সোমনাথ মন্দির গুজরাটের সৌরাষ্ট্র অঞ্চলের ভেরাভাল শহরের কাছে আরব সাগরের তীরে অবস্থিত। বলা হয় এটি দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের মধ্যে প্রথম জ্যোতির্লিঙ্গ। সোমনাথ শব্দটির অর্থ চন্দ্রের রক্ষাকর্তা। পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে ভগবান চন্দ্রদেব এই মন্দির তৈরি করেছিলেন। তারপর বহুবার বিভিন্ন কারণে ধ্বংস হয়েছে এই মন্দির। পরে আবার গড়ে তোলা হয়েছে। বারবার ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েও পুনরায় গড়ে ওঠার জন্য মন্দিরটি ‘চিরন্তন পীঠ’ নামেও পরিচিত। মন্দিরের বর্তমান রূপটি সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেলের উদ্যোগে নির্মিত হয় এবং তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ডক্টর রাজেন্দ্র প্রসাদের হাতে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়। মন্দির উদ্বোধনে তিনি বলেন, “ধ্বংসের চেয়ে যে সৃষ্টি যে মহৎ, সোমনাথ মন্দির তারই প্রতীক।”
ইতিহাসের দিক থেকে দেখলেও সোমনাথ মন্দির বহুবার গড়া হয়েছে এবং ধ্বংস হয়েছে। তবে সোমনাথ মন্দির কে প্রথম নির্মান করেছিলেন সে বিষয়ে কোন ঐতিহাসিক তথ্য পাওয়া যায় না। ধরে নেওয়া হয় খ্রিস্টপূর্ব সময় থেকেই মন্দিরটি ছিল। প্রকৃতির কোপে প্রথম সোমনাথ মন্দির সম্ভবত ৬০০ সালের মধ্যেই ধ্বংস হয়ে যায়। তারপর গুজরাটের সেউনার রাজা বল্লভী ৬৪৯ সালে পুরাতন সোমনাথ মন্দিরের জায়গায় দ্বিতীয়বার নতুন করে সোমনাথ মন্দির গড়ে তোলেন। সিন্ধু প্রদেশের আরব বংশজ রাজ্যপাল, আল জুনায়েদ ৭২৫ সালে গুজরাট ও রাজস্থান আক্রমনের সময় দ্বিতীয়বার গড়া মন্দিরটি লুঠ করে ধ্বংস করেন। গুর্জর প্রতিহার বংশের রাজা দ্বিতীয় নাগভট্ট ৮১৫ সালে ঐ একই স্থানে তৃতীয় বারের জন্য মন্দির নির্মাণ করেন। এর পরে মন্দিরটি পুনরায় কার বা কাদের আক্রমনে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, সে সম্বন্ধে কোন ঐতিহাসিক তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে তৃতীয় বার গড়ে ওঠার পরে যে মন্দিরটি পুনরায় ধ্বংস হয়ে যায় সে বিষয়ে ঐতিহাসিকরা একমত। সোলাঙ্কির রাজা মুলরাজ, ৯৯৭ সালে ঐ একই স্থানে চতুর্থবার সোমনাথ মন্দির নির্মান করেন। পরবর্তী কালে ১০২৪ সালে মাহমুদ গজনভীর আক্রমণে চতুর্থবার গড়া মন্দিরটিও ধ্বংস হয়ে যায়। এরপর ১০২৬ সাল থেকে ১০৪২ সালের মধ্যে মালওয়ার পরমারা রাজা ভোজ ও অনিলওয়াড়ার সোলাঙ্কি রাজা প্রথম ভীমদেব পঞ্চমবারের জন্য মন্দিরটি পুনরায় নির্মান করেন। ১২৯৬ সালে আলাউদ্দীন খিলজীর আক্রমণে পঞ্চমবারে গড়া মন্দিরটি পুনরায় ধ্বংস হয়ে যায়। তারপর সৌরাষ্ট্রের ছুদাষ্মা রাজা মহিপাল দেব ১৩০৮ সালে মন্দিরটি ষষ্ঠবারের জন্য নির্মান করেন ও তাঁর পুত্র খেঙ্গার ১৩২৬ থেকে ১৩৫১ সালের মধ্যে সেখানে শিবলিঙ্গটি পুনরায় প্রতিষ্ঠা করেন। ১৩৭৫ সালে আবার গুজরাটের সুলতান প্রথম মুজফ্ফর শাহের আক্রমণে ষষ্ঠবারে গড়া মন্দিরটি পুনরায় ধ্বংস হয়ে যায়। তারপর ১৪৫১ সালে গুজরাটের সুলতান, মহম্মদ বেগাদার আক্রমণে মন্দিরটি আবার ধ্বংস হয় এবং মন্দিরের কিছুটা অংশ ধ্বংসাবশেষ হিসেবে রয়ে যায়। ১৬৬৫ সালে মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের নির্দেশে মন্দিরটিকে সম্পূর্নরূপে ধূলিসাৎ করে দেওয়া হয় এবং মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের ওপরে কিছুটা স্থান জুড়ে একটি মসজিদ নির্মাণ করে দেওয়া হয়। ১৭৮৩ সালে পুনের পেশোয়া, নাগপুরের রাজা ভোঁসলে, কোলাপুরের ছত্রপতি ভোঁসলে, ইন্দোরের রানী অহল্যা বাঈ ও গোয়ালিয়রের শ্রীমন্ত পাটিলবুয়া শিন্ডের যৌথ উদ্যোগে ধ্বংস হয়ে যাওয়া মন্দিরের পাশেই নতুন করে সপ্তমবারে সোমনাথ মন্দির গড়ে তোলা হয়। কিন্তু পূর্বের মন্দিরের চেহারা গড়া তাঁদের পক্ষে সম্ভব হয় নি। এর পরে বহুবছর ধরে মন্দিরটি কেবলমাত্র একটি ধ্বংসাবশেষ রূপেই পড়ে ছিল।
ভারতের স্বাধীনতা লাভের পরে ১৯৪৭ সালে মন্দিরটি ছিল তৎকালীন দেশীয় রাজ্য জুনাগড়ে, যারা সেই সময়ে ভারতে যোগ দিতে অস্বীকার করেছিল। তৎকালীন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল ১৯৪৭ সালে জুনাগড়কে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করেন এবং মন্দিরটি পুনরায় নির্মাণের কাজ শুরু করেন। সর্দার প্যাটেলের সাথে কে এম মুন্সি এবং কংগ্রেসের অন্যান্য নেতারা ছিলেন। তাঁরা সোমনাথ মন্দির তৈরির প্রস্তাব নিয়ে মহাত্মা গান্ধীর কাছে গেলে, গান্ধীজি তাঁদের পরামর্শ দিয়েছিলেন যে সরকার যেন মন্দির নির্মাণের খরচ না বহন করে, বরং জনগণের থেকে অর্থ সংগ্রহের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। তারপর সর্দার প্যাটেলের মৃত্যু হলে কে এম মুন্সি একাই মন্দির নির্মাণের কাজটি এগিয়ে নিয়ে যান। ১৯৫০ সালে পুরানো মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ সরানো শুরু হয় ও সেখানে গড়ে ওঠা মসজিদটিকে এক কিলোমিটার দূরে স্থানান্তরিত করা হয়। মন্দিরের পুরানো কারুকার্য ও ভাস্কর্য যেগুলি তখনও অক্ষত অবস্থায় থেকে গিয়েছিল, সেগুলিকে বিভিন্ন জাদুঘরে স্থানান্তরিত করা হয়। ঐতিহাসিকদের অনুমান, অনেক দিন পরিত্যক্ত ও অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে থাকার জন্য বহু ভাস্কর্য চুরিও হয়েছিল। ১৯৫১ সালে স্বাধীন ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ডক্টর রাজেন্দ্র প্রসাদের হাতে বর্তমান সোমনাথ মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়। এই মন্দির নিয়ে রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদ ও কে এম মুন্সির সাথে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর মনোমালিন্য দেখা গিয়েছিল। তিনি রাজেন্দ্র প্রসাদকে মন্দির উদ্বোধনে যেতে মানা করেছিলেন এই বলে যে একটি দেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে কোনও মন্দিরের শিলান্যাসে তাঁর যাওয়া একবারেই উচিত নয়। তিনি এই মন্দির তৈরিতে একদমই খুশি ছিলেন না এবং পরিষ্কার জানিয়েছিলেন এই মন্দির তৈরির চেষ্টা আসলে সদ্য স্বাধীন হওয়া ধর্মনিরপেক্ষ ভারতে হিন্দুত্বের জাগরণ। তবে রাজেন্দ্র প্রসাদ তাঁর কথা শোনেননি। পরবর্তীতে শ্রীসোমনাথ ট্রাস্ট তৈরি হয়, যারা মন্দিরের দেখাশোনা করেন। সেই ট্রাস্টের বর্তমান চেয়ারম্যান বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।
মন্দিরের নকশা তৈরি করেছিলেন গুজরাটের সোমপুরা পরিবারের প্রভাশঙ্কর। পরে পদ্মশ্রী পেয়েছিলেন তিনি। সোমপুরা পরিবার বংশপরম্পরায় ভারতসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অনেক মন্দির তৈরি করেছেন। বর্তমান রামমন্দিরের নকশাও তাঁদের পরিবারই করছে। মন্দির স্থাপত্যের চালুক্য রীতিতে এই মন্দির নির্মাণ করা হয়েছে। মন্দিরে রয়েছে গর্ভগৃহ, সভামণ্ডপ এবং নৃত্যমণ্ডপ। সপ্তম শতাব্দী থেকেই মন্দিরে আছে একটি বাণস্তম্ভ, যাতে লেখা আছে সোমনাথ মন্দির থেকে অ্যান্টার্কটিকা অবধি যদি একটি সরলরেখা আঁকা যায়, সেই রেখায় কোন স্থলের অস্তিত্ব নেই, শুধুই জল। প্রাচীর দিয়ে ঘেরা মন্দিরের প্রাচীরের বাইরে আরব সাগরের ঢেউ আছড়ে পড়ে। মন্দির চত্বরে মূল মন্দির ছাড়াও রয়েছে সমস্ত জ্যোতির্লিঙ্গ নিয়ে মূর্তি এবং তাদের কাহিনী। মন্দির চত্বরে প্রাচীরের ভেতরে দর্শনার্থীদের জন্য সুন্দর বসার জায়গা করা আছে।
মন্দিরের শিবলিঙ্গ নিয়ে অনেক জনশ্রুতি প্রচলিত আছে। সেইরকমই একটি জনশ্রুতি অনুসারে মন্দিরের ওপর যখনই হামলা হত, পুরোহিতেরা শিবলিঙ্গ নিয়ে স্যমন্তক মণির মধ্যে লুকিয়ে রাখত। তারপর পরবর্তীতে মন্দির নির্মাণের কাজ শুরু হলে আবার সেই শিবলিঙ্গ মন্দিরে ফিরে আসত। আরেকটি জনশ্রুতি অনুসারে সুলতানের সৈন্যরা শিবলিঙ্গ খুলতে গিয়ে দেখে তা শূন্যে ভাসছে। বিষয়টি প্রাথমিক ভাবে অবাক করলেও পরে তারা বুঝতে পারে শিবলিঙ্গটি লোহার ছিল এবং স্থাপত্যের মধ্যে চুম্বকের অত্যাশ্চর্য ব্যবহারের কারণেই সেটি শূন্যে ভাসছিল। তবে বলা হয় মাহমুদ গজনভী শিবলিঙ্গটি ভেঙে দিয়েছিলেন।
শিবরাত্রি এবং কার্ত্তিক পূর্ণিমা এখানের বিখ্যাত দুটি উৎসব। সারা ভারত তথা পৃথিবী থেকেই হিন্দু ভক্তেরা শিবরাত্রির সময় ভিড় জমায় মন্দিরে। কার্ত্তিক পূর্ণিমার সময় মেলা বসে এখানে। এছাড়া দীপাবলি, নবরাত্রি সহ অন্যান্য পূজাগুলোতেও যথেষ্ট ভিড় হয়। প্রতিদিন মন্দিরে সন্ধ্যারতি হওয়ার মন্দিরে লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো হয়। এই শো’তে মন্দিরের গায়ে প্রজেক্টারের সাহায্যে দেখানো হয় বিভিন্ন তথ্য, সঙ্গে অমিতাভ বচ্চনের কণ্ঠে ব্যাখা করা হয় মন্দিরের পৌরাণিক এবং ঐতিহাসিক কাহিনী।
তথ্যসূত্র
- Somnatha by Professor Romila Thapar
- History of India, 9th Volume by A.V. Williams Jackson
- https://en.wikipedia.org/
- https://eisamay.indiatimes.com/
- https://www.sangbadpratidin.in/
- https://www.anandabazar.com/
- https://aajkaal.in/
6 comments