রাসবিহারী বসু মাংস রান্না

বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর মাংসের ঝোল রান্না

আমরা সকলেই জানি যে রাসবিহারী বসু তাঁর বৈপ্লবিক কর্মকান্ডের জন্য বিখ্যাত ছিলেন। তিনি ছিলেন ছদ্মবেশ নিতে পটু। এমনই ছদ্মবেশ, যে বহুবার ব্রিটিশ সরকারের পুলিশের নাকের ডগা দিয়ে পালিয়ে গেলেও, ব্রিটিশ সরকারের দুঁদে পুলিশ ও গোয়েন্দারা তাঁকে ছুঁতে পারেনি। তাঁকে আমরা চিনি তাঁর সংগঠন তৈরি করার ক্ষমতার জন্য। কিন্তু এই দিকগুলো ছাড়াও, তাঁর এমন একটি দিক ছিল যেটি তাঁকে জাপানে আত্মগোপন করে থাকার সময় ভীষণ ভাবে জনপ্রিয় করে তুলেছিল। জাপানের বিখ্যাত বেকারি, “নাকামুরা” বেকারির নামে তাঁর পরিচিতি হয়ে গিয়েছিল “নাকামুরার বোস” নামে। কারণ তিনি একজন দক্ষ রাঁধুনিও ছিলেন। রাসবিহারী বসুর মাংসের ঝোল জাপানে আজও বিখ্যাত।

১৯১২ সালের ২৩ ডিসেম্বর। ভারতের ভাইসরয়, যাকে বড়লাট বলেই সাধারণ মানুষ সম্বোধন করতেন, লর্ড হার্ডিঞ্জ আর লেডি হার্ডিঞ্জ হাওদায় চেপে বেড়াতে গিয়েছিলেন দিল্লির চাঁদনি চক এলাকায়। সঙ্গে বহু লোক লস্কর। হঠাৎই প্রচন্ড আওয়াজ। বড়লাটের হাওদায় এসে পড়ল একটি বোমা। বিস্ফোরণে বড়লাটের কাঁধ, পিঠ, পা থেকে রক্ত বেরচ্ছে। মাথায় ঢুকে গেছে বোমার স্প্লিন্টার। মাহুত সেখানেই মারা যান, তবে লেডি হার্ডিঞ্জ অক্ষত ছিলেন। ঘটনার আকস্মিকতা কাটিয়ে উঠে পুলিশ শুরু করল কারা চালালো বড়লাটের ওপরে এই হামলা। হামলার মূল নায়ক হিসাবে নাম উঠে এল এক বাঙালী বিপ্লবীর – রাসবিহারী বসু। গ্রেপ্তার হলেন বেশ কয়েকজন, কিন্তু রাসবিহারীকে খুঁজে পেল না পুলিশ। গা ঢাকা দিয়ে ভারতেই ছিলেন তিনি, আর তলে তলে আরও অনেকের সঙ্গে মিলে পরিকল্পনা করছিলেন দেশব্যাপী এক সর্বাত্মক প্রতিরোধ আন্দোলন ছড়িয়ে দিয়ে ব্রিটিশকে ভারত ছাড়া করার। ১৯১৫ সালে সেই পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে গেল, শুরু হল লাহোর ষড়যন্ত্র মামলা। এবারে দেশ ছাড়লেন রাসবিহারী বসু। পাড়ি দিলেন জাপানে। আশ্রয় নিলেন অতি প্রভাবশালী এশিয়-জাতীয়তাবাদী রাজনীতিবিদ তোওয়ামা মিৎসুরু-র কাছে। তবে ব্রিটিশ পুলিশ খোঁজ পেয়ে গেল মি. বসুর। কিন্তু তাদের সাহস হয়নি মিৎসুরু-র বাড়িতে ঢুকে তল্লাশী চালানোর।

জাপানিজ পার্সপেক্টিভ ওয়েবসাইট লিখছে, “বিপদ আঁচ করে রাসবিহারী বসুকে সরিয়ে দেওয়া হল তোওয়ামার বন্ধু সোওমা আইজোর বাড়িতে, টোকিওর শিঞ্জিকু এলাকায়। তাঁরা একতলায় ‘নাকামুরায়া’ নামের একটি বেকারী চালান। সুস্বাদু রুটি তৈরি হয় সেখানে। ১৯০১ সালে তৈরি ওই দোকানটি বেশ নামডাকও করেছে। তারই ওপর তলায় একটি ঘরে থাকতে শুরু করেন মি. বসু।”


সববাংলায় সাইটে বিজ্ঞাপন দেওয়ার জন্য আজই যোগাযোগ করুন
contact@sobbanglay.com


 

পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার সুবলদহ গ্রামে জন্ম নেওয়া রাসবিহারী বসু তখন সোওমা পরিবারের কাছে হয়ে উঠেছেন শুধু “বেহারী বোস”। ব্রিটিশ সরকারের হাত থেকে “বেহারী বোস” কে রক্ষা করার জন্য ও তাঁকে জাপানের নাগরিকত্ব পাইয়ে দেবার জন্য আইজো তাঁকে নিজের কন্যার সাথে বিবাহ দিতে সিদ্ধান্ত নিলেন। বিয়েও হল একটা সময়ে বসুর সঙ্গে আইজো তনয়া তোশিকোর। কিন্তু ১৯২৪ সালে মি. বসু স্ত্রীকে হারালেন যক্ষ্মায়।

“বছর দুয়েক পরে শ্বশুর-শাশুড়ীকে বেহারী বোস প্রস্তাব দিলেন যে রুটির পাশাপাশি তিনি মুরগির ঝোল বা কারি আর ভাতও বিক্রি করতে চান বেকারীতে। জামাইয়ের প্রস্তাব লুফে নিয়েছিলেন আইজো। দোতলায় একটি রেস্তোরা তৈরি করালেন। ভারতীয় কারি আর ভাত বিক্রি শুরু হল সেখানে,” জানিয়েছেন জাপানে বসবাসরত বাংলাদেশের রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ শ্রী প্রবীর বিকাশ সরকার।

দোকানের নামেই মুরগির ঝোল-ভাতের এই নতুন পদের নাম দেওয়া হয়েছিল “নাকামুরায়া চিকেন কারি”। তার আগে জাপানে যে মুরগি কারি বিক্রি হত, তা মূলত ব্রিটিশ পদ্ধতিতে তৈরি। বেশ জনপ্রিয়ও ছিল রান্নার সুবিধার জন্য।

৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে নাকামুরায়ার প্রধান শেফ নিনোওমিয়া তাকেশি ওই কারি পরিবেশন করেছেন। নিপোন্নিয়া ওয়েবসাইটে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছিলেন, “জাপানে কারির প্রচলন হয় ১৯১০ সাল নাগাদ। রাইসু কারি বা কারি রাইসু নামের সেই মুরগি ঝোল ভাত প্রথমে বড় রেস্তোঁরা, তারপরে শহরাঞ্চলের সাধারণ মানুষের বাড়িতেও ছড়িয়ে পড়েছিল। মাংসের থেকে সবজিই বেশি থাকত সেটায়, ঝোলটা গাঢ় করা হত ময়দা মিশিয়ে। ভাতের সঙ্গে খাওয়া হত সেটা। এখনও প্রচলিত আছে সেই রেসিপি। কিন্তু রাসবিহারী বসুর পদ্ধতিতে আমরা যে কারি তৈরি করি, সেটা রাইসু কারি থেকে অনেকটাই আলাদা।”

যাঁরা টোকিওতে গিয়ে নাকামুরায়া চিকেন কারি খেয়েছেন, তাঁদের কথায় ভারতীয় মুরগির ঝোলের থেকে এই কারি-র স্বাদ কিছুটা ভিন্ন। কড়া রং নেই, পাতলা ঝোলও থাকে না। বেশ ঘন। কিন্তু খুবই সুস্বাদু আর সুগন্ধী এই ভারতীয়, বা বলা ভাল বাঙালী মুরগির ঝোল-ভাত।

শেফ তাকেশি একটি সাক্ষাতকারে জানিয়েছিলেন, “আমরা ময়দা মিশিয়ে ঝোলটা গাঢ় করি না। সবজি সেদ্ধ হতে হতেই ঝোল ঘন হয়ে যায়। হাল্কা স্বাদের এই কারিতে এমন সব মশলা মেশানো হয়, যেগুলোর ভেষজ গুণও রয়েছে, তাই নিয়মিত খেলেও স্বাস্থ্যহানির কোনও আশঙ্কা থাকে না।”

মি. সরকার জানিয়েছিলেন, “বেহারী বোস জাপানীদের স্বাদ বুঝে গিয়েছিলেন। সেজন্যই তিনি তাদের পছন্দ হবে, এরকমই কারি তৈরি করেছিলেন। সেজন্যই এত বছর পরেও জাপানে অতি জনপ্রিয় এই নাকামুরায়া কারি।” এখনও জাপানের টেলিভিশন অনুষ্ঠানে নাকামুরায়া চিকেন কারির প্রসঙ্গ এলে রাসবিহারী বসুর কথাও উঠে আসে।

যদিও রেস্তোঁরার মালিকানা বদল হয়েছে, নতুন সাজে সেজেছে সেটি, কিন্তু এখনও সেখানে রাখা আছে রাসবিহারী বসু আর তাঁর পত্নীর ছবি, রয়েছে একটি পুরানো পোস্টার: ‘আমরা ভারতীয় কারি পরিবেশন করি, যেটা জাপানে নিয়ে এসেছিলেন এক ভারতীয় বিপ্লবী’।

মি. প্রবীর বিকাশ সরকার বলেছিলেন, “ওখানে খেতে গিয়েই আমার চোখে পড়ে কয়েকটি ছবি – যার মধ্যে রাসবিহারী বসুর ছবিও ছিল। তারপরে জাপান টাইমস পত্রিকাতেও একটি প্রবন্ধ পড়ি, তারপরে কিছু গবেষণা করতে হয়েছে – বিহারী বসুর শাশুড়ি সোওমা কোক্কো’র আত্মকথা এবং সোওমা কোক্কো ও সোওমা ইয়াসুও-র লেখাপত্র নিয়ে পড়াশোনা করি। কীভাবে এক বাঙালী বিপ্লবীর হাত ধরে জাপানে মুরগির ঝোল ভাত এত জনপ্রিয় হয়ে উঠল, সেই অনবদ্য কাহিনী জানতে পারি।”

একদিকে যখন দিনকে দিন আরও জনপ্রিয় হয়ে উঠছে তাঁর তৈরি ভারতীয় কারি, অন্যদিকে আজাদ হিন্দ ফৌজ সংগঠিত করার কাজও চালিয়ে যাচ্ছেন রাসবিহারী বসু। সুভাষ চন্দ্র যখন জাপানে পৌঁছলেন, সেই ফৌজের দায়িত্ব তুলে দিলেন ‘বেহারী বোস’।

যে স্বপ্ন নিয়ে দেশ ছেড়েছিলেন, যে একদিন ভারতের স্বাধীনতা দেখবেন, সেটা অবশ্য আর পূরণ হয় নি। ২১শে জানুয়ারি ১৯৪৫ সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার আগেই যক্ষ্মায় ভুগে তাঁর মৃত্যু হয়। তবে ওই বাঙালি বিপ্লবীর তৈরি মুরগির ঝোল ভাত এখনও জাপানিদের হৃদয়ে গেঁথে আছে।

তথ্যসূত্র


  • বিবিসি বাংলায় প্রকাশিত নিবন্ধ, ২৭শে সেপ্টেম্বর ২০১৭ সাল।

2 comments

আপনার মতামত জানান