নেতাজির প্রেমপত্র

নেতাজির প্রেমপত্র

নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু (Netaji Subhash Chandra Bose) ভিয়েনাতে থাকাকালীন একটি বই রচনার সূত্রে ব্যক্তিগত সচিব হিসেবে এমিলি শেঙ্কল (Emilie Schenkl) -কে নিয়োগ করেন। ১৯৩৪ সালের মাঝামাঝি থেকে ১৯৩৬ সাল পর্যন্ত তাঁদের ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে এবং ১৯৩৭ সালের ২৬ ডিসেম্বর তাঁরা গোপনে বিবাহ করেন। ১৯৪১ সাল থেকে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত বার্লিনে থাকার সময় তাঁরা এক সঙ্গে থাকতেন। তাঁরা একে অপরকে বিভিন্ন সময়ে অনেক চিঠি লিখেছেন, তারই একটি অনুবাদ করে “নেতাজির প্রেমপত্র” শিরোনাম প্রকাশ করা হল।

হে প্রিয়তমা,

নেতাজির প্রেমপত্র

হিমশৈলও মাঝে মাঝে গলে যায় যেমন করে আমার মনের অবস্থাও কতকটা তেমনি এখন। তোমার প্রতি আমার গভীর ভালবাসা প্রকাশ করা থেকে আমি আর কোনমতেই নিজেকে আটকে রাখতে পারছি না – সেই কারণেই দু’কথা লিখছি – আমার প্রিয়তমা – বা আমাদের নিজস্ব ভাষায় বলতে গেলে – আমার হৃদয়ের রানী ! কিন্তু তুমি কি আমাকে ভালবাসো ? তোমার কি আমার কথা কখনও মনে পড়ে ? কখনও কি তোমার আমাকে দেখতে ইচ্ছে করে? তুমি তো আমায় “প্রাণাধিক“ বল – কিন্তু আদৌ কি তোমার কাছে আমি তাই ? তোমার নিজের জীবনের চেয়েও কি তুমি আমাকে বেশি ভালবাসো ? এও কি সম্ভব ? আমাদের সাথে এটা সম্ভব হলেও হতে পারে – একজন হিন্দু নারী শত শত বছর ধরে তার ভালবাসার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করে এসেছে কিন্তু তোমরা ইউরোপীয়রা তোমাদের ধ্যান ধারণা তো অন্যরকম। আর তাছাড়া কেনই বা তুমি আমাকে তোমার জীবনের থেকেও বেশি ভালবাসতে যাবে ? আমি তো কোন দূরদেশ থেকে আগত এক পাখির মত যে ক্ষণিকের জন্য আসে তারপর আবার কোন এক অজানা দেশে তার বাসার টানে উড়ে চলে যায়। এরকম এক মানুষের জন্য তোমার হৃদয়জুড়ে এত গভীর প্রেম কেন আমার প্রাণাধিক প্রিয়া?

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

আর মাত্র কয়েক সপ্তাহের অপেক্ষা! তারপরই আমি উড়ে যাব সুদূর স্বদেশের উদ্দেশ্যে। ঐ দেখো আমার দেশ আমায় ডাকছে – আমার কর্তব্য আমায় ডাকছে – তোমাকে এবার বিদায় জানাতেই হবে – আমাকে যে ফিরে যেতে হবে আমার প্রথম প্রেম – স্বদেশের কাছে। কতবারই না তোমায় আমি বলেছি – আমার যা কিছু আছে তার বেশিরভাগটাই আমি আমার প্রথম প্রেমকে উজাড় করে দিয়েছি। খুব সামান্যই এখনো অবশিষ্ট রয়েছে আমার মধ্যে অন্য কারোও জন্য। যে সামান্য অংশটুকু আমার মধ্যে আজও বেঁচে আছে তার সবটাই আমি তোমাকে দিয়েছি। এও জানি এই সামান্য অংশটুকু তোমার জন্য এবং আমার প্রতি তোমার আকুলপাড়া ভালবাসার সম্মুখে নিতান্তই সামান্য এবং অকিঞ্চিকর – তবুও যেটুকু অবশিষ্ট এখনো আমার মধ্যে তার সবটাই তোমায় দিয়েছি – এর থেকে বেশী কিছু পাওয়ার আশা আমার থেকে রেখো না।

আমি জানিনা, সামনে কি ভবিষ্যত আমার জন্যে অপেক্ষা করছে । হয়তো বাকি জীবনটা জেলের অন্ধকারেই কাটবে। হয়তো আমাকে গুলি করে হত্যা করা হবে কিংবা ফাঁসি দিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু যা কিছুই হয়ে যাক না কেন আমার সাথে, আমার সমস্ত সত্তা জুড়ে তুমি থাকবে এবং নীরবে নিশ্চুপে আমার প্রতি তোমার এই অকৃত্রিম ভালবাসার প্রতিদানে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে তোমায় কৃতজ্ঞতা জানিয়ে যাব আজীবন। হয়তো তোমার সাথে এ জীবনে আর কোন দিন দেখা হবে না – হয়তো তোমাকে আর কোনদিন চিঠি লেখার সুযোগ পাব না – কিন্তু তারপরেও, বিশ্বাস করো তুমি চিরকাল আমার হৃদয়জুড়ে, আমার মন জুড়ে, আমার স্বপ্ন জুড়ে একই রকম ভাবে অমলিন থেকে যাবে । যদি ভাগ্য তোমার থেকে আমাকে এ জীবনের মত আলাদা করে দেয় – পরের জন্মে তবু, আমি তোমাকেই পেতে চাই । তোমার যদি আমার ধর্মে বিন্দু মাত্র আস্থা থাকে, তাহলে আমার মত তুমিও একই প্রার্থনা কর।

হে আমার হৃদয় রাজ্যের পরী, আমাকে এভাবে ভালবাসার জন্য এবং ভালবাসতে শেখানোর জন্য তোমায় অশেষ ধন্যবাদ।

হে আমার প্রিয়তমা, ভালো মেয়ে হয়ে থাকার চেষ্টা করো, চেষ্টা করো যেন নিখাদ, নিষ্পাপ থাকো, এবং সর্বোপরি নিঃস্বার্থ থাকার চেষ্টা করো আজীবন। এর ফলে যত দুঃখ কষ্টই তোমাকে ভোগ করতে হোক না কেন তাতে হতাশ হ’য়ো না। জানবে যদি তুমি প্রকৃতই নিঃস্বার্থ হও তাহলে দুঃখ কষ্ট কোনটাই তোমাকে অসুখী করতে পারবে না । কিন্তু যদি স্বার্থপর হও তাহলে এই পৃথিবীর কোন কিছুই তোমাকে সুখী করতে পারবে না মনে রেখো । তোমার ‘গুরু’ (যতদূর মনে পড়ে এই নামে তুমি কোন একদিন আমাকে সম্বোধন করেছিলে) হিসেবে এই একটাই মাত্র উপদেশ আমি তোমাকে দিতে পারি। স্বার্থপরতাকে আমি যেমন প্রবলভাবে ঘৃণা করি, স্বার্থপর মানুষদেরও আমি তেমন প্রবল অপছন্দ করি। আমার তোমাকে ভালবাসার একটাই কারণ – তোমার স্বার্থহীন হৃদয়। চেষ্টা করো এই নিঃস্বার্থ হৃদয়কে আরও আরও স্বার্থহীন করে তুলতে, দেখবে এই জীবন এবং পরবর্তী জীবনও তোমার সুখে পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

হে আমার হৃদয় রাজ্যের রাণী, আমি ইউরোপ ছেড়ে চলে যাওয়ার পর আমাদের কি আর কখনও কোথাও দেখা হবে না, দয়া করে আমার কথা একটু ভেবো তখন। তখন কিন্তু আমায় দোষ দিও না কেন আমি তোমাকে আরও আরও ভালবাসতে পারলাম না সেই কথা বলে। আমার যা কিছু অবশিষ্ট ছিল সবই তো তোমায় দিয়ে দিয়েছি । এরপর আর তোমাকে দেওয়ার মত কি বাকি আছে বল? এই লাইনগুলির মধ্যে দিয়ে তোমায় আমার অশ্রু পাঠালাম যা এখন অবিরল ধারায় আমার দু’চোখ বেয়ে বয়ে চলেছে।

এর আগে কখনও ভাবিনি কোন নারীর ভালবাসা এভাবে আমায় নাগপাশে আবদ্ধ করতে পারে। কত কত জন এর আগে আমায় প্রেম নিবেদন করেছে আমি ভুলেও তাকাইনি তাদের দিকে। কিন্তু এই যে দুষ্টু কি যে এমন করলে তোমার জালে ঠিক জড়িয়ে পড়লাম আমি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে কেন?

এটা কোন পার্থিব ভালবাসার টানে আমরা যারা দুই ভিন্ন দেশে থাকি তারা আজ এক হলাম – আমার দেশ, আমার দেশবাসী, আমার ঐতিহ্য, আমার অভ্যেস, আমার রীতি নীতি – প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই তোমার আমার সাথে বিস্তর ফারাক । তাহলে কেন এত ভালবাসলে আমায়? বলো? কি এমন পেলে তুমি আমার মধ্যে যা তোমাকে আমার প্রতি এত আকৃষ্ট করলো এবং আমাকে এত ভালবাসতে বাধ্য হলে তুমি? বলো আমায় বলো?

এই মুহূর্তে আমি সম্পূর্ণ ভুলে গেছি সেই সব ফারাক যা এক দেশকে অন্য দেশের থেকে পৃথক করে। আমি তোমার মধ্যে থাকা সেই নারীটিকে ভালবেসেছি – তোমার মধ্যে থাকা সেই সত্তাটিকে ভালবেসেছি । আমার জীবনের প্রথম নারী তুমি – যাকে আমি হৃদয় উজাড় করে ভালবেসেছি। ঈশ্বর করুক তুমিই যেন শেষ নারী হও যাকে আমি ভালবাসি। বিদায়, আমার প্রিয়তমা।


পড়বার পর দয়া করে চিঠিটি নষ্ট করে ফেলো।

তথ্যসূত্র


  1. আ ট্রু লাভ স্টোরি - এমিলি এন্ড সুভাষ - কৃষ্ণা বোস, নিয়োগী বুকস
  2. https://m.rediff.com/
  3. https://www.telegraphindia.com/
  4. https://www.bongodorshon.com/

One comment

  1. অনবদ্য!
    যদিও এ চিঠি পাঠ করা সাধারণের কম্ম নয়,
    তবু কোনো আন্তরিক কণ্ঠে শোনার অপেক্ষায় রইলাম।
    আশা করি ‘সববাংলায়’ কর্তৃপক্ষ উপযুক্ত কাউকে খুঁজে দ্রুত আমাদের অপেক্ষার অবসান ঘটাবেন।শুভেচ্ছা রইল।

আপনার মতামত জানান