স্বাধীন ভারতের প্রথম পুরুষ অলিম্পিয়ান ছিলেন হেনরি রেবেলো (Henry Rebello)। দক্ষ ট্রিপল জাম্পার হিসেবে মাত্র সতেরো বছর বয়সে ১৯৪৮ সালের লন্ডন অলিম্পিকে রেবেলো ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। ১৯৪৮ সালের অলিম্পিকে যোগদান করেও তিনি পদক জিততে পারেননি পায়ে চোট পাওয়ার কারণে। নিয়তির অমোঘ পরিণতিতে তাঁর দক্ষতার যোগ্য স্বীকৃতি পাননি। পরবর্তীকালে ভারতীয় বায়ুসেনায় যোগদান করে গ্রুপ ক্যাপ্টেন হিসেবে অবসর নেন তিনি।
১৯২৮ সালের ১৭ নভেম্বর ভারতের ব্যাঙ্গালোরে হেনরি রেবেলোর জন্ম হয়। ছোটোবেলায় খেলাধূলার প্রতি বিশেষ আকর্ষণ ছিল না হেনরির। কিন্তু পড়াশোনায় অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন তিনি।
প্রথমে লক্ষ্ণৌতে প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় হেনরি রেবেলোর। পরে তাঁর পরিবার লক্ষ্ণৌ থেকে ব্যাঙ্গালোরে চলে এলে সেখানে বাল্ডউইন বয়েজ হাই স্কুলে ভর্তি হন রেবেলো। এই স্কুল থেকেই খেলাধূলা, অ্যাথলেটিক্সের প্রতি মনোযোগী হন তিনি। কারণ এই স্কুলে স্পোর্টস ছিল বাধ্যতামূলক, প্রতিটি ছাত্রকে ক্রীড়াচর্চা করতেই হতো। বিকেলের খেলার ক্লাসে রেবেলো প্রায়শই দেরি করে ফেলতেন। সেসময় স্কুলের অধ্যক্ষ তাঁর বাবাকে ডেকে বলেছিলেন যে স্কুলের নিয়ম যদি রেবেলো না মানতে পারে তাহলে তাঁর স্কুলে না থাকলেও চলবে। তারপর থেকেই নিয়মিত ক্রীড়াচর্চায় মনোনিবেশ করেন হেনরি রেবেলো আর তার ফলেই ভবিষ্যতে তাঁর উজ্জ্বল অ্যাথলিট হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। পরে উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি ভর্তি হয়েছিলেন সেন্ট জোসেফ কলেজে।
মাত্র ষোলো বছর বয়সেই অ্যাথলেটিক্স শুরু করেছিলেন হেনরি রেবেলো যদিও তা একেবারেই স্কুল-পর্যায়ে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু রেবেলোর দক্ষতার কারণে তাঁর স্কুলের সঙ্গে ‘বিশপ কটন’ নামের পার্শ্ববর্তী আরেকটি স্কুলের ক্রীড়া-প্রতিদ্বন্দ্বিতা চরমে ওঠে, এই দুটি স্কুল তখন একে অপরের প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছিল। একের পর এক লং জাম্প, হাই জাম্প প্রতিযোগিতায় জিতছিলেন রেবেলো। তখন যদিও এই প্রতিযোগিতাকে ‘হপ, স্টেপ অ্যাণ্ড জাম্প’ বলা হতো। কোনো প্রকার প্রথাগত প্রশিক্ষণ বা প্রশিক্ষকের সাহায্য ছাড়াই রেবেলো লং জাম্প, হাই জাম্প, ট্রিপল জাম্পে পরপর রেকর্ড করতে থাকেন। আমেরিকান ‘ফ্লিকার বুক’ পড়ে রেবেলো এই সব কৌশল আয়ত্ত করে ফেলেছিলেন যা বাস্তবে চিন্তা করাও দুঃসাধ্য। সেই বইতে বিশ্বের সেরা অ্যাথলিটদের ক্রীড়া চলাকালীন বিভিন্ন পদক্ষেপের ছবি থাকতো যা তাঁকে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল।
১৯৪৬ সালে মাত্র ১৮ বছর বয়সে ‘সর্বভারতীয় অলিম্পিক মিট’-এ প্রথম স্বর্ণপদক লাভ করেন হেনরি রেবেলো। শুরু হয় তাঁর সাফল্যের উড়ান। ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে লক্ষ্ণৌতে আয়োজিত সর্বভারতীয় মিট-এ ট্রিপল জাম্পে ৫০ ফুট ২ ইঞ্চি উচ্চতার জাতীয় রেকর্ড গড়েন তিনি যা অলিম্পিকে যোগদানের জন্য তাঁকে আরেক ধাপ এগিয়ে দেয়। কিন্তু রেবেলোর নিজের সমীক্ষা অনুযায়ী সেদিন যদি বৃষ্টির কারণে মাটি ভিজে ও নরম না হয়ে যেত তাহলে তিনি নিশ্চিতভাবে ৫১ ফুট উচ্চতায় লাফাতে পারতেন। দীর্ঘ দুই দশক ধরে রেবেলোর এই উচ্চতার রেকর্ড কেউ ভাঙতে পারেনি। ফলে লণ্ডন অলিম্পিকে তাঁর যোগদানের প্রবল ইচ্ছে বাস্তবায়িত হল। সেই বছরের জন্য এই উচ্চতার রেকর্ডটি ছিল সারা বিশ্বের মধ্যে সর্বোচ্চ। এই রেকর্ডককে কেউ অতিক্রম করতে না পারলেও কাছাকাছি উচ্চতায় পৌঁছেছিলেন ব্রাজিলের অ্যাথলিট অ্যাঢেমার ফেরেইরা ডা সিলভা। কিন্ত শুধুই একজন ট্রিপল জাম্পার ছিলেন না হেনরি রেবেলো। লং জাম্পের ক্ষেত্রেও ২৩ ফুট উচ্চতার রেকর্ড গড়ে তিনি বিশ্ববাসীকে চমকিত করেছিলেন। এমনকি একশো মিটার দৌড়ের ক্ষেত্রেও রেবেলোর মাত্র ১০.৯ সেকেণ্ডের রেকর্ড সেসময় কেউ ভাঙতে পারেনি। এছাড়াও হাই জাম্পেও অংশগ্রহণ করেছিলেন রেবেলো এবং ৬ ফুট উচ্চতায় লাফ দিয়ে রেকর্ড তৈরি করেন তিনি। সেন্ট জোসেফ কলেজে পড়াকালীন অ্যাথলেটিক্সই তাঁর ধ্যান-জ্ঞান হয়ে ওঠে। ভোর থেকে মধ্য রাত পর্যন্ত তিনি প্রশিক্ষনে নিয়োজিত থাকতেন। লণ্ডন অলিম্পিকে তাঁর রেকর্ড অনেক বিশ্বখ্যাত ক্রীড়াবিদের কাছে তাঁকে পরিচিত করে তোলে। তৎকালীন ক্রীড়া-ভাষ্যকার হ্যারল্ড অ্যাব্রামস তাঁকে সম্ভাবনাময় স্বর্ণপদকজয়ী হিসেবে বিশ্বের কাছে পরিচিত করে তুলেছিলেন। স্বর্ণপদকজয়ী অ্যাব্রামস মনে করেছিলেন রেবেলোকে লণ্ডন অলিম্পিকে পরাজিত করা দুঃসাধ্য হবে।
অলিম্পিকের পনেরো দিন আগে লণ্ডনের মোটসপুর পার্ক মিট-এ বিশ্বের সেরা অ্যাথলিটদের একটা সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন হেনরি রেবেলো। সেই নির্বাচনী প্রতিযোগিতায় প্রথমেই রেবেলো ৫২ ফুট ১.৫ ইঞ্চি উচ্চতায় লাফান যা বিশ্ব রেকর্ডকারী জাপানের অ্যাথলিট নাওতো তাজিমার থেকে সাড়ে চার ইঞ্চি কম ছিল। কিন্তু সেই লাফ বাতিল হয়ে যায় কারণ রেবেলো ০.৫ ইঞ্চির জন্য সীমারেখা অতিক্রম করে ফেলেছিলেন। এরপরের জাম্পে ৫০ ফুট উচ্চতায় লাফ দিয়ে অস্ট্রেলিয়ার জর্জ অ্যাভারিকে দুই ফুটের ব্যবধানে পরাজিত করে প্রথম স্থান দখল করেন তিনি। কিন্তু ৩ আগস্টের প্রতিযোগিতাটাই ছিল সবথেকে দুরূহ এবং সেইটিই ছিল রেবেলোর ভাগ্য-নিয়ন্ত্রক। সেইদিন রেবেলো তুর্কির অ্যাথলিট রুহি সারিয়াল্পের সঙ্গে জাম্পের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করছিলেন আর তখনই কর্মকর্তারা তাঁকে থামিয়ে তাঁর জাম্পের প্রদর্শনী স্থগিত করার কথা বলেন কারণ একটি বিজয়োৎসব অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল সেই সময়। কিছুক্ষণ পরে তাঁকে ডাকা হয় প্রথম জাম্পের জন্য। প্রশিক্ষকেরা আরেকটু বেশি সময় চেয়েছিলেন ওয়ার্ম-আপের জন্য, কিন্তু সেই সময় ছাড়াই ভালোমতো ওয়ার্ম-আপ না করেই রেবেলোকে নির্বাচিত করা হয় জাম্পের জন্য যার ফল হয়েছিল হতাশাব্যঞ্জক। হাওয়ায় নিজের দেহটা ছুঁড়ে দেওয়ার বদলে ভারসাম্য হারিয়ে জাম্পের সময় মাটিতে পড়ে যান হেনরি রেবেলো, তীব্র আঘাত পান তিনি। ভারতীয় অ্যাথলেটিক্সের ইতিহাসে ঘটে গেল অপ্রত্যাশিত এক বিয়োগান্তক ইতিহাস। অলিম্পিকের মূল খেলায় যোগদানের আগেই এই তীব্র আঘাতের কারণে ১৯৪৮ সালের লণ্ডন অলিম্পিকে তাঁর স্বর্ণপদক জয়ের সব সম্ভাবনা হারিয়ে যায়। পরে সুস্থ হয়ে রেবেলো সংবাদমাধ্যমে জানিয়েছিলেন লাফ মারা সময় তাঁর বাঁদিকের হ্যামস্ট্রিংয়ে প্রচণ্ড আঘাতের কারণেই তিনি মাটিতে পড়ে গিয়েছিলেন ভারসাম্যের অভাবে।
ভারতে ফিরে ভারতীয় বায়ুসেনায় যোগ দেন হেনরি রেবেলো এবং ১৯৮০ সালে গ্রুপ ক্যাপ্টেন হিসেবে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। ১৯৮৪ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত হেনরি রেবেলো ভারতের ক্রীড়া দপ্তরের প্রথম অধিকর্তা হিসেবে কাজ করেছেন।
২০১৩ সালের ২৭ আগস্ট গুরগাঁওতে ৮৪ বছর বয়সে হেনরি রেবেলোর মৃত্যু হয়।