পদ্মজা নাইডু

পদ্মজা নাইডু

ভারতবর্ষের একজন অন্যতম বিখ্যাত রাজনীতিবিদ হলেন পদ্মজা নাইডু (Padmaja Naidu)। তিনি স্বনামধন্য স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং কবি সরোজিনী নাইডুর কন্যা। হায়দ্রাবাদের জাতীয় কংগ্রেসের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন পদ্মজা। প্রখ্যাত সমাজসেবী সংস্থা রেড ক্রসের ভারতীয় শাখার চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতীয় সংসদেও নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। পশ্চিমবঙ্গের প্রথম এবং দীর্ঘতম মেয়াদসম্পন্ন মহিলা রাজ্যপাল হিসেবে স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকবে পদ্মজা নাইডুর নাম।

১৯০০ সালের ১৭ নভেম্বর ব্রিটিশ অধ্যুষিত ভারতের হায়দ্রাবাদে পদ্মজা নাইডুর জন্ম হয়। তাঁর মা ছিলেন খ্যাতনামা বাঙালি স্বাধীনতা সংগ্রামী ও কবি সরোজিনী নাইডু। পদ্মজার বাবা মুত্যালা গোবিন্দ্রজুলু নাইডু ছিলেন পেশায় একজন ডাক্তার। পদ্মজার আরও চার ভাইবোন ছিল যথা –  যথা, জয়সূর্য, লীলামণি, আদিত্য এবং রণধীরা।

রুত্তি পেটিট বা রতনবাঈ পেটিটের সঙ্গে অত্যন্ত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল পদ্মজার। এই রতনবাঈ পরবর্তীকালে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মহম্মদ আলী জিন্নাহকে বিবাহ করেছিলেন। এছাড়াও নেহেরু পরিবারের সঙ্গেও সুসম্পর্ক ছিল তাঁর।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

মা সরোজিনী নাইডু ছিলেন স্বাধীন ভারতবর্ষের প্রথম মহিলা রাজ্যপাল। তবে খুব বেশিদিন সেই পদে থাকেননি তিনি৷ রাজনৈতিক পরিমন্ডলে বড় হওয়ার দরুণ খুব অল্প বয়সেই রাজনীতির জগতে পদার্পণ করেছিলেন পদ্মজা। মাত্র একুশ বছর বয়সে হায়দ্রাবাদে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সহ-প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন তিনি। খাদি ব্যবহার সংক্রান্ত মহাত্মা গান্ধীর বার্তাকে দিকে দিকে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজেও সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন পদ্মজা। এমনকি স্বরাজের লড়াইয়ের অংশ হিসেবে তিনি ভারতীয় জনগণকে বিদেশী পণ্য বয়কট করতে প্ররোচিতও করেছিলেন। এরপর ১৯৪২ সালে মহাত্মা গান্ধী যখন ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ডাক দেন  পদ্মজা সেসময় হরিশচন্দ্র হেদা, জ্ঞানকুমারী হেদা, বিমলাবাঈ মেলকোট, জিএস মেলকোট প্রমুখের সঙ্গে সেই আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেন। আন্দোলন চলাকালীন পদ্মজা সাহস করে রেসিডেন্সি বিল্ডিংয়ে ব্রিটিশ পতাকা বদলে কংগ্রেসের পতাকা লাগিয়ে দিয়েছিলেন। এর জন্য পদ্মজা নাইডুকে কারাবাস পর্যন্ত করতে হয়েছিল।

১৯৪৭ সালে দেশভাগের ক্ষতকে সঙ্গী করে স্বাধীন ভারতবর্ষের সূচনা হল। সেইসঙ্গে আইনকানুন, প্রশাসনিক কাঠামোর খোলনলচে পালটে গিয়ে নতুন করে নির্মিত হল রাষ্ট্রচিন্তাবিদদের হাতে। স্বাধীন ভারতবর্ষের সংসদের সদস্য হিসাবে নির্বাচিত হয়েও পদ্মজা শারীরিক অসুস্থতার কারণে শেষপর্যন্ত সদস্যপদ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। ১৯৫৬ সালে পদ্মজা পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন। মা সরোজিনী নাইডুর পরে পশ্চিমবঙ্গের দ্বিতীয় মহিলা রাজ্যপাল ছিলেন তিনিই। ১৯৫৬ সালের ৩ নভেম্বর থেকে ১৯৬৭ সালের ১ জুন পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন পদ্মজা। সরোজিনী দীর্ঘদিন রাজ্যপাল পদে থাকতে না পারলেও তাঁর মেয়ে পদ্মজা সবচেয়ে বেশিদিন রাজ্যপাল পদে থাকা মহিলা হিসেবে দৃষ্টান্ত গড়েছিলেন।

এছাড়াও পদ্মজা আন্তর্জাতিক রেড ক্রস আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন। ১৯৭১ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত পদ্মজা ইন্ডিয়ান রেড ক্রস সোসাইটির (IRCS) চেয়ারপার্সনের পদ অলঙ্কৃত করেছিলেন। এছাড়াও ভারত সেবক সমাজ, নেহেরু মেমোরিয়াল ফান্ড এবং সর্বভারতীয় হস্তশিল্প বোর্ড ইত্যাদি সংস্থাগুলির সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন তিনি।

ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর সঙ্গে পদ্মজা নাইডুর ঘনিষ্ঠতা একসময় রাজনৈতিক মহলে খুবই চর্চিত একটি বিষয় ছিল। ইন্দিরা গান্ধীর বন্ধু, ভারতীয় সাংস্কৃতিক কর্মী ও লেখক পুপুল জয় একবার বিজয়লক্ষ্মী পন্ডিতের কাছে শুনেছিলেন যে, নেহেরু আর পদ্মজা নাকি একত্রে দীর্ঘদিন বসবাস করেছিলেন। তবে পদ্মজাকে নেহেরু বিবাহ করেননি তার অন্যতম একটি কারণ হিসেবে মনে করা হয়, জওহরলাল চাননি এই বিয়ের ফলে কন্যা ইন্দিরার বিরক্তি উদ্রেক করে তার অপ্রিয় হতে। কথিত আছে পদ্মজা নিজেও জওহরলালকে বিবাহ করতে চেয়েছিলেন। নেহেরুকে নিয়ে এম.ও মাথাইয়ের স্মৃতিচারণে ‘নেহেরু অ্যান্ড উওমেন’ নামে একটি অধ্যায় রয়েছে যেখান থেকে জানতে পারা যায়, পদ্মজা নেহেরুর বহুনারীসঙ্গের কথাও জানতেন। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে জওহরলাল নেহেরুর সরকারি বাসভবন তিনমূর্তি ভবন এস্টেটের একটি বাংলোতে রাজ্যপাল হিসেবে অবসরের পর আমৃত্যু বসবাস করেছেন পদ্মজা নাইডু।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছিলেন পদ্মজা। সরোজিনী নাইডুর লেখার পান্ডুলিপি ও  চিঠিপত্রগুলিকে যত্ন করে সংরক্ষণ করে রেখেছিলেন। সরোজিনীর কবিতাগুলি সংগ্রহ ও একত্র করে ১৯৬১ সালে ‘দ্য ফেদার অফ দ্য ডন'(The Feather of the Dawn) নামে একটি বই প্রকাশ করেন পদ্মজা। ‘মিস্টার অ্যান্ড মিসেস জিন্নাহ: দ্য ম্যারেজ দ্যাট শুক ইন্ডিয়া’ বইয়ের লেখিকা শীলা রেড্ডি তাঁর সাক্ষাৎকারে এই তথ্যটির উল্লেখ  করেছেন।

পদ্মজা নাইডুর স্মৃতিতে দার্জিলিংয়ে একটি চিড়িয়াখানা রয়েছে।

১৯৭৫ সালে ২ মে দিল্লিতে ৭৪ বছর বয়সে পদ্মজা নাইডুর মৃত্যু হয়।

One comment

আপনার মতামত জানান