সববাংলায়

শাহ বানো বিবাহ-বিচ্ছেদ মামলা

ভারতে মুসলিম মহিলাদের অধিকার সংরক্ষণের ইতিহাসে শাহ বানো বিবাহ-বিচ্ছেদ মামলা একটি মাইলফলক হয়ে আছে। বর্তমান ভারতে যে তিন তালাক বিল নিয়ে মাতামাতি শুরু হয়েছে,তার অনেক আগেই তালাক সংক্রান্ত এই মামলা নিয়ে সমগ্র ভারত জুড়ে বিতর্কের ঝড় বয়েছিল। মুসলিম মহিলাদের মধ্যে বিবাহ ও বিবাহ বিচ্ছেদের সমানাধিকার আদায়ের দাবিতে এই শাহ বানো বিবাহ-বিচ্ছেদ মামলা নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। মুসলিম ব্যক্তিগত আইনে ভারতীয় আদালতের হস্তক্ষেপকে কেন্দ্র করে এই মামলার প্রসঙ্গেই রাজনৈতিক মহলেও চাপান-উতোর চলেছিল।

১৯৭৮ সালে মধ্যপ্রদেশ উচ্চ আদালতে এই মামলা শুরু হয়েছিল এবং ১৯৮৫ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের রায় ঘোষণার মধ্য দিয়ে মামলাটি সমাপ্ত হয়। শাহ বানো বিবাহ-বিচ্ছেদ মামলার বাদী পক্ষে ছিলেন মধ্যপ্রদেশের ইন্দোর নিবাসী শাহ বানো বেগম এবং বিবাদী পক্ষে ছিলেন তাঁর স্বামী মহম্মদ আহমেদ খান। সুপ্রিম কোর্টের মুখ্য বিচারপতি ওয়াই. ভি. চন্দ্রচূড় এই মামলার চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করেছিলেন এবং অন্যান্য আইনজীবিদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন রঙ্গনাথ মিশ্র, ডি এ দেশাই, ও ছিনাপ্পা রেড্ডি, ই এস বেঙ্কটরামাইয়া। মামলায় শাহ বানোর হয়ে মামলা লড়েছিলেন আইনজীবি ড্যানিয়েল লতিফি।  

১৯৭২ সালে মধ্যপ্রদেশের ইন্দোর নিবাসী মুসলিম মহিলা শাহ বানোর সঙ্গে ইন্দোরেরই বিখ্যাত উকিল মহম্মদ আহমেদ খানের বিবাহ হয়েছিল। বিবাহের পরে তাঁদের পাঁচটি সন্তানের জন্ম হয়। কিন্তু চার বছর পরেই শাহ বানো জানতে পারেন যে তাঁর থেকে কমবয়সী আরেক মহিলার সঙ্গে সহবাস করছেন তাঁর স্বামী মহম্মদ আহমেদ খান। প্রায় পাঁচ বছর শাহ বানোর সঙ্গে দাম্পত্য জীবন কাটানোর পরে মহম্মদ আহমেদ খান শাহ বানোকে তাঁর বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলেন। ইতিমধ্যে শাহ বানোর সন্তানাদি প্রতিপালনের জন্য মাসিক দুশো টাকা খোরপোশ দিতে প্রতিশ্রুত হন মহম্মদ আহমেদ, কিন্তু ১৯৭৮ সালে সেই খোরপোশের টাকা দেওয়া বন্ধ করে দিলে শাহ বানো প্রথমে ইন্দোরের স্থানীয় আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৯৭৩-এর ১২৫ নং ধারার ভিত্তিতে তাঁর স্বামীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। এই মামলার পিছনে শাহ বানোর উদ্দেশ্য ছিল স্বামীর কাছ থেকে সন্তান প্রতিপালনের জন্য মাসিক ৫০০ টাকা খোরপোশ আদায় করা। ১৯৭৮ সালের নভেম্বর মাসেই মহম্মদ আহমেদ খান শাহ বানোকে অপরিবর্তনীয় তিন তালাক দেন এবং ভরণপোষণের ভার নিতে অসম্মত হন। ইসলামি আইনের ভিত্তিতে তিন তালাকপ্রাপ্ত মহিলা কোনওভাবেই ভরণপোষণ দাবি করতে পারেন না এবং আইন অনুসারে কেবলমাত্র আবশ্যকীয় সম্মানী হিসেবে মোট ৫৪০০ টাকা দেওয়ার কথা। ৬২ বছর বয়সী শাহ বানোর তিন ছেলে ও দুই মেয়ের ভরণপোষণের দাবিতেই এই মামলা রুজু করেছিলেন। ১৯৭৯ সালের আগস্ট মাসে স্থানীয় আদালত মহম্মদ খানকে মাসিক ২৫ টাকা ভরণপোষণের খরচ হিসেবে শাহ বানোর হাতে তুলে দিতে নির্দেশ দেয়। তারপরে ১৯৮০ সালের ১ জুলাই শাহ বানোর একটি পুনর্মূল্যায়নী চিঠির ভিত্তিতে মধ্যপ্রদেশের উচ্চ আদালত মাসিক ভরণপোষণের জন্য দেয় মূল্যের পরিমাণ বাড়িয়ে ১৭৯ টাকা ২০ পয়সা ধার্য করে। ঐ বছরই সুপ্রিম কোর্টে মহম্মদ আহমেদ খান একটি অভিযোগপত্র জমা দিয়ে আদালতকে জানান যেহেতু ইসলামি আইন মোতাবেক তাঁর এখন দ্বিতীয় বিবাহ হয়েছে, তাই এখন শাহ বানোর উপর কোনও দায় তাঁর নেই। খান আরো সেই পত্রে আরো জানিয়েছিলেন যে ইসলামি আইন মোতাবেক কোনও পুরুষ তাঁর স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার পরে কেবলমাত্র ইদ্দতের সময়পর্ব পর্যন্তই ভরণপোষণ দিতে বাধ্য, তারপরে নয়। ইদ্দত আসলে একটি প্রতীক্ষাপর্ব যা কোনও মুসলিম মহিলাকে স্বামীর মৃত্যুর পর বা বিবাহ বিচ্ছেদের পর দ্বিতীয় বিবাহের আগে পালন করতে হয়। এই ইদ্দতের সময়কাল পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে বাড়ে বা কমে। সাধারণত বিবাহ বিচ্ছেদ বা স্বামীর মৃত্যুর পরবর্তী তিন মাস সময়কেই ‘ইদ্দত কাল’ হিসেবে ধরা হয়। যদি কোনও ক্ষেত্রে সেই মহিলা গর্ভবতী হয়, সেক্ষেত্রে এই সময়কাল সন্তানের প্রসবের দিন পর্যন্ত বর্ধিত হয়। ‘অল ইন্ডিয়া মুসলিম ল বোর্ড’ মহম্মদ আহমেদ খানের এই যুক্তিটি সমর্থন করেছিল। সেই বোর্ড এও দাবি করেছিল যে ভারতের আদালত কখনই মুসলিম ব্যক্তিগত আইনের উপর হস্তক্ষেপ করতে পারে না এবং এমন ঘটনা ঘটলে তা ইসলামি শরীয়তী আইন, ১৯৩৭-এর লঙ্ঘন করবে। তাছাড়া তাদের আরও দাবি ছিল যে তালাক, ভরণপোষণ এবং অন্যান্য পারিবারিক বিষয়ে আদালতের উচিত শরীয়তের সিদ্ধান্তের অনুকূলে রায় দেওয়া।

আরও পড়ুন:  বিল গেটসের সম্পত্তি

১৯৮১ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি বিচারপতি মুর্তজা ফজল আলী এবং এ. বরোদারাজনের সম্মিলনে গঠিত বেঞ্চ প্রথম শাহ বানো বিবাহ-বিচ্ছেদ মামলা-র পূর্বাপর সিদ্ধান্ত বা ঘটনাক্রম শুনে বৃহত্তর বেঞ্চের কাছে বিষয়টি পেশ করেন। এরপরে যখন এই মামলার মধ্যে অংশ নেয় অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড এবং জামিয়াত-উলেমা-ই-হিন্দ, তখন পাঁচ সদস্যের একটি বৃহত্তর বেঞ্চ গঠিত হয়। এর সদস্য ছিলেন মুখ্য বিচারপতি চন্দ্রচূড়, রঙ্গনাথ মিশ্র, ডি এ দেশাই, ও ছিনাপ্পা রেড্ডি এবং ই এস বেঙ্কটরামাইয়া। ১৯৮৫ সালের ২৩ এপ্রিল সুপ্রিম কোর্ট মহম্মদ খানের অভিযোগ সম্পূর্ণ খারিজ করে দেয় এবং মধ্যপ্রদেশ উচ্চ আদালতের রায়কেই সম্মতি জানায়। সুপ্রিম কোর্ট তার রায়ে জানায় যে তালাকপ্রাপ্ত মহিলার স্বামীর ভরণপোষণ দেওয়ার প্রশ্নে ফৌজদারি কার্যবিধির ১২৫ নং ধারার সঙ্গে মুসলিম ব্যক্তিগত আইনের কোনও বিরোধ নেই। এমনকি কোরানের প্রসঙ্গ এনেও কোর্ট প্রমাণ করার চেষ্টা করেছে যে সেখানেও তালাকপ্রাপ্ত মহিলার স্বামীকে ভরণপোষণের ভার নেওয়ার কথাই বলা হয়েছে। ঠিক যে সময় এই মামলাটি সুপ্রিম কোর্টে ওঠে, ততদিনে সাত বছর কেটে গেছে। এর ফলে ফৌজদারি কার্যবিধির ১২৫ নং ধারাটি লাগু করে সুপ্রিম কোর্ট যা কিনা জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকলের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। সুপ্রিম কোর্ট মহম্মদ আহমেদ খানকে শাহ বানোর জন্য খোরপোশ বা ভরণ-পোষণ দিতে বাধ্য করে।

শাহ বানো বিবাহ-বিচ্ছেদ মামলা-কে ঘিরে সমগ্র দেশ জুড়ে বিতর্কের ঝড় ওঠে। অধিকাংশ ভারতীয় মুসলিমের মনে হয় এই রায় তাঁদের ধর্মে আঘাত হেনেছে। তাঁদের পক্ষে বারেলভি নেতা ওবায়েদুল্লাহ খান আজমি এবং সৈয়দ কাজী প্রতিবাদে সামিল হন। এই প্রতিবাদের একেবারে সামনের সারিতে ছিল ‘অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল’ বোর্ড’। ১৯৮৪ সালের ভারতীয় সাধারণ নির্বাচনে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় এলে, দলের অনেক যোগ্য নেতৃত্ব তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীকে পরামর্শ দেয় যাতে সুপ্রিম কোর্টের রায়কে বাতিল ঘোষণা করে নতুন করে সংসদে একটি আইন পাশ করতে। এতে উপস্থিত কিছু অংশের মানুষের ক্ষোভ দমিয়ে পরবর্তী নির্বাচনে সুরক্ষিত থাকা যাবে। ১৯৮৬ সালে ভারতীয় সংসদে ‘মুসলিম মহিলা আইন, ১৯৮৬’ তথা ‘বিবাহ বিচ্ছেদ অধিকার সুরক্ষা আইন, ১৯৮৬’ পাস হয়। এই আইনবলে সুপ্রিম কোর্টের রায়কে খারিজ করে শাহ বানো বিবাহ বিচ্ছেদ মামলার সমাপ্তি ঘটানো হয়। এই আইন অনুসারে তালাকপ্রাপ্ত মহিলাকে তাঁর স্বামী কেবলমাত্র ইদ্দতের তিন মাস ভরণ-পোষণের খরচ যোগাতে বাধ্য থাকবে, তারপরে স্বামীর তরফে আর কোনও দায় থাকবে না। এই আইনকে কেন্দ্র করেও বিতর্কের জন্ম হয়েছিল। অনেকাংশের মত ছিল যে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এর মধ্য দিয়ে মুসলিম তোষণ করেছেন এবং এর বিরোধিতা করে আন্দোলনে সামিল হয় ‘অল ইন্ডিয়া ডেমোক্রেটিক উইমেন্স অ্যাসোসিয়েশন’ (AIDWA)। এই সংস্থাটি মুসলিম মহিলাদের অধিকার আদায়ের লড়াইতে কংগ্রেসের বিরোধিতা শুরু করে। ভারতীয় জনতা পার্টিও এই আইন প্রণয়নকে মুসলিম তোষণের নামান্তর বলে মনে করে এবং তার সঙ্গে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের পবিত্রতা লঙ্ঘন হিসেবে মনে করে। মকরন্দ পরঞ্জপে এই আইনকে জাতীয় কংগ্রেসের ছদ্ম-ধর্মনিরপেক্ষতার ঢাল বলে মনে করেছেন এবং রাজীব গান্ধীর মন্ত্রীসভার গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী আরিফ মহম্মদ খান এর প্রতিবাদে পদত্য্যাগ করেন। বহু মানুষ এবং বুদ্ধিজীবি এই আইন প্রণয়নের ঘটনাকে সমালোচনা করে বলেছেন মুসলিম হলেও সে যেহেতু ভারতীয় নাগরিক, তার ক্ষেত্রেও অন্য সকল নাগরিকের মতই সর্বজনীন আইনটিই লাগু হওয়া উচিত।

আরও পড়ুন:  নাসিক ষড়যন্ত্র মামলা

তথ্যসূত্র


  1. https://indianexpress.com/
  2. https://en.wikipedia.org/
  3. https://blog.ipleaders.in/
  4. https://theprint.in/
  5. https://indiankanoon.org/
  6. https://legislative.gov.in/
  7. https://legislative.gov.in/

error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন।

Discover more from সববাংলায়

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

চৈতন্যদেবের অসামান্য জীবনী দেখুন

চৈতন্য জীবনী

ভিডিওটি দেখতে ছবিতে ক্লিক করুন