ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু (Subhas Chandra Bose) হলেন এক উজ্জ্বল ও মহান চরিত্র যিনি নিজের সমগ্র জীবন উৎসর্গ করেছিলেন দেশকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করার জন্য। তিনি কেবল একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন না, তিনি একাধারে রাজনীতিবিদ ও সেনানায়কও ছিলেন।
ভারতের ওড়িশা রাজ্যের কটক শহরে ১৮৯৭ সালের ২৩শে জানুয়ারি নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর জন্ম হয়। তাঁর বাবার নাম জানকীনাথ বসু ও মায়ের নাম প্রভাবতী দেবী। বাবা ও মায়ের চৌদ্দ সন্তানের মধ্যে নেতাজি ছিলেন নবম সন্তান।
১৯০২ সালে প্রটেস্ট্যান্ট ইউরোপীয় বিদ্যালয়ে তাঁর প্রাথমিক পড়াশোনা শুরু হয়। বর্তমানে এই স্কুলটি স্টুয়ার্ট উচ্চবিদ্যালয় নামে পরিচিত। এরপর ১৯০৯ সালে তিনি রাভেন’শ কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন। ১৯১৩ সালে তিনি ম্যাট্টিকুলেশন পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেন ও প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। এই সময়টায় তিনি স্বামী বিবেকানন্দ ও রামকৃষ্ণ’র বাণী দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হন ও জাতীয়তাবাদী কার্যকলাপের সাথে যুক্ত হয়ে পড়েন। প্রেসিডেন্সি কলেজের এক ইংরেজ প্রফেসরের ভারত বিদ্বেষী মন্তব্যে ক্ষুব্ধ হয়ে সুভাষ তাঁর উপর আক্রমণ করেছিলেন। প্রেসিডেন্সি কলেজে তিনি খুব অল্প সময়ের জন্য পড়াশোনা করেন। এরপর তিনি স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে দর্শনশাস্ত্র বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯১৯ সালে বাবার ইচ্ছায় সুভাষ ইংল্যান্ড রওনা হন ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস (ICS) পরীক্ষা দেবার জন্য। সেখানে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজউইলিয়াম হলে উচ্চ শিক্ষার জন্য ভর্তি হন। সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় তিনি চতুর্থ স্থান লাভ করেন এবং চাকরির নিয়োগ পত্র পেয়েও কেবল ব্রিটিশদের দাসত্ব করবেন না বলে তিনি তা ত্যাগ করে ১৯২১ সালে ভারতে ফিরে আসেন।
ভারতে ফিরে তিনি তৎকালীন পরিস্থিতি নিয়ে ‘স্বরাজ’ নামক পত্রিকায় লেখালিখি শুরু করেন এবং এর মধ্যে দিয়েই তাঁর রাজনৈতিক জীবনে অনুপ্রবেশ ঘটে। ১৯২৪ সালে চিত্তরঞ্জন দাশ কলকাতা পৌরসভার মেয়র থাকাকালীন সুভাষ তাঁর অধীনে কাজ শুরু করেন। কংগ্রেসের সক্রিয় সদস্য চিত্তরঞ্জন দাশকেই সুভাষের রাজনৈতিক গুরু মনে করা হয় যিনি সেই সময়কার বাংলার জাতীয়তাবাদের মুখপাত্র ছিলেন। ১৯২৫ সালে সুভাষকে অন্যান্য আন্দোলনকারীদের সাথে গ্রেফতার করে মান্দালয় জেলে পাঠানো হয়। ১৯২৭ সালে কারাগার থেকে মুক্ত হলে সুভাষকে কংগ্রেস দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচন করা হয় এবং তিনি জওহরলাল নেহরুর সাথে কাজ করতে শুরু করেন। ১৯৩০ সালে সুভাষ ইউরোপ যাত্রা করেন। ইউরোপে থাকাকালীন সময়ে তিনি তাঁর অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে “ইন্ডিয়ান স্ট্রাগল” নামে একটি বই রচনা করেন যেটি ১৯৩৫ সালে লন্ডনে প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত হলেও এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীন দেশগুলিতে এই বইয়ের প্রভাবে অশান্তির ভয়ে বইটি নিষিদ্ধ করে ব্রিটিশ সরকার।
১৯৩৮ সালে সুভাষ প্রথমবার জাতীয় কগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন। এরপর ১৯৩৯ সালে সুভাষ দ্বিতীয়বার জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হলে মহাত্মা গান্ধী তাঁর বিরোধিতা করেন এবং ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের দলটি বিভক্ত হয়ে যায়। সুভাষ কংগ্রেস থেকে পদত্যাগ করে ‘অল ইন্ডিয়া ফরওয়ার্ড ব্লক’ গঠন করেন। এর মধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যায় এবং ভারতীয় সৈন্যরা ব্রিটিশদের সাথে যুদ্ধে যোগ দিলে সুভাষ হতাশ হয়ে পড়েন। ব্রিটিশ পুলিশ এই সময় সুভাষকে ঘরবন্দি করে রাখলে তিনি গোপনে দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি ছদ্মবেশে আফগানিস্তান ও সোভিয়েত ইউনিয়ন হয়ে জার্মানি পালিয়ে যান এবং সেখানে গিয়ে হিটলারের কাছে ভারতের স্বাধীনতার জন্য সাহায্য প্রার্থনা করেন। হিটলারের কাছ থেকে কোন সাহায্য না পেয়ে তিনি জার্মানি থেকে গোপন পথে ১৯৪৩ সালে জাপানে এসে পৌঁছান। জাপানিদের সহযোগিতায় রাসবিহারী বসুর নেতৃত্বে জাপানে ভারতীয় জাতীয় সেনাবাহিনী (ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি) গড়ে উঠেছিল যার দায়িত্ব রাসবিহারী বসু নেতাজির হাতে তুলে দেন। নারীপুরুষ নির্বিশেষে এই দলের সৈন্য সংখ্যা ছিল প্রায় ৮৫,০০০ এর মত। ‘ভারতীয় জাতীয় সেনাবাহিনী’ নাম বদলে এই বাহিনীর নাম রাখা হয় আজাদ হিন্দ ফৌজ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে জাপান আত্মসমর্পণ করলে নেতাজির আজাদ হিন্দ বাহিনীও দুর্বল হয়ে পড়ে।
১৯৪৫ সালের ১৮ই আগস্ট সুভাষ তাইহোকু বিমানবন্দর থেকে বিমানে জাপান ত্যাগ করার পর এই বিমানটি দুর্ঘটনায় পরে এবং দুর্ঘটনায় সুভাষের মৃত্যু হয় বলে মনে করা হয় যদিও সুভাষের প্রকৃত মৃত্যুর কারণ আজও জানা যায়নি বা সরকার কর্তৃক জনসমক্ষে প্রকাশিত হয়নি।
9 comments