রাসবিহারী বসু

রাসবিহারী বসু

আজাদ হিন্দ ফৌজের কথা এলেই আমাদের মনে পড়ে সেনাধ্যক্ষ নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোসের নাম। কিন্তু কত জনের মনে পড়ে মহান বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর কথা ? আজাদ হিন্দ বাহিনীর স্রষ্টা এবং ভারতীয় বিপ্লবীদের ইতিহাসে এক বিশিষ্ট  চরিত্র ছিলেন রাসবিহারী বসু।

ভারতে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের একজন বিপ্লবী নেতা এবং ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির সংগঠক ছিলেন রাসবিহারী বসু। ১৮৮৬ সালের ২৫শে মে পূর্ব বর্ধমান জেলার সুবলদহ গ্রামে রাসবিহারী জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন বিনোদবিহারী বসু, তাঁর মায়ের নাম ভুবনেশ্বরী দেবী। তিনকড়ি দাসী ছিলেন তাঁর ধাত্রী মাতা।

রাসবিহারী বসুর নামটি দিয়েছিলেন তাঁর দাদু কালীচরণ বসু ।  রাসবিহারী বসুর মাতা যখন গর্ভবতী ছিলেন তখন তাঁর কঠিন অসুখ হয়েছিল। সুবলদহ গ্রামের পশ্চিম পাড়াতে অবস্থিত বিষ্ণুমন্দির বা কৃষ্ণ মন্দিরে মানত করা হয়েছিল যাতে সুস্থভাবে সন্তানের জন্ম দেন। তাই পরবর্তীকালে তাঁর দাদু নাতির নাম রেখেছিলেন কৃষ্ণের অপর নাম রাসবিহারী নামে। ১৮৮৯ সালে মাত্র তিন বছর বয়েসে তিনি তাঁর মাকে হারান।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

রাসবিহারী বসুর প্রাথমিক পড়াশুনা  সুবলদহের গ্রাম্য পাঠশালায় তাঁর দাদুর সাহচর্যে সম্পন্ন হয়েছিল।  রাসবিহারী বসু শৈশবে লাঠিখেলা শিখেছিলেন সুবলদহ গ্রামের শুরিপুকুর ডাঙ্গায়। শোনা যায় খেলার ছলে ছেলেবেলা থেকেই তিনি ইংরেজদের মূর্তি ভেঙে দিতেন। সুবলদহ গ্রামে তাঁর দাদু কালিচরণ বসু এবং তাঁর শিক্ষকদের কাছ থেকে বিভিন্ন জাতীয়তাবাদী গল্প তাঁকে বিপ্লবী আন্দোলনের অনুপ্রেরণা দিয়েছিল৷ পাঠশালার পর্ব মিটলে তিনি ভর্তি হন মর্টন স্কুলে, সেখান থেকে পাশ করে ডুপ্লে কলেজে তাঁর পড়াশুনা চলে। কলেজ জীবনের শুরু থেকেই তিনি নানা বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন৷

১৯০৮ সালে আলীপুর বোমা বিস্ফোরণ মামলায় তিনি অভিযুক্ত হন। কারাগার থেকে মুক্তিলাভের পর তিনি দেরাদুনে যান এবং সেখানে বন গবেষণা ইনস্টিটিউটে হেডক্লার্ক হিসেবে কাজ শুরু করেন।  সেখানেই তিনি গোপনে বাংলা, উত্তর প্রদেশ ও পাঞ্জাবের বিপ্লবীদের সংস্পর্শে আসেন এবং তাঁর বিপ্লবী কাজকর্ম শুরু করেন৷ তাঁর অন্যতম কৃতিত্ব হল বড়লাট হার্ডিঞ্জের ওপর প্রাণঘাতী হামলা। ভারতজোড়া সশস্ত্র সেনা ও গণ অভ্যুত্থানের বিরাট প্রচেষ্টা নিয়েছিলেন রাসবিহারী৷ অথচ বিশ্বাসঘাতকতার জন্যে সেই কর্মকান্ড ফাঁস হয়ে যায়। বহু বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তিনি যুক্ত থাকায় ব্রিটিশ  সরকারের সন্দেহের উদ্রেক হয় এবং শেষ পর্যন্ত তিনি দেশত্যাগে বাধ্য হন। ১৯১৫ সালের ১২ই মে কলকাতার খিদিরপুর বন্দর থেকে জাপানি জাহাজ ‘সানুকি-মারু’ সহযোগে তিনি ছদ্মপরিচয়ে ভারতবর্ষ ত্যাগ করেন।

রাসবিহারী বসু জাপানি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করায় তারা ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের পাশে দাঁড়ানোর প্রতিশ্রুতি দেন এবং শেষ পর্যন্ত জাপান ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয় সমর্থন যোগায়। জাপানে রাসবিহারী আরও একটি কারণে আজও বিখ্যাত হয়ে আছে তা হল তাঁর রান্না মাংসের ঝোলের জন্য, সেই বিষয়ে আরো বিস্তারিত পড়তে এখানে দেখুন

১৯৪২ সালের ২৮ মার্চ – ২৯ মার্চ জাপানের টোকিওতে তাঁর আহ্বানে  অনুষ্ঠিত একটি সম্মেলনে ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লীগ বা ভারতীয় স্বাধীনতা লীগ গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ওই বছরই ২২ জুন ব্যাংককে তিনি লীগের দ্বিতীয় সম্মেলন আহ্বান করেন। সেই সম্মেলনে সুভাষচন্দ্র বসুকে লীগে যোগদান ও এর সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণের আমন্ত্রণ জানানোর প্রস্তাব গৃহীত হয়।

রাসবিহারী বসু ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি গঠন করেন পররর্তী সময়ে যা নেতাজী সুভাসচন্দ্র বসু আজাদ হিন্দ বাহিনী নামে পরিচালনা করেন। জাপানে ১৯৪৫ সালের ২১ জানুয়ারি রাসবিহারী বসুর মৃত্যু হয় । মৃত্যুর পূর্বে রাসবিহারী বসুকে জাপান সরকার সম্মানসূচক ‘সেকেন্ড অর্ডার অব দি মেরিট অব দি রাইজিং সান’ খেতাবে ভূষিত করেন।

অকুতোভয়, বর্ণময় জীবনের ধারক রাসবিহারী বসু ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম পথিকৃৎ ছিলেন তা সত্ত্বেও ভারতের ইতিহাসে তিনি বিস্মৃত হয়ে পড়েছেন৷

4 comments

আপনার মতামত জানান