দক্ষিণ কলকাতার টলিগঞ্জকে যদি স্টুডিয়োপাড়া নাম দেওয়া যায় তাহলে উত্তর কলকাতার হাতিবাগান অঞ্চলকে থিয়েটারপাড়া বলাই যায়। এখানে এক কিলোমিটারের মধ্যেই একসময় রমরম করে চলত উত্তরা, শ্রী, রূপবানী, রাধা, পূর্ণশ্রী, দর্পনা, বিধুশ্রী, মিনার এবং অবশ্যই মিত্রা সিনেমা হল। এই কিছুদিন আগে পর্যন্তও এই এলাকাই নুন, ম্যাটিনি, ইভনিং বা নাইট শোয়ে ব্যস্ত থাকতো হলফেরত সিনেমাপ্রেমী দর্শকদের ভিড় সামলাতে। ৫০০ বছর প্রাচীন এই কলকাতা শহরের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, দৈনন্দিন পালাবদলের মধ্যেও নিজেদের বাঁচিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল এইসব সিঙ্গল স্ক্রিন প্রেক্ষাগৃহগুলি। কেউ একশো, কেউ সোয়াশো বছর ধরে, আগলে রেখে এসেছে চলচ্চিত্রের গৌরবোজ্জ্বল বহু অধ্যায়কে। মিত্রা সিনেমা (Mitra cinema) হল সেরকমই এক ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন সিনেমা হল।
১৯৩১ সালে যেদিন চিত্রা সিনেমার দরজা সাধারণ দর্শকের জন্য খুলে দেওয়া হয়, প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন স্বয়ং নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু। দেখানো হয়েছিল নিউ থিয়েটার্সের প্রথম দিকের টকি ছবি ‘দেনা পাওনা’। হলের তৎকালীন কর্ণধার শ্রী বীরেন্দ্র নাথ সরকারকে দুটি অনুরোধ করেছিলেন নেতাজি। প্রথম, সেদিনের অনুষ্ঠানের জন্য ব্রিটিশ পুলিশের সাহায্য না নিতে, আর দ্বিতীয়, ভবিষ্যতে শুধুমাত্র বাংলা ছবি দেখানোতেই মনোনিবেশ করতে। নেতাজি হয়ত সেদিনই বুঝেছিলেন শহরের এই সিনেমাহলগুলির পৃষ্ঠপোষকতা না পেলে হারিয়ে যেতে পারে বাংলার মতো আঞ্চলিক ভাষায় তৈরি ছবি। অনেক সমস্যা সামলেও এই দুটি পরামর্শ দীর্ঘদিন মেনে চলেছেন চিত্রা সিনেমার মালিকপক্ষ। শুধুমাত্র বাংলা ছবিই দেখানো হয়েছে এই প্রেক্ষাগৃহে যতদিন তাঁরা পেরেছেন।
অবশেষে ১৯৬৩ সালে এই ৯৫০ আসন সমৃদ্ধ হলের মালিকানা হস্তান্তরিত হয় শ্রী হেমন্ত কৃষ্ণ মিত্রের কাছে। চিত্রা হলের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘মিত্রা’। সিনেমার স্বর্ণযুগে শুধুমাত্র বাংলা ছবি নয় হিন্দি এবং পরবর্তীকালে ইংরেজি ছবিও নিয়মিত ফুটে উঠতে থাকে মিত্রার পর্দায়। ১৯৬৩ সালে ‘দেয়া নেয়া’ থেকে শুরু করে ‘গাইড’, ‘জুগনু’, ‘ফুল ঔর পত্থর’, ‘হাথি মেরা সাথি’, ‘হম কিসিসে কম নহি’ থেকে এই সেদিনকার ‘দিলওয়ালে দুলহনিয়া লে জায়েঙ্গে’ অবধি প্রচুর বানিজ্যিকভাবে সফল ছবি দেখানোর পাশাপাশি, প্রতি রবিবার মর্নিং শোতে ফিল্ম সোসাইটির চলচ্চিত্রপ্রেমী দর্শকেরা মিত্রা সিনেমায় ভিড় জমাতেন কিছু দুর্লভ বিদেশী ছবি দেখার লোভে। ১৯৭৮ সালে দেশ জুড়ে আরও অনেক হলের সাথে ধর্মেন্দ্র অভিনীত ‘শালিমার’ ছবিটি যেদিন মুক্তি পায় মিত্রাতে, তার তিন দিন আগে থেকে টিকিট কাউন্টারের সামনে বিশাল লাইন পড়েছিল। অমিতাভ বচ্চন অভিনীত ‘বদলা’ ছবিটিরও একাধিক শো হাউসফুল হয়েছিল এই হলে। বেশ কয়েক আগে ব্যবসায় সাফল্য এনে দিয়েছিল হলিউডের ‘টাইটানিক’ ছবিটি। কিন্তু শুধু দুএকটি ছবির আকাশছোঁয়া সাফল্য দিয়ে সিনেমাহল টিকিয়ে রাখা যে সম্ভব নয় তা হাড়েহাড়ে টের পাচ্ছিলেন মিত্রার মতো এই শহরের আরও শতাধিক হল। ইম্পার (Indian Motion Picture Producers’ Association, IMPPA) তরফ থেকে সরকারের কাছে বারবার কর মকুব করার অনুরোধ করা হলেও বিশেষ ফল হয়নি তাতে।
এই অসম যুদ্ধতে ক্রমাগত হারতে থাকা কলকাতার হল মালিকেরা কেউ সরকারের অসহযোগিতাকে দায়ী করছেন, কেউ আবার বলছেন ভিডিও পাইরেসির কথা, টেলিভিশনের বা স্যাটেলাইট চ্যানেলের কথা। মিত্রা সিনেমার বর্তমান কর্ণধার শ্রী দীপেন্দ্রকৃষ্ণ মিত্রের মতে এই আকালের জন্য মালটিপ্লেক্সকেও দোষী করা উচিত হবেনা। ২০০৩ সালে প্রথম যখন আইনক্স মাল্টিপ্লেক্সের আবির্ভাব হয়, তার পরেও বেশ কিছু বছর ভাল ব্যবসা করতে পেরেছে সিংগল স্ক্রিন প্রেক্ষাগৃহগুলি। তাঁর মতে এই শিল্প হেরে যাচ্ছে ভাল বিষয়ের, ভাল ছবির অভাবে। চলচ্চিত্রের শুরুর দিকে হয়ত মাল্টিপ্লেক্সের চোখ রাঙ্গানি ছিলোনা, কিন্তু অসাধারণ সব ছবি ছিল যার জন্য উন্মুখ হয়ে অপেক্ষা করতেন বাঙ্গালী দর্শককুল। একবার যদি আমরা বাংলা ছবির বা ভারতীয় ছবির ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখি তাহলে তাঁর বক্তব্যের যৌক্তিকতা বুঝে নিতে অসুবিধা হবেনা। দীপেন্দ্রকৃষ্ণ মিত্র এমন একটা সময়ের সাক্ষী যখন একটি ছবি মুক্তি পাওয়ার আগেও জনমানসে এমন সারা ফেলতো যে রিলিজের তিনদিন আগে থেকেই লাইন পরত টিকিট কাউন্টারের সামনে। হতে পারে তার কারণ ছবিতে দর্শকের প্রিয় শিল্পীর উপস্থিতি, বা প্রিয় নির্দেশকের ভাল কাজ দেখার হাতছানি কিন্তু একটা পর্যায়ের পরে এইসব ছবির দীর্ঘস্থায়ী সাফল্যের মূল কারণ কিন্তু ছবির বিষয়। আজকের মতো শপিং মলে বাজার করতে গিয়ে যেকোনো একটা সিনেমা দেখে আসা নয়, চলচ্চিত্রপ্রেমী দর্শক যারা এত যুগ ধরে বাঁচিয়ে রেখে এসেছেন এই শিল্পকে তাঁরা কিন্তু ভাল ছবি দেখার জন্য কাঠের চেয়ারে, এসি বিহীন হলে বারেবারে ফিরে গেছেন।
গতবছর প্রায় ২০ লক্ষ টাকা খরচ হলের পরিষেবা উন্নত করার একটা শেষ প্রচেষ্টা নিয়েছিলেন দীপেন্দ্রকৃষ্ণ। ১৯৮৬ সাল থেকে এই হলের দায়িত্ত্ব পাওয়ার পরে এত সহজে হার মানতে চাইছিলেন না তিনি। বসানো হয় অত্যাধুনিক ৭.১ সাউন্ড সিস্টেম, বদলানো হয় রুপোলী পর্দা, পুরনো বসার জায়গা পাল্টে অত্যাধুনিক বসার ব্যবস্থাও তৈরি করা হয় যেখানে পা ছড়িয়ে বসার পর্যাপ্ত জায়গা আছে, প্রেক্ষাগৃহের দেওয়ালেও পড়ে নতুন রঙের পোঁচ। কিন্তু ততদিনে এসে গেছে ওটিটি প্লাটফর্মের নিত্যনতুন চ্যালেঞ্জ।
মিত্রা সিনেমা বন্ধ হওয়ার আগের দিন ‘কেশরী’ ছবির শেষ শোতে ১০০টি টিকিটও বিক্রি না হওয়ায় হলের সবকটি এসিও চালানোর উপায় ছিলোনা। অসুস্থ দীপেন্দ্রকৃষ্ণ হার মেনে নিলেন। অবশিষ্ট কর্মীদের প্রাপ্য মিটিয়ে ছুটি দিয়ে দিলেন। পরদিন সকালেই পথচলতি মানুষের দেখতে পেলেন মিত্রা সিনেমা হলের গেটে টাঙ্গানো কর্তৃপক্ষের সিলমোহর দেওয়া বিজ্ঞপ্তি, “অনির্দিষ্টকালের জন্য মিত্রা সিনেমার পরিষেবা বন্ধ রাখা হল”।
এখন দীপেন্দ্রকৃষ্ণের দিনের অনেকটা সময় কাটে নানান ধরনের ফোন ধরতে। বাঙালি, অবাঙ্গালি লগ্নিকারিরা জানতে চান মিত্রা সিনেমার এই ১৮ কাঠা জমি তিনি বিক্রি করবেন কিনা।