বিজয়লক্ষ্মী পন্ডিত

বিজয়লক্ষ্মী পন্ডিত

বিশ শতকের ভারতবর্ষের অন্যতম অগ্রণী নারী চরিত্র ছিলেন বিজয়লক্ষ্মী পন্ডিত (Vijaya Lakshmi Pandit), যাঁর প্রকৃত নাম ছিল স্বরূপ কুমারী নেহরু । ভারতবর্ষের রাজনীতিতে বিজয়লক্ষ্মী পন্ডিত একজন প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। তিনি ছিলেন স্বাধীনতা-পূর্ব ভারতবর্ষে ক্যাবিনেটের প্রথম মহিলা পদাধিকারী। ১৯৪১ সাল থেকে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত তিনি সর্বভারতীয় মহিলা সম্মেলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। রাজনৈতিক জীবনে একাধিকবার তিনি বিভিন্ন দেশে ভারতের রাষ্ট্রদূত হয়েছেন। তিনি রাষ্ট্রসংঘের (United Nations) সাধারণ সভার প্রথম মহিলা সভাপতি ছিলেন। বিজয়লক্ষ্মী পন্ডিত বহু মহিলার অনুপ্রেরণা ছিলেন। ভারতীয় রাজনীতিতে তাঁর সার্বিক অবদান অনস্বীকার্য।

এলাহাবাদের অত্যন্ত প্রভাবশালী একটি পরিবারে ১৯০০ সালের ১৮ আগস্ট বিজয়লক্ষ্মী পন্ডিতের জন্ম হয়। তাঁর বাবা মতিলাল নেহরু কাশ্মিরী পন্ডিত সম্প্রদায়ের মানুষ ছিলেন। ভারতীয় রাজনীতির একজন স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব মতিলাল লেহরু ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম চলাকালীন দুইবার ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের হয়ে সভাপতিত্ব করেন। তাঁর মা ছিলেন স্বরূপরানি থুসসু। তিনিও কাশ্মীরের একটি ব্রাহ্মণ পরিবারের সদস্যা ছিলেন। বিজয়লক্ষ্মীর দাদা ছিলেন বিখ্যাত রাজনীতিবিদ এবং স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। এরকম একটি আদ্যোপান্ত রাজনৈতিক পরিবারে জন্মাবার ফলে তাঁর রাজনৈতিক চিন্তা চেতনা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছিল।

স্বাধীনতা পূর্ববর্তী ভারতবর্ষে তিনিই ছিলেন প্রথম মহিলা যিনি ক্যাবিনেটের একজন সদস্যা ছিলেন। ১৯৩৭ সালে তিনি সংযুক্ত প্রদেশের (United Province) প্রাদেশিক আইন-পরিষদ (Provincial Legislature) নির্বাচিত হন এবং স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন এবং জনস্বাস্থ্যের মন্ত্রীর পদে উন্নীত হন। এই পদে বিজয়লক্ষ্মী পন্ডিত ১৯৩৮ এবং পরে ১৯৪৬ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত বহাল ছিলেন। ১৯৪৬ সালে তিনি সংযুক্ত প্রদেশের তরফ থেকে গণপরিষদের (Constituent Assembly) সদস্যা হিসেবে নির্বাচিত হন।

পারিবারিক সূত্রেই বিজয়লক্ষ্মী পন্ডিত ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন এবং সব মিলিয়ে মোট তিন বার কারাবরণ করেন। ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীনতা পাওয়ার পরে তিনি কূটনীতির জগতে প্রবেশ করেন। একাধিক দেশে ভারতের রাষ্ট্রদূতের ভূমিকা পালন করেছেন তিনি। ১৯৪৭ থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত ছিলেন, ১৯৪৯ থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং মেক্সিকোর রাষ্ট্রদূত ছিলেন। ১৯৫৫ থেকে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত আয়ারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। এই সময়েই তিনি গ্রেট ব্রিটেনের ভারতীয় হাই কমিশনার পদে নিযুক্ত ছিলেন। ১৯৫৮ থেকে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত তিনি স্পেনের (Spain) ভারতীয় রাষ্ট্রদূত হিসেবে কাজ করেছেন। ১৯৪৬ সাল থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত জাতিসংঘে তিনি ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেন। ১৯৫৩ সালে তিনি জাতিসংঘের সাধারণ সভার প্রথম মহিলা সভাপতি নির্বাচিত হন।

১৯৬২ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত বিজয়লক্ষ্মী পন্ডিত মহারাষ্ট্রের রাজ্যপাল হিসেবে কাজ করেছিলেন। এরপরেই ফুলপুর থেকে তিনি সংসদের নিম্নকক্ষ অর্থাৎ লোকসভার সদস্যা নির্বাচিত হন। তিনি তাঁর ভাইঝি ইন্দিরা গান্ধীর প্রধানমন্ত্রীত্বকে প্রবলভাবে সমালোচনার মুখে ফেলে দেন। মূলত ইন্দিরা গান্ধী ভারতবর্ষে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করার পরে বিজয়লক্ষ্মী পন্ডিত ইন্দিরা গান্ধীর আরো কঠোর সমালোচনা করতে শুরু করেন। এরপর ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের ক্রমশ অবনতি ঘটতে থাকে।

তাঁদের সম্পর্ক তলানিতে এসে ঠেকলে বিজয়লক্ষ্মী পন্ডিত সক্রিয় রাজনীতি থেকে অবসর নেন। অবসর নিয়ে তিনি হিমালয়ের পাদদেশের দুন উপত্যকায় (Doon Valley) দেরাদুনে চলে যান। ১৯৭৭ সালে অবসরযাপন ভঙ্গ করে ইন্দিরা গান্ধীর বিরুদ্ধে তাঁকে প্রচার চালাতে দেখা যায়। এমনকি ১৯৭৭ সালের নির্বাচনে জনতা পার্টিকে জয় এনে দিতেও তিনি সাহায্য করেন। ১৯৭৯ সালে তিনি জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের (UN Human Rights Commision) ভারতীয় প্রতিনিধি হিসেবে নিযুক্ত হন। এই ঘটনার পরেই তিনি নিজেকে বাহ্যিক পৃথিবী থেকে সরিয়ে নেন।      

সৈয়দ হুসেন (Syud Hossain) নামক এক মুসলমান সাংবাদিকের সঙ্গে বিজয়লক্ষ্ণী পন্ডিতের গোপনে বিয়ে হলেও তাঁর পরিবার উভয়কে আলাদা করে দেয়। ১৯২১ সালে গুজরাটের সফল ব্যারিস্টার তথা স্বাধীনতা সংগ্রামী রঞ্জিত সীতারাম পন্ডিতের (Ranjit Sitartam Pandit) সঙ্গে বিজয়লক্ষ্মী পন্ডিতের বিয়ে হয়। তাঁর স্বামীর পরিচয়কে টিকিয়ে রাখতে তাঁর নাম স্বরূপা কুমারী থেকে বিজয়লক্ষ্মী পন্ডিত করে দেওয়া হয়। তাঁদের তিন মেয়ে ছিল, যাঁদের নাম যথাক্রমে চন্দ্রলেখা মেহতা , নয়নতারা সেহগল এবং রিতা দর ।

জাতিসংঘের সাধারণ সভার প্রথম মহিলা সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার জন্য তাঁকে ১৯৭৮ সালে আলফা কাপ্পা আলফা ভগিনীসংঘের (Alpha Kappa Alpha Sorority) সম্মানীয় সদস্যা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। কখনও কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না পেলেও তিনি আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যনির্বাহী পরিষদের একজন সদস্য ছিলেন। তিনি অক্সফোর্ডের সমারভিল কলেজের (Somerville College, Oxford) একজন সম্মানীয় ফেলো ছিলেন। এডওয়ার্ড হ্যালিডের (Edward Halliday) আঁকা তাঁর একটি প্রতিকৃতি সমারভিল কলেজের গ্রন্থাগারে টাঙানো রয়েছে।

তাঁর লেখা দুটি বই হলো, ১৯৫৮ সালে প্রকাশিত ‘দ্য এভলিউশন অফ ইন্ডিয়া’ (The Evolution of India) এবং ১৯৭৯ সালে প্রকাশিত ‘দ্য স্কোপ অফ হ্যাপিনেস: আ পার্সোনাল মেমোয়ার’) (The Scope of Happiness: A Personal Memoir)।

১৯৯০ সালের ১ ডিসেম্বর ৯০ বছর বয়সে এই বিখ্যাত রাজনৈতিক নেত্রী তথা ভারতীয় রাজনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বের মৃত্যু হয়। বিজয়লক্ষ্মী পন্ডিতের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় রাজনীতির এক অনন্য যুগের অবসান ঘটে।

3 comments

আপনার মতামত জানান