই মামলাটি আবার হেবিয়াস কর্পাস (Habeas Corpus) মামলা হিসেবেও পরিচিতি হয়। মূলত লাতিন ভাষা থেকে এই শব্দবন্ধটি এসেছে যার অর্থ হল নিজের শরীর প্রদর্শন করো। উল্লিখিত আবেদনকারীরা আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে নির্দেশ দেয় যে গ্রেপ্তার হওয়া যে কোনও ব্যক্তিকে যেভাবেই হোক আদালতের সামনে হাজির করতে হবে এবং তাদের আটক করার কারণ ব্যাখ্যা করতে হবে।
নানারকম তর্কে-বিতর্কে জমে ওঠা এই ঐতিহাসিক মামলাটি সুপ্রিম কোর্টের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে রয়েছে। রাষ্ট্রের তরফ থেকে বলা হয়েছিল যে, জরুরি অবস্থার বিধানের মূল লক্ষ্য ছিল কার্যনির্বাহীদের হাতে বিশেষ ক্ষমতা ন্যস্ত করা যাতে, আইনশৃঙ্খলার উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রাখা যায়। যুক্তি হিসেবে রাষ্ট্র বলেছিল, সংবিধানের ৩৫৯ (১) ধারা অনুযায়ী জরুরি অবস্থা চলাকালীন কোনো ব্যক্তির আদালতে যাওয়ার অধিকারকে খর্ব করা হয়েছে, এবং আদালতকে তাঁরা মনে করিয়ে দিয়েছেন যে, সংবিধানের এই ধারার মূল উদ্দেশ্য দেশের সামরিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা যাতে সবকিছুর তুলনায় অগ্রাধিকার পায় তা নিশ্চিত করা। অতএব জরুরি অবস্থার সময়ে রাষ্ট্রবিরোধী এই মামলা করা যে সংবিধান অনুমোদিত নয়, সম্ভবত সেদিকেই ইঙ্গিত করার চেষ্টা ছিল উপরিউক্ত যুক্তিবিন্যাসের মাধ্যমে। এর প্রত্যুত্তরে বিপক্ষের অভিযোগকারীরা বলেছিলেন, ৩৫৯ (১) অনুচ্ছেদের ধারা ৩২ অনুযায়ী আদালতে যাওয়ার এই নিষেধাজ্ঞা থাকলেও ২২৬ ধারা অনুযায়ী সাধারণ আইন প্রয়োগের পাশাপাশি হাইকোর্টে ব্যক্তিগত স্বাধীনতার বিধিবদ্ধ অধিকারকে উপরিউক্ত নিষেধাজ্ঞার ধারাটি প্রভাবিত করতে পারে না। এছাড়াও আরও বলা হয় যে, রাষ্ট্রপতির আদেশ কেবল মৌলিক অধিকারের ক্ষেত্রে বৈধ হলেও তা সাধারণ আইন, প্রাকৃতিক আইনকে প্রভাবিত করতে পারে না। ২৫৬, ২৬৫ এবং ৩৬১ (৩) অনুচ্ছেদ থেকে প্রাপ্ত অ-মৌলিক অধিকারগুলি, প্রাকৃতিক বা চুক্তিভিত্তিক অধিকার বা ব্যক্তিগত স্বাধীনতার সংবিধিবদ্ধ অধিকারের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির আদেশ প্রযোজ্য নয়।
টানা দুমাস ধরে এমনই তর্ক-প্রতিতর্ক, যুক্তির চাপানউতোরের পর অবশেষে ১৯৭৬ সালের ২৮ এপ্রিল এই মামলার চুড়ান্ত রায় ঘোষণা করা হয়েছিল। পাঁচজন বিচারপতি সম্বলিত সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চ এই রায়দান করেছিল। মানুষের মৌলিক অধিকারের দাবিকে কলঙ্কলিপ্ত এবং খর্ব করে সাংবিধানিক বেঞ্চের সংখ্যাগরিষ্টের রায় ছিল মূলত রাষ্ট্রের পক্ষেই। আদালত এমআইসিএ-এর ১৬এ (৯) ধারার সাংবিধানিক বৈধতা বহাল রাখে। কেবলমাত্র বিচারপতি হংস রাজ খান্নাই মানবতা এবং মৌলিক অধিকারের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন একা। তাঁর মতে সংবিধানের ২১ অনুচ্ছেদে বর্ণিত জীবন ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অধিকার থেকে ব্যক্তিকে বঞ্চিত করার ক্ষমতা রাষ্ট্রের নেই। তিনি আরও বলেন যে, ৩৫৯ (১) ধারা একজন ব্যক্তির সংবিধিবদ্ধ অধিকার বাস্তবায়নের জন্য আদালতে যাওয়ার অধিকার কেড়ে নেয় না। এই ভিন্নমত প্রকাশের জন্য পরবর্তীতে বিচারপতি হিসেবে নিয়োগের ক্ষেত্রে হংস রাজ খান্নাকে উপেক্ষা করা হয়েছিল। কিন্তু সেই বেঞ্চের অন্তর্ভুক্ত পি এন ভগবতী-সহ এ এন রায়, এম হামদুল্লাহ রাজ বেগ, এবং ওয়াই ভি চন্দ্রচূড় ইন্দিরা সরকারের পক্ষাবলম্বন করেছিলেন। জরুরি সময়কালে ভগবতী খোলাখুলিভাবে ইন্দিরা গান্ধীর প্রশংসা করেছিলেন ,পরে জনতা পার্টির নেতৃত্বাধীন সরকার গঠিত হলে তাঁর সমালোচনা করেছিলেন এবং ১৯৮০ সালে সরকার গঠনের জন্য পুনরায় ইন্দিরা নির্বাচিত হলে তাঁকে আবার সমর্থন করেছিলেন ভগবতী। এইরকম অবস্থান পরিবর্তনের জন্য সমালোচিতও হয়েছিলেন পরবর্তীকালে। আবার এ এন রায়ের মধ্যেও ইন্দিরা সরকারের প্রতি একটি প্রশ্রয়মূলক মনোভাব ছিল, সুতরাং মামলার রায় স্বাভাবিকভাবেই পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে পড়ে এবং জরুরি অবস্থায় মৌলিক অধিকার প্রয়োগে নিষেধাজ্ঞার পক্ষে রায় দেন তাঁরা। সেই চারজন বিচারপতির রায়ের মূল বক্তব্য ছিল, জরুরি অবস্থার সময় সরকার যদি স্বেচ্ছাচারী বা বেআইনি কোনো পদক্ষেপ নেয় তবে তার কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায় না। কারণ এই পরিস্থিতিতে সরকার তার অস্বাভাবিক ক্ষমতা ব্যবহার করে জাতির জীবন রক্ষা করে। অতএব, স্বাধীনতা যেমন আইনের উপহার, তেমনি আইন দ্বারা তা হরণও করা যেতে পারে। এমনকি ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯১ ধারার অধীনে হেবিয়াস কর্পাসের জন্য আবেদন হাইকোর্টে একযোগে দায়ের করা যাবে না। এই মামলার রায়দান সুপ্রিম কোর্টের ইতিহাসে একটি কলঙ্কিত অধ্যায় হয়ে রয়েছে।
২০১৭ সালে গোপনীয়তার অধিকার সংক্রান্ত মামলায় সুপ্রিম কোর্ট উক্ত চার বিচারপতির রায় ত্রুটিযুক্ত ঘোষণা করে এডিএম জব্বলপুর বনাম শিবকান্ত শুক্লা মামলাটিকে বাতিল করে দিয়েছিল।