অপারেশন ব্লু স্টার

অপারেশন ব্লু স্টার

১৯৮৪ সালে স্বাধীন খালিস্তানের দাবিতে পাঞ্জাবে বিচ্ছিন্নতাবাদের আগুন জ্বলেছিল। ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পৃথক খালিস্তান তৈরির পরিকল্পনায় শিখ সম্প্রদায়কে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন জারনাইল সিং ভিন্দ্রানওয়ালে। আন্দোলন দমনের জন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর নির্দেশে পাঞ্জাবের স্বর্ণ মন্দিরে ভারতীয় সেনাবাহিনী ও পাঞ্জাবের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের যে সংঘর্ষ হয় তাই ‘অপারেশন ব্লু স্টার’ (Operation Blue Star) নামে খ্যাত।

খালিস্তান আন্দোলন শুরু হয় সত্তরের দশকে। প্রথমদিকে এই‌ আন্দোলন অহিংস ছিল। শিখদের দাবি ছিল, ভারত স্বাধীনতা লাভের সঙ্গে সঙ্গে হিন্দুরা হিন্দুস্তান পেল, মুসলিমরা ‌পাকিস্তান পেল, কিন্তু শিখদের জন্য কোন আলাদা রাষ্ট্র গঠন হলনা। তাই আলাদা শিখ রাষ্ট্র(খালিস্তান) গঠনের জন্য শিখরা আন্দোলন চালাতে থাকে। এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন জারনাইল সিং ভিন্দ্রানওয়ালে। তার নেতৃত্বে অমৃতসরের স্বর্ণ মন্দির চত্বরে চলতে থাকে অবাধ জঙ্গি তৎপরতা। এই মন্দির চত্বরে পুলিশের ঢোকা নিষিদ্ধ ছিল। তাই পাঞ্জাবের স্বর্ণ মন্দিরকে জঙ্গিরা তাদের নিরাপদ স্থান হিসেবে বেছে নেয়।

জারনাইল সিং ভিন্দ্রানওয়ালে শিখদের বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন যে, হিন্দু অধ্যুষিত ভারতে গোলামের মত বেঁচে থাকার কোন মানেই হয়না। শিখদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র গঠন করা দরকার। এই আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে শিখ সম্প্রদায়ের একটি অংশ তাকে সমর্থন করে। ক্রমশ পাঞ্জাবে হিংসাত্মক ঘটনা বাড়তে থাকে। সরকারি বিভিন্ন জায়গায় চলে খুন, লুটতরাজ। আক্রমণ চলে পুলিশের ওপর, ছিনিয়ে নেওয়া হয় সরকারি অর্থ। আতঙ্কিত হয়ে ওঠেন স্থানীয় বাসিন্দারা। পাঞ্জাবে আইন-শৃঙ্খলার দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকে। খালিস্তান সৃষ্টির জন্য পরিচালিত এই আন্দোলনকে বলা হয় ‘খালিস্তান মুভমেন্ট’। প্রথমদিকে জারনাইল সিংহের সঙ্গে কংগ্রেস দলের ভালো সম্পর্ক ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে খালিস্তান আন্দোলনের ফলে এই সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায়। ১৯৮২ সালে বিচ্ছিন্নতাকামী শিখরা গুরদ্বার ছেড়ে পাঞ্জাবের অমৃতসরের হরমন্দির সাহিব বা স্বর্ণমন্দিরের ‘অকাল তখত’ ভবনে ঘাঁটি গড়ে তোলে। ফলে স্বর্ণমন্দির এলাকায় তৎপর হয়ে ওঠে ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিহার রেজিমেন্ট।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

১ জুন বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে সেনাবাহিনীর আলোচনা ব্যর্থ হয়। তাদের এই অনমনীয় মনোভাবের জন্য ভারত সরকার ভারতের অখণ্ডতা বজায় রাখতে এবং পাঞ্জাবে পুনরায় শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে সেনাবাহিনী নামানোর সিদ্ধান্ত নেয়। সরকারের শীর্ষস্তর থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। শিখদের সবচেয়ে পবিত্র তীর্থস্থান স্বর্ণ মন্দিরে সেনা বাহিনীর অভিযান চালানো হবে। এই অপারেশনের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘অপারেশন ব্লু স্টার’। মূলত বিদ্রোহীদের স্বর্ণ মন্দির থেকে বহিষ্কার করাই ছিল এই অপারেশনের মূল লক্ষ্য। ১৯৮৪ সালের ৩ জুন পুরো মন্দির চত্বর প্যারামিলিটারি দিয়ে ঘিরে ফেলা হয় এবং বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আত্মসমর্পণ করতে আর মন্দির খালি করে দেওয়ার জন্য বলা হয়। কিন্তু সেনা বাহিনীর এই আবেদনে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা সাড়া দিলনা। সাংবাদিকদের সবাইকে আগেই পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল পাঞ্জাবের বাইরে। গোটা রাজ্যে কারফিউ জারি হল। রাস্তার মোড়ে মোড়ে আর্মি চেকপোস্ট বসানো হল যাতে বাইরে থেকে কোন অস্ত্র প্রবেশ করতে না পারে। পদাতিক সেনাবাহিনীর পাঁচটি ব্যাটেলিয়ান, দুই কোম্পানি কমান্ডো, ছয়টি ট্যাংক, দুই কোম্পানি প্যারামিলিটারি তৈরি রাখা হয়েছিল এই অপারেশনের জন্য।

এই অপারেশনের ইনচার্জ ছিলেন মেজর জেনারেল কুলদীপ সিং ব্রার। ১ জুন  থেকে ৮ জুন পর্যন্ত এই অভিযান চলেছিল। ৫ জুন সকালে অপারেশনে অংশ নেবে সেনাবাহিনীর যে সদস্যরা তাদের সবাইকে মেজর জেনারেল কুলদীপ সিং ব্রার নিজে ব্রিফ করেন। সেনা বাহিনীর প্রতি নির্দেশ ছিল যে, তারা একটি পবিত্র তীর্থ ঢুকছে তাই যত কম মৃত্যু হয় ততই মঙ্গল এবং মন্দিরের যেন কোন ক্ষতি না হয়।অপারেশন শুরু হয়েছিল রাত দশটায়। এই অপারেশনের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন জেনারেল সুন্দরজী, জেনারেল দয়াল আর জেনারেল ব্রার। দশটি গার্ড রেজিমেন্ট নিয়ে স্বর্ণ মন্দিরের উত্তরমুখী প্রবেশপথ দিয়ে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করতে মেশিনগানের মুহুর্মুহু গুলির সম্মুখীন হতে হয় ভারতীয় সেনাবাহিনীকে। এমনকি ম্যানহোলের ঢাকনা খুলে গুলি ছুড়ে আবার ম্যানহোলে লুকিয়ে পড়তে থাকে স্বর্ণমন্দিরে ঘাঁটি গড়ে তোলা শিখ সম্প্রদায়। ভারতীয় সেনাবাহিনীর দুর্নীতির অভিযোগে বহিস্কৃত এক অফিসার শাহবেগ সিং স্বর্ণ মন্দিরের অভ্যন্তরে প্রতিরোধ ব্যবস্থা তৈরি করতে জারনাইল সিংকে সাহায্য করে। ফলে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছিল। ইট ও বালির বস্তা দিয়ে এমনভাবে স্বর্ণমন্দির ঘেরা ছিল যে সিএস গ্যাসের ক্যানিস্টার ফাটানোর চেষ্টা ব্যর্থ হয়। সারারাত দুপক্ষেরই গুলিবর্ষণ হয়। এমনকি বিদ্রোহীরা রকেট লঞ্চার‌ও ব্যবহার করেছিল।

অবশেষে ৬ জুন ভোরবেলা ভারতীয় সেনাবাহিনী  ট্যাংক থেকে গোলাবর্ষণ শুরু করে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আগুন ধরে যায় অকাল তখত ভবনগুলোতে। বিস্ফোরণের শব্দে ঢাকা পড়ে যায় ভেতরের গোলাগুলির আওয়াজ, ভেঙে পড়ে ইটের গাঁথুনি। বেশ কিছুক্ষণ পরে ভেতর থেকে সমস্ত আওয়াজ থেমে যায়। যদিও বিদ্রোহীরা ভেতর থেকে গুলিবর্ষণ করলেও ভারতীয় সেনাবাহিনীর ওপর আদেশ ছিল স্বর্ণ মন্দিরের গায়ে যেন গুলি না লাগে এবং তারা সেই নির্দেশ যথাযথ পালন করার চেষ্টাও করেছে। কিন্তু যে ভবনগুলোতে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা আশ্রয় নিয়েছিল সেগুলি গোলার আঘাতে পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়। ৭ জুন সেনাবাহিনী অকাল তখতে প্রবেশ করে। অকাল-তখতের ভেতর থেকে উদ্ধার করা হয় ৪২টি মৃতদেহ। এর মধ্যে জারনাইল সিং এবং শাহবাগ‌ সিং – এর মৃতদেহও ছিল। ৮ জুন সৈন্যবাহিনী একটি টাওয়ারের বেসমেন্ট থেকে চারজন শিখকে গ্রেপ্তার করে। ১০ জুন বিকেলে এই অপারেশন শেষ হয়। এই অপারেশনে ৮৩ জন ভারতীয় সেনা নিহত হয়েছিল এবং ২৪৯ জন সেনাবাহিনীর সদস্য আহত হয়েছিল। বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মধ্যে মারা গিয়েছিল ৪৯২ জন এবং দেড় হাজারেরও বেশি লোক গ্রেপ্তার হয়েছিল। এই ঘটনায় শুধুমাত্র ভারত নয়, সারা বিশ্বের শিখ সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লেগেছিল।

এই ঘটনার ছ’মাস পরে ৩১ অক্টোবর ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে হত্যা করা হয়। অপারেশন ব্লু স্টারের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য নিজের দুই শিখ দেহরক্ষীর হাতে নিহত হন ইন্দিরা গান্ধী। ইন্দিরা গান্ধীর নিহত হওয়ার ফলে রাজধানী দিল্লিতে এবং দেশের অন্যান্য অংশে শিখ বিরোধী দাঙ্গা শুরু হয়ে যায়। এর ফলে বহু নিরীহ শিখ মারা যান। ২০১২ সালে অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল কুলদীপ সিং ব্রার লন্ডনে দুষ্কৃতীদের দ্বারা আক্রান্ত হন এবং আহত হন। এই ঘটনাটি অপারেশন ব্লু স্টারের প্রতিহিংসার ফল বলে মনে করা হয়। 

ভারতে বর্তমানে শিখরাও অন্যান্য সম্প্রদায়ের সঙ্গে মিলেমিশে বসবাস করছে। ভারতের সার্বভৌমত্ব ও শান্তি বজায় রয়েছে। এমনকি শিখ সম্প্রদায়ভুক্ত শ্রী মনমোহন সিং দশ বছর ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা বাদ দিলে  অপারেশন ব্লু স্টার বর্তমানে অতীতের ঘটনা হিসেবে ইতিহাসের পাতায় রয়ে গেছে।

3 comments

আপনার মতামত জানান