চিত্তরঞ্জন দাশ (Chittaranjan Das) প্রখ্যাত আইনজীবি তথা ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের জনপ্রিয় একজন নেতা ও স্বরাজ পার্টির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। কলকাতা পুরসভার প্রথম মেয়র (১৯২৩) ছিলেন চিত্তরঞ্জন। ওকালতি পেশার মধ্যে দিয়ে ও পেশার আড়ালে স্বদেশী আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিলেন তিনি। তিনি প্রত্যক্ষ ও সক্রিয় রাজনীতি করাকালীন বারবার প্রকাশিত হয়েছে তাঁর দেশাত্মবোধ, মানবদরদী, সমাজসংস্কারক মনোভাব। এত কর্মব্যস্ত জীবনে তিনি খুঁজে নিয়েছিলেন সাহিত্যচর্চার অবসরও। নানা পত্রপত্রিকায় প্রবন্ধ-নিবন্ধের পাশাপাশি কবিতাও লিখেছেন তিনি। উদার মনোভাব, হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে মানুষের প্রতি তাঁর দরদী মনোভাব দেখে দেশের মানুষ তাঁকে দেশবন্ধু উপাধি দেয়।
১৮৭০ সালের ৫ই নভেম্বর ব্রিটিশ শাসিত ভারতের রাজধানী কলকাতা শহরে চিত্তরঞ্জন দাশের জন্ম হয়। তবে তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল ঢাকার তেলিরবাগ অঞ্চলে। ব্রাহ্মসমাজের বিখ্যাত সদস্য দুর্গামোহন দাশের ভ্রাতা শ্রী ভুবনমোহন দাশ ও শ্রীমতি নিস্তারিণী দেবীর আট সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয় ছিলেন চিত্তরঞ্জন। তাঁর বাবা পেশাগত জীবনে কলকাতা হাইকোর্টের উকিল হলেও ব্রাহ্মসমাজের জার্নাল ‘ব্রাহ্ম জনমত’ (The Brahmo Public Opinion) এর সম্পাদনার কাজে যুক্ত ছিলেন। তাঁর উদার মনোভাব, সামাজিক কর্তব্যবোধ ও রাজনৈতিক সচেতনতার আদর্শ শৈশব থেকেই উদ্বুদ্ধ করেছিল চিত্তরঞ্জনকে ।উচ্চ শিক্ষিতা না হলেও মায়ের মনের ব্যাপ্তি,সারল্য ও নীতিপরায়ণতা গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল তাঁকে। দাশ পরিবারের তাঁর সমসাময়িক রত্ন ছিলেন দুর্গামোহনের কৃতী সন্তানেরা – সরলা দেবী, অবলা দেবী (অবলা বসু), সত্যরঞ্জন দাশ, সতীশরঞ্জন দাশ, সুধীরঞ্জন দাশ । চিত্তরঞ্জন বিজনী রাজকোর্টের বরদাপ্রসাদ হাওলাদারের কন্যা বাসন্তী দেবীকে বিয়ে করেন। বাসন্তীদেবীও ছিলেন প্রত্যক্ষ রাজনীতি ও স্বদেশী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত একজন সমাজসংস্কারক। তাঁর চরিত্রের নমনীয়তা,দৃঢ়তা ও স্নেহপরায়ণতার জন্য স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কাছে তিনি ছিলেন মাতৃসমা।স্বয়ং সুভাষচন্দ্র বসু তাঁকে মা-এর মতো মানতেন। চিররঞ্জন দাশ, অপর্ণা দেবী ও কল্যাণী দেবী ছিলেন তাঁদের তিন সন্তান। অপর্ণা দেবীর পুত্র ছিলেন স্বাধীন পশ্চিমবাংলার প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ ও মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশংকর রায়।
পরিবারে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পূর্ণ হবার আগেই ১৮৭৯ সালে চিত্তরঞ্জনের প্রথাগত শিক্ষাজীবনের সূচনা হয় ভবানীপুরের লন্ডন মিশনারী বিদ্যালয়ে। তবে পাঠ্য বইয়ের থেকে অন্যান্য নানা বিষয়ে পড়াশোনা করতে ভালোবাসতেন। ফলে নম্বরের দিক থেকে অসাধারণ ছাত্র ছিলেন না কোনদিন। ১৮৮৬ সালে ম্যাট্রিক পাশ করে প্রেসিডেন্সী কলেজে ভর্তি হন এবং ১৮৯০ সালে সেখান থেকে বি.এ. পাশ করেন। এরপর পারিবারিক ধারা বজায় রেখে ব্যারিস্টরি পড়তে বিলেত যান। ১৮৯৩ সালে লন্ডনের ইম্যান্যুয়েল কলেজ থেকে আইন পাশ করে দেশে ফিরে আসেন।
শৈশবে বিপিনচন্দ্র পালের সান্নিধ্যে দেশপ্রেমের যে চারা রোপিত হয়েছিল চিত্তরঞ্জনের মনে তার গভীরতা পেয়েছিল প্রেসিডেন্সী কলেজে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আদর্শে রাজনীতি করতে গিয়ে। এই চারাই বিলেতে অরবিন্দ ঘোষ, সরোজিনী নাইডু, অতুলপ্রসাদ সেনদের সখ্যতায় মহীরুহ হয়ে ওঠে। বিদেশে দাদাভাই নওরোজির হয়ে নির্বাচনী প্রচারে অংশগ্রহণ তারই ফলশ্রুতি। দেশে ফিরে আর্থিক অসচ্ছলতার মধ্যে দিয়ে শুরু করেন ওকালতি প্র্যাকটিস। আইনজীবী হিসাবে দেশবন্ধুর প্রথম বড় সাফল্য মেলে ‘কুতুবদিয়া রাজবন্দী মামলা’য় । অন্তরীণ অবস্থায় পালিয়ে চট্টগ্রাম যাওয়ার অভিযোগ ছিল ১৭ জন অভিযুক্তের বিরুদ্ধে। চিত্তরঞ্জন দাশ তাঁদের জন্য বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করেন এবং তাঁর ওকালতির দক্ষতায় বন্দীদের মাত্র দুই মাসের সাজা হয়।
এদিকে তাঁর বাবা ভুবনমোহনও উদার চরিত্র ও নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য ঋণে জর্জরিত হয়ে পড়েন। ১৮৯৬ সালে পিতাপুত্রকে আদালত দেউলিয়া ঘোষণা করলে হার না মেনে চিত্তরঞ্জন সিভিল কোর্টের বদলে ক্রিমিনাল কোর্টে প্র্যাকটিস শুরু করেন। মফস্বলে, গ্রামে মামলা লড়তেন অন্যান্য উকিলের থেকে কম টাকায়। কখনো বা হতদরিদ্র মক্কেলের ক্ষেত্রে বিনামূল্যে। এসময় তাঁর বাবাও ঋণে ডুবে যান। এই কঠিন দুরাবস্থার সময় তাঁর বাবা কলকাতা কর্পোরেশনের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু নির্বাচনে জিততে পারেননি। পরোপকার ও উদারতার কারণে তাঁর এই ঋণ বাড়তেই থাকে।
কিন্তু এই কর্মকাণ্ডের মাঝেও প্রমথ মিত্রের ‘অনুশীলন সমিতির’ গোপন বিপ্লবের থেকে বিরত হননি। অরবিন্দ ঘোষের ‘বন্দে মাতরম’ এর কাজকেও সমান গুরুত্ব দিয়ে এসেছেন। এইসময় আরো সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে থাকেন রাজনৈতিক ক্ষেত্রে। ১৯০৬ সালে কলকাতা কংগ্রেসের প্রতিনিধি হন। ১৯০৮ সালে অরবিন্দ ঘোষকে আলিপুর বোমা মামলায় দেশদ্রোহীতার অভিযোগ থেকে মুক্ত করেন। ১৯১০ সালে ঢাকা ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত ৩৩জন বিপ্লবীর মধ্যে কিছু জনের শাস্তি লাঘব করতে সক্ষম হন তিনি। রাজনৈতিক ও ব্রিটিশ সরকারের জুলুমের বিরুদ্ধে মামলা লড়া মূল উদ্দেশ্য হলেও জমিদারদের হয়ে বা গরীব মানুষের হয়ে মামলা লড়া বন্ধ করেননি তিনি।
আইন পেশার পাশাপাশি তিনি গোপনে বিপ্লবী রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন। ১৯০৩ সালে কলকাতায় প্রমথ মিত্র ও চিত্তরঞ্জন দাশ প্রথমে ‘অনুশীলন সমিতি’ প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠাকাল থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত তিনি এই সমিতির সহ-সভাপতি ছিলেন। অরবিন্দ ঘোষের ‘বন্দে মাতরম’ পত্রিকার সঙ্গেও তাঁর সম্পৃক্ততা ছিল।
১৮৯৭-১৯০৪ সাল পর্যন্ত চিত্তরঞ্জন দাশকে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। তবে পারিবারিক অবস্থান তাঁর পেশা জীবনের উন্নয়নে কিছুটা ভূমিকা রাখে। কারণ তাঁর পিতামহ ছিলেন সরকারী আইনজীবী। দুই কাকা ছিলেন নামকরা আইনজীবী। এছাড়া তাঁর পরিবারের তিনজন ছিলেন জজ। সুধীররঞ্জন দাশ ছিলেন তাঁদের পরিবারের একজন, যিনি পরবর্তীতে ভারতের প্রধান বিচারপতি হয়েছিলেন।
১৯১০ সালে চিত্তরঞ্জন দাশ ঢাকা ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত পুলিন বিহারী দাশ এবং সঙ্গীদের শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড থেকে কমিয়ে ছয় মাসে কমিয়ে আনেন। ১৯১৭ সালে কংগ্রেসের বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন চিত্তরঞ্জন। ১৯১৮ সালে কলকাতা উন্নয়ন ট্রাস্ট বিষয়ক মামলায় আদালতের স্পেশাল বেঞ্চের গঠন ও অবস্থান বিষয়ে প্রশ্ন তোলার জন্য তৎকালীন দৈনিক সংবাদ পত্র অমৃতবাজার পত্রিকার বিরুদ্ধে উচ্চ আদালত অবমাননার অভিযোগ আনা হয়। চিত্তরঞ্জন পত্রিকার হয়ে লড়েন ও জয়লাভ করেন। ১৯২০ সালে উচ্চ আদালতে বিপুল আয়ের প্র্যাকটিস ছেড়ে দিয়ে মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলনে যোগদান করেন তিনি। এর ফলে ১৯২১ সালে সস্ত্রীক চিত্তরঞ্জন কারারূদ্ধ হন। এই ত্যাগের জন্য জনগণ তাঁকে দেশবন্ধু নামে ভূষিত করে। ১৯২১ সালে আইসিএস ত্যাগ করে কলকাতায় দেশবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে এসে মুগ্ধ হন সুভাষচন্দ্র ।
১৯২১ -২২ গান্ধীজীর অসহযোগ আন্দোলন, বিলিতি পণ্য বর্জন আন্দোলনে বাংলার অদ্বিতীয় নেতা ছিলেন তিনি। গান্ধীজী এই আন্দোলন প্রত্যাহার করে নিলে তিনি কংগ্রেস ত্যাগ করে স্বরাজ দল প্রতিষ্ঠা করেন। স্বাধীনতার স্বার্থে বাংলার সমস্ত হিন্দু মুসলমান ঐক্যবদ্ধ হবার আহ্বান জানান। ধর্মনিরপেক্ষ ভাবে ক্ষমতার সমবন্টনের লক্ষ্যে সাক্ষরিত হয় এক ঐতিহাসিক চুক্তি – যার নাম বেঙ্গল প্যাক্ট। ১৯২৩ সালের আইন সভার নির্বাচনে অভাবনীয় সাফল্য পায় স্বরাজ দল। দেশবন্ধু সদ্য গঠিত কলকাতার পুরসভা প্রথম মেয়র হন। এরপর ১৯২৪ ও ২৫ সালে পরপর দুবার তিনি মেয়র পদে নির্বাচিত হন।
চিত্তরঞ্জন প্রতিষ্ঠিত ও সম্পাদিত পত্রিকা ‘নারায়ণ’ এবং লিখিত গ্রন্থ মালঞ্চ, সাগর সঙ্গীত ও অন্তর্যামী আজও তাঁর সাহিত্য প্রীতির সাক্ষ্য দেয় । তাঁর রচিত ডালিম নামক গল্প ১৯২৪ সালে মিনার্ভা থিয়েটারে নাটকরূপে অভিনীত হয়।
অতিরিক্ত কাজের চাপে ভেঙে পড়েছিল শরীর। তবু আজীবনের নীতি ও কর্তব্যপরায়ণতা, দেশ-সমাজসেবা, ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ থেকে সরে আসেননি মানবপ্রেমী এই মানুষটি। নিজের বাসভবনে ও সংলগ্ন জমি দান করে গিয়েছিলেন দেশের নারীদের কল্যাণসাধনার উদ্দেশ্যে। পরবর্তী সময়ে সেখানে গড়ে ওঠে চিত্তরঞ্জন সেবা সদন –আজ যে প্রতিষ্ঠানকে আমরা চিত্তরঞ্জন ক্যান্সার হসপিটাল নামে চিনি। ১৯২৬-এর ফেব্রুয়ারি মাসে মান্দালয় জেলে নেতাজি নিজে দেশবন্ধুর উপর একটি দীর্ঘ মূল্যবান প্রবন্ধে লিখেছিলেন: ‘‘ভারতের হিন্দু জননায়কদের মধ্যে দেশবন্ধুর মতো ইসলামের এত বড় বন্ধু আর কেউ ছিলেন বলে মনে হয় না। তিনি হিন্দুধর্মকে এত ভালবাসতেন যে তার জন্য প্রাণ দিতেও প্রস্তুত ছিলেন অথচ তাঁর মনের মধ্যে গোঁড়ামি আদৌ ছিল না।’’ চিত্তরঞ্জনের পথ ধরেই ভারতবর্ষের ধর্মীয় বিভিন্নতার বিষয়ে এই উদার মহানুভবতার আদর্শকে সুভাষচন্দ্র তাঁর নিজের রাজনীতিতে প্রতিফলিত করতে চেয়েছিলেন। নেতাজি শ্রদ্ধাভরে লিখলেন: ‘‘চিত্তরঞ্জনের জাতীয়তাবাদ পূর্ণতা লাভ করত আন্তর্জাতিক সংযোগের মধ্যে। কিন্তু সেই বিশ্বপ্রেমের জন্য নিজের দেশের প্রতি প্রেম তিনি বিসর্জন দেননি। আবার তার সঙ্গে এও ঠিক যে এই স্বজাতিপ্রেম তাঁর মধ্যে কোনও সঙ্কীর্ণ আত্মকেন্দ্রিকতাও তৈরি করেনি।’’ দেশবন্ধুর এই অপূর্ণ স্বপ্ন এবং আশার মধ্যেই তাঁর ‘‘সর্ববৃহৎ উত্তরাধিকার’’ খুঁজে পেয়েছিলেন নেতাজি
চিত্তরঞ্জন দাশের ১৯২৫ সালের ১৬ জুন দার্জিলিংয়ে মৃত্যু হয়। মৃত্যুর আগে তিনি তাঁর পৈতৃক বসতবাড়িটি জনসাধারণের জন্য দান করে যান। সেখানে ‘চিত্তরঞ্জন সেবাসদন’ প্রতিষ্ঠিত হয়। তাঁর প্রয়াণে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ / মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান।। ”
তথ্যসূত্র
- সুবোধ সেনগুপ্ত ও অঞ্জলি বসু সম্পাদিত, সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, মে ১৯৬০, পৃষ্ঠা-১৫৩-৫৪
- https://archive.org/
- https://en.wikipedia.org/
- https://www.britannica.com/
- https://www.indiatoday.in/
- https://www.anandabazar.com/
4 comments