দাদাভাই নওরোজি

দাদাভাই নওরোজি

 ‘গ্র্যান্ড ওল্ড ম্যান অফ ইণ্ডিয়া’ নামে খ্যাত প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ দাদাভাই নওরোজি (Dadabhai Naoroji) ছিলেন প্রথম ভারতীয় যিনি ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। বাইবেল ছুঁয়ে নয়, পারসিক ধর্মগ্রন্থ জেন্দ্‌-আবেস্তা ছুঁয়ে পার্লামেন্টে শপথ গ্রহণ করেছিলেন তিনি। ভারতের দারিদ্র্যমোচনের লক্ষ্যে ব্রিটেনে প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে পা রাখা এবং ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে প্রভূত অবদানের জন্য তিনি স্মরণীয়। ‘আনঅফিসিয়াল অ্যাম্বাসাডার অফ ইণ্ডিয়া’ বলেও তাঁকে সম্বোধন করা হতো। ১৮৬৭ সালে ইস্ট ইণ্ডিয়া অ্যাসোসিয়েশন তৈরি করে ভারতীয় চিন্তা-চেতনা, দাবি-দাওয়াকে ব্রিটিশ জনগণের সামনে তুলে ধরেছিলেন দাদাভাই নওরোজি আর মনে করা হয় এই সংগঠনই ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের আদিরূপ। ‘পভার্টি অ্যাণ্ড আন-ব্রিটিশ রুল ইন ইণ্ডিয়া’ বইয়ের মধ্য দিয়ে তিনিই প্রথম দেখান কীভাবে ব্রিটিশদের অবাধ লুণ্ঠনে ভারতের শিল্প ও অর্থনীতির অবনমন ঘটেছে।

১৮২৫ সালের ৪ সেপ্টেম্বর বোম্বে প্রেসিডেন্সির নভসারীর একটি দরিদ্র গুজরাটিভাষী পার্সি পরিবারে দাদাভাই নওরোজির জন্ম হয়। মাত্র চার বছর বয়সে তাঁর বাবার মৃত্যু হলে মায়ের কাছেই বড় হয়ে ওঠেন নওরোজি।

দাদাভাই নওরোজির প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় এলফিনস্টোন ইনস্টিটিউট স্কুলে। তিনি পড়াশোনায় খুবই ভালো ছিলেন। বরোদার মহারাজা তৃতীয় সায়াজিরাও গায়কোয়াড় তাঁর পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। ১৮৭৪ সালে দাদাভাই নওরোজি সেই মহারাজের দেওয়ান হিসেবে কাজ করতে শুরু করেছিলেন।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

১৮৫১ সালের ১ আগস্ট ‘রাহনুমাই মাজদায়াসান সভা’ প্রতিষ্ঠা করেন দাদাভাই নওরোজি যার মূল উদ্দেশ্য ছিল জরথ্রুস্টীয় ধর্মের বিকাশ ঘটানো। ১৮৫৪ সালে তিনি ‘রাস্ত গোফ্‌তার’ নামে একটি গুজরাটি পাক্ষিক পত্রিকা প্রকাশ করতে শুরু করেন। গুজরাটি ভাষায় ‘রাস্ত গোফ্‌তার’ শব্দের অর্থ হল সত্যভাষণ করা। এই পত্রিকাটির মূল উদ্দেশ্য ছিল জরথ্রুস্টীয় ধর্ম বিষয়ক বিভিন্ন লেখা প্রকাশ করা এবং পার্সিদের সামাজিক বিকাশ ঘটানো। সেই সময় তিনি আরো একটি সংবাদপত্র প্রকাশ করতেন যার নাম ছিল ‘দ্য ভয়েস অফ ইণ্ডিয়া’। ১৮৫৫ সালে বোম্বের এলফিনস্টোন কলেজে গণিত এবং  প্রাকৃতিক দর্শনের অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হন দাদাভাই নওরোজি।

তিনি ছিলেন প্রথম ভারতীয় যিনি কলেজে অধ্যাপনার বৃত্তি গ্রহণ করেন। এরপর তিনি সেই বছরই লন্ডনে যান এবং ‘কামা অ্যাণ্ড কোং’ কোম্পানির অংশীদার হন। এই ‘কামা অ্যাণ্ড কোং’ ছিল ব্রিটেনে প্রতিষ্ঠিত প্রথম ভারতীয় কোম্পানি। কিন্তু তিন বছরের বেশি এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না দাদাভাই নওরোজি। ১৮৫৯ সালে তিনি তাঁর নিজস্ব তুলো লেনদেনের ব্যবসা শুরু করেন ‘দাদাভাই নওরোজি অ্যাণ্ড কোং’ কোম্পানির মাধ্যমে। এরপর তিনি লন্ডনের ইউনিভার্সিটি কলেজে গুজরাটি ভাষার অধ্যাপক হিসাবে যোগদান করেন।

১৮৬১ সালে দাদাভাই নওরোজি প্রতিষ্ঠা করেন ‘দ্য জরস্ত্রীয়ান ট্রাস্ট ফাণ্ডস অফ ইউরোপ’ এবং ১৮৬৫ সালে তিনি স্থাপন করেন ‘লণ্ডন ইণ্ডিয়ান সোসাইটি’। এই ‘লণ্ডন ইণ্ডিয়ান সোসাইটি’র মূল উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয় রাজনীতি, সমাজনীতি এবং সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করা। ১৮৬৭ সালে তিনি ‘ইস্ট ইণ্ডিয়া অ্যাসোসিয়েশন’ তৈরি করতে সাহায্য করেন যা আসলে ‘ইণ্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস’-এর আদিরূপ। এই সংস্থার মূল উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয় ভাবনাচিন্তাকে ব্রিটিশ জনগণের সামনে তুলে ধরা। ইউরোপীয়রা অনেকক্ষেত্রেই এশীয়দের হেনস্থা করতো, সেই সব হেনস্থার প্রতিবাদ করাই ঐ সংস্থার অন্যতম কাজ ছিল। খুব দ্রুত সেই সংস্থাটি গুরুত্বপূর্ণ ব্রিটিশ নাগরিকদের সমর্থন লাভ করে এবং তার প্রভাব এতটাই সুদূরপ্রসারী ছিল যে অনেকসময় ব্রিটিশ পার্লামেন্টও ‘ইস্ট ইণ্ডিয়া অ্যাসোসিয়েশন’ দ্বারা প্রভাবিত হতো। ১৮৭৪ সালে তিনি বরোদার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন দাদাভাই নওরোজি। এর পাশাপাশি তিনি ১৮৮৫ সাল থেকে ১৮৮৮ সাল পর্যন্ত ‘লেজিসলেটিভ কাউন্সিল অফ বোম্বে’র একজন সদস্য ছিলেন। কলকাতায় স্যার সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিষ্ঠিত ‘ইণ্ডিয়ান ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন’-এর একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন দাদাভাই নওরোজি। ১৮৮৫তে বোম্বেতে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস তৈরি হলে তিনি যোগদান করেন। একসময় ইণ্ডিয়ান ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন এবং ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এই দুটি দল একত্রিভূত হয় এবং ১৮৮৬ সালে সেই দলের সভাপতি নির্বাচিত হন দাদাভাই নওরোজি। এরপরে তিনি আবার ব্রিটেনে ফিরে যান এবং সেখান থেকে তাঁর রাজনৈতিক কাজকর্ম চালাতে থাকেন।

১৮৯৩ সালের সাধারণ নির্বাচনে তিনি ব্রিটেনের লিবারেল পার্টির সদস্য নির্বাচিত হন। তিনিই প্রথম ভারতীয় যিনি ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্য হয়েছিলেন। পার্লামেন্টের সদস্য হিসেবে তাঁর শপথ গ্রহণের সময় তিনি বাইবেল ছুঁয়ে শপথ করতে অস্বীকার করেন এবং পার্সি হওয়ার দরুণ তাঁর ধর্মগ্রন্থ ‘জেন্দ-আবেস্তা’ ছুঁয়ে শপথ গ্রহণ করেন দাদাভাই নওরোজি। সেই সময় তিনি ভারতীয়দের অবস্থা উন্নততর করে তোলার জন্যে অনেক পদক্ষেপ নেন। একজন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ হিসেবে তিনি ব্রিটিশ শাসনের বহু ভ্রান্তি পার্লামেন্টের সামনে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছিলেন। সেখানে তিনি ‘আইরিশ হোম রুল’ (Irish Home Rule) নিয়ে কথা বলেন। সেই সময় মহম্মদ আলী জিন্নাহ তাঁকে খুবই সাহায্য করতেন। ১৯০১ সালে দাদাভাই নওরোজির লেখা বিখ্যাত ‘পভার্টি অ্যাণ্ড আন-ব্রিটিশ রুল ইন ইণ্ডিয়া’ বইটি প্রকাশিত হয়। ১৯০৬ সালে তিনি দ্বিতীয়বারের জন্য ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নরমপন্থী নেতাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন তিনি। পরবর্তীকালে নরমপন্থী এবং চরমপন্থী নেতাদের মধ্যে বিরোধ তৈরি হওয়ায় কংগ্রেস দুটি ভাগে ভাগ হয়ে যায়। কিন্তু উভয় দলের সদস্যই সমানভাবে শ্রদ্ধা করতেন দাদাভাই নওরোজিকে। কংগ্রেসের বহু নেতার পরামর্শদাতা ছিলেন তিনি যাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন বাল গঙ্গাধর তিলক, গোপালকৃষ্ণ গোখলে এবং মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। ব্রিটিশ শাসনের ফলে ভারত থেকে বহু ধনরত্ন সেসময় অবাধে ব্রিটেনে চলে যাচ্ছিল।  দাদাভাই নওরোজি এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানান। এর জন্য ‘ড্রেন থিওরি’ তৈরি করেন তিনি। এই থিওরির দ্বারা তিনি ভারতের ‘নেট ন্যাশনাল প্রফিট’ তথা মোট জাতীয় আয় অনুমান করতে এবং ভারতের উপর ঔপনিবেশিক শাসনের প্রভাব বুঝতে সক্ষম হতেন এবং এই তত্ত্বের মাধ্যমে দাদাভাই নওরোজি প্রমাণ করেন যে, ঔপনিবেশিক শাসনের ফলে ব্রিটিশরা ভারত থেকে প্রচুর অর্থ লুট করে নিজের দেশে নিয়ে যাচ্ছে। তিনি ছয়টি দিক দেখান যার ফলে ভারতের প্রচুর অর্থ দেশের বাইরে চলে যাচ্ছিল, তার মধ্যে দেশের ঔপনিবেশিক শাসন, ভারতে বাইরে থেকে তেমন কোনো শ্রমিক বা মূলধন না আসা যার ফলে অর্থনীতির বিকাশ ঘটতে পারে, রাজনৈতিক কাজকর্ম এবং সৈন্যদল রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকারের দ্বারা প্রচুর অর্থ ব্যয়, ব্রিটিশ সাংগঠনিক কাজকর্মের জন্য অর্থব্যয়, মুক্তবাণিজ্যের ফলে যোগ্য ভারতীয়দের থেকে বিদেশিদের কর্মসংস্থান বেশি হওয়া এবং সেই বিদেশি কর্মকর্তারা ভারতের বাইরে তাদের উপার্জিত অর্থ ব্যয় করতো যার ফলে ভারতের অর্থনীতি কোনোভাবেই লাভবান হতো না। এই দিকগুলি নিয়েই তিনি তাঁর বই ‘পভার্টি অ্যাণ্ড আন-ব্রিটিশ রুল ইন ইণ্ডিয়া’তে আলোচনা করেছেন। অনেকক্ষেত্রে ব্রিটিশ শাসনের সমালোচনা করলেও তিনি ব্রিটিশ শাসনের কিছু ভালো প্রভাবও চিহ্নিত করেন, তার মধ্যে অন্যতম হল ভারতে রেলপথ তৈরি হওয়া যা বিভিন্ন প্রদেশের মানুষের যোগাযোগের ক্ষেত্র হিসেবে কাজ করতো। কিন্তু সেখান থেকে যা আয় হতো সবই ব্রিটেনে চলে যেতো। এছাড়া অন্যান্য ব্রিটিশরা ভারতে যত বেশি না কাজ করতেন, তার থেকে অনেক বেশি আয় করতেন। কিন্তু সেই একই কাজ ভারতীয়রা করেও তেমন সম্মানজনক বেতন পেতেন না। এছাড়াও ভারতীয় সামগ্রীর বাজারদরের থেকে বিদেশি সামগ্রীর দর অনেক বেশি ছিল। এর ফলে ভারতের অর্থনীতি দিনের পর দিন মুখ থুবড়ে পড়ছিল এবং ভারতীয়দের দারিদ্র্য ক্রমেই বেড়ে চলছিল। তিনি যখন পার্লামেন্টের সদস্য ছিলেন তখন তিনি এই অতি-দারিদ্র্য এবং সম্পদ লুণ্ঠনের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলেন। তবে এতকিছুর পরেও দাদাভাই নওরোজি কখনোই ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে রাজি ছিলেন না।

মুম্বাইতে তাঁর নামে নামাঙ্কিত একটি রাস্তা আছে। এছাড়াও পাকিস্তানের করাচিতে এবং লন্ডনের ফিন্সবেরিতে দাদাভাই নওরোজির নামে নামাঙ্কিত রাস্তা রয়েছে। পরবর্তীকালে ভারতের রাজধানী দিল্লিতে একটি জায়গার নাম নওরোজিনগর দেওয়া হয়। তাঁকে ‘গ্র্যাণ্ড ওল্ড ম্যান অফ ইণ্ডিয়া’ এবং ‘আন-অফিসিয়াল অ্যাম্বাসাডার অফ ইণ্ডিয়া’ উপাধিতে ভূষিত করা হয় দাদাভাই নওরোজিকে।

১৯১৭ সালের ৩০ জুন বোম্বেতে ৯১ বছর বয়সে দাদাভাই নওরোজির মৃত্যু হয়।

4 comments

আপনার মতামত জানান