ভারতের জাতীয় পতাকা 

ভারতের জাতীয় পতাকা 

একটি দেশ সম্পর্কে কথা বলতে গেলে স্বাভাবিকভাবেই সেই দেশের জাতীয় পতাকাটির কথা চলে আসে এবং সেই পতাকাটির মধ্যে যেসব চিহ্ন, ছবি এবং রঙ ব্যবহার করা হয়, সেগুলিরও নির্দিষ্ট কিছু তাৎপর্য থাকে। আমাদের দেশ ভারতবর্ষও তার ব্যতিক্রম নয়। অন্যান্য অনেক দেশের মতোই ভারতবর্ষের জাতীয় পতাকার নেপথ্যে যে ইতিহাস রয়েছে তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে স্বদেশপ্রেম, আভিজাত্য এবং দেশের মাহাত্ম্য প্রচারের উদ্দেশ্য। বর্তমানে ভারতবর্ষের জাতীয় পতাকা হিসেবে যেটিকে আমরা চিনি তা কিন্তু চিরকাল একই ছিল না। আগে অনেকবার অনেকরকম পতাকা তৈরি হয়েছে ভারতবর্ষের প্রতীক হিসেবে। মহাত্মা গান্ধীর মতো ইতিহাসখ্যাত ব্যক্তিদের নামও এই পতাকা নির্মাণের সঙ্গে জড়িত। পতাকার এই বিবর্তনের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে স্বাধীনতা সংগ্রামেরও ইতিহাস। জওহরলাল নেহেরু জাতীয় পতাকাকে কেবল দেশের স্বাধীনতা নয়, সমস্ত মানুষের স্বাধীনতার প্রতীক বলেছিলেন।

ভারতবর্ষের জাতীয় পতাকাটি আয়তক্ষেত্রাকার। পতাকাটির দৈর্ঘ্য-প্রস্থের অনুপাত ৩:২। এই পতাকায় তিনটি রঙ দেখা যায়, সেগুলি হল গেরুয়া, সাদা এবং সবুজ। পতাকাটির উপরের অংশে গেরুয়া, মাঝখানে সাদা ও নিচের অংশে সবুজ রঙের বিস্তার এবং পতাকাটির মাঝের সাদা অংশের মাঝখানে সমদূরত্ববিশিষ্ট ২৪ টি দন্ড নিয়ে তৈরি ঘন নীল রঙের একটি অশোক চক্র থাকে। মূল তিনটি রঙের জন্য জাতীয় পতাকাকে ‘তেরঙ্গা’ বলেও অভিহিত করা হয়।

জাতীয় পতাকার এই তিনটি রঙ এবং অশোকচক্র প্রতিটিরই নির্দিষ্ট তাৎপর্য রয়েছে। পতাকার গেরুয়া রঙ সাহস, বীরত্ব, প্রজ্ঞা, ত্যাগ ও বৈরাগ্যের প্রতীক, সাদা রঙ হল বিশুদ্ধতা ও শান্তির প্রতীক এবং সবুজ রঙ হল কর্মশক্তি, আশা, বৃদ্ধি ও উর্বরতার প্রতীক। এছাড়াও কৃষি তথা উদ্ভিদের সঙ্গেও এই সবুজ রঙটির যোগ রয়েছে। পতাকার মাঝখানের অশোকচক্রটি আসলে সত্য এবং ধর্মের প্রতীক। এই চক্রটি শান্তিপূর্ণ উপায়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার কথাও বলে।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের দিক থেকে দেখলে এই তিনটি রঙের অর্থ বদলে যায়। গেরুয়া রঙ সেক্ষেত্রে হিন্দু, বৌদ্ধ এবং জৈন ধর্মের প্রতিনিধিত্ব করে, সাদা খ্রিস্টান ধর্ম এবং সবুজ ইসলাম ধর্মকে বোঝায়। বিশিষ্ট দার্শনিক এবং ভারতবর্ষের প্রথম উপরাষ্ট্রপতি সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন এই তিনটি রঙ এবং অশোকচক্রের একটি চমৎকার ব্যাখা বিশ্বের সামনে তুলে ধরেছিলেন। তিনি বলেন গেরুয়া আসলে বোঝায় ত্যাগ এবং বৈরাগ্যকে। দেশসেবায় নিয়োজিত আমাদের নেতাদেরকে অবশ্যই বস্তুগত লাভের ব্যাপারে উদাসীন থেকে, দেশের কাজে নিজেদের উৎসর্গ করার কথাই গেরুয়া রঙটির আসল ব্যাঞ্জনা। আবার সাদা রঙটিকে তিনি আলোর সঙ্গে তুলনা করেছেন, আলো অর্থে সত্যের পথের কথা বলতে চেয়েছেন। অপরদিকে সবুজ রঙটির অর্থ ব্যাখা করে বলেছেন এটি দেশের মাটি এবং সবুজ উদ্ভিদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ককে বোঝায়, যে-সবুজের ওপরেই সমস্ত প্রাণ নির্ভরশীল। অশোকচক্রকে ধর্ম ও ন্যায়ের প্রতীক বলার পাশাপাশি তিনি একে গতিরও প্রতীক হিসেবে ব্যাখা করে বলেন, জীবন গতিশীল, স্থবিরতাতেই আসে মৃত্যু।

১৯৪৭ সালের ২২ জুলাই অনুষ্ঠিত গণপরিষদের একটি বৈঠকে বর্তমান জাতীয় পতাকার রূপটি ভারতবর্ষের সরকারি পতাকা হিসেবে গৃহীত হয়েছিল এবং ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট থেকে এটি ভারতের জাতীয় পতাকা হয়ে ওঠে। ১৯৪৭ সালেই জওহরলাল নেহেরুর দ্বারা চরকার বদলে পতাকার কেন্দ্রে অশোকচক্র প্রতিস্থাপিত হয়েছিল।

স্টার অব ইন্ডিয়া

তবে জাতীয় পতাকার এই বর্তমান রূপটির আগে অনেক রকম পতাকা ব্যবহার করা হয়েছিল ভারতের প্রতীক হিসেবে। ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের পর যখন ভারতবর্ষে ব্রিটিশ আধিপত্য দৃঢ় হয়েছিল, তখন ব্রিটিশরাই প্রথম ভারতের জন্য একক একটি পতাকার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন। তার ফলে ভারতের জন্য প্রথম যে পতাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল, তা মূলত পশ্চিমা হেরাল্ডিক আদর্শে নির্মিত। সেই পতাকা ‘স্টার অব ইন্ডিয়া’ নামে পরিচিত। ভারতের এই পতাকাটি কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া-সহ অন্যান্য ব্রিটিশ উপনিবেশের পতাকাগুলির মতোই প্রায় দেখতে ছিল। সেই পতাকায় দেখতে পাওয়া যেত একপাশে ব্রিটিশদের ইউনিয়ন জ্যাক পতাকা এবং অন্যদিকে হলুদ এক গোলকের মাঝে নীল বৃত্ত ঘেরা সাদা তারা, যা ছিল ভারতের প্রতীক। কিন্তু এই পতাকা কোন ভারতীয় তৈরি করেননি।

ঐতিহাসিকদের মত অনুযায়ী, ভারতের প্রথম জাতীয় পতাকা তৈরি হয়েছিল ১৮৮৩ সালে। একটি সাদা ক্ষেত্রের মাঝে লাল সূর্য, এইরকমই ছিল সেই পতাকাটি। পতাকাটি বানিয়েছিলেন শ্রীশচন্দ্র বসু। এই পতাকাটি ‘স্বদেশী পতাকা’ নামে পরিচিত ছিল।

এরপর ১৯০৪ সালে, মতান্তরে ১৯০৯ সালে, স্বামী বিবেকানন্দের একনিষ্ঠ শিষ্যা ভগিনী নিবেদিতা বানিয়েছিলেন একটি পতাকা। সেই পতাকায় ছিল লাল ও হলুদ রঙ। সেই পতাকার মাঝবরাবর ছিল বজ্র, কুসুম ও দন্ড এবং বাংলায় লেখা ছিল ‘বন্দেমাতরম’ কথাটি।

১৯০৫ সালে অনুশীলন সমিতির সভাপতি প্রমথনাথ মিত্র একটি পতাকা উত্তোলন করেন যেটিতে লাল (উপরে), হলুদ (মাঝে) এবং সবুজ (নীচে) রঙ ছিল। লাল অংশে ছিল আটটি ফুল, হলুদ অংশে দেবনাগরীতে বন্দেমাতরম লেখা এবং সবুজের একদিকে সূর্য অন্যদিকে তারকাযুক্ত অর্ধচন্দ্র।

ভারতের জাতীয় পতাকা - দ্য ক্যালকাটা ফ্ল্যাগ
দ্য ক্যালকাটা ফ্ল্যাগ

১৯০৬ সালের ৭ আগস্ট কলকাতার পার্শীবাগান এলাকায় বঙ্গভঙ্গ বিরোধী এক সভায় যে পতাকাটি উত্তোলন করা হয়েছিল সেটি ছিল তিনটি রঙের। উপরে ছিল সবুজ, মাঝখানে হলুদ এবং সবচেয়ে নীচে ছিল লাল। সবুজ অংশের মধ্যে আটটি পদ্মফুল অঙ্কিত ছিল, মাঝের হলুদ অংশে দেবনাগরী ভাষায় বন্দেমাতরম লেখা ছিল এবং নীচের লাল অংশের দুইকোনে সাদা রঙে আঁকা ছিল সূর্য এবং অর্ধচন্দ্র। এই পতাকাটি ‘দ্য ক্যালকাটা ফ্ল্যাগ’ নামেও পরিচিত ছিল। এই পতাকার নকশা তৈরি করেছিলেন শচীন্দ্রপ্রসাদ বসু এবং হেমচন্দ্র কানুনগো। তবে অনেকের মতে এই নকশাটি আসলে ‘কামা পতাকা’-র যা ১৯০৭ সালে উত্তোলন করা হয়।

দ্য কামা ফ্ল্যাগ

১৯০৭ সালে জার্মানির স্টুটগার্ট শহরে স্যোশালিস্ট কনফারেন্সে ভারতের একটি জাতীয় পতাকা প্রদর্শিত হয়, যেটি তৈরি করেছিলেন মাদাম ভিকাজী কামা, বিনায়ক দামোদর সাভারকর এবং শ্যামজি কৃষ্ণ ভার্মা। এটির নাম ছিল ‘দ্য কামা ফ্ল্যাগ’। এটিও ছিল তিনরঙা – উপরে গেরুয়া, মাঝে হলুদ এবং নীচে সবুজ৷ গেরুয়া অংশে আটটি তারা, মাঝে দেবনাগরীতে বন্দেমাতরম লেখা এবং নীচের সবুজ অংশে একদিকে ছিল সূর্য, অন্যদিকে তারাযুক্ত অর্ধচন্দ্র। কামা এবং কয়েকজন ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামী বার্লিনেই এটি উত্তোলন করেছিলেন। তবে অনেকের মতে, এই নকশাটি আসলে ‘কলকাতা পতাকা’-র যা ১৯০৬ সালে উত্তোলন করা হয়।

১৯১৬ সালে হোমরুল আন্দোলনের সময় ভারতের প্রতীক হিসেবে অ্যানি বেসান্ত এবং বাল গঙ্গাধর তিলকের নেতৃত্বে একটি পতাকা তৈরি করা হয়। পতাকাটির উপরে বাঁদিকের কোনায় ব্রিটিশদের ইউনিয়ন জ্যাক পতাকার ছবি ছিল, তার নীচে ছিল সাতটি তারা, উপরে ডানকোনে তারকাযুক্ত অর্ধচন্দ্র এবং ক্ষেত্রটি সবুজ আর লালে ডোরাকাটা। হোমরুল আন্দোলনের সঙ্গে এই পতাকাটিও লুপ্ত হয়ে যায়।

১৯১৬ সালে অন্ধ্রপ্রদেশের বাসিন্দা পিঙ্গালি ভেঙ্কাইয়া জাতীয় পতাকা নির্মাণের চেষ্টা করছিলেন এবং জাতীয় পতাকার ৩০টি নকশা করেছিলেন। মহাত্মা গান্ধীর পরামর্শে তিনি চরকার ছবিযুক্ত পতাকা তৈরি করেন। ১৯২১ সালে বিজয়ওয়ারায় কংগ্রেস কমিটির মিটিং-এ তিনি গান্ধীজীর কাছে মাঝে চরকার চিহ্নযুক্ত, উপরে লাল ও এবং নীচে সবুজ রঙ সম্বলিত একটি পতাকার প্রস্তাব করেন। পতাকাটি সব ধর্মের প্রতিনিধিত্ব না-করায় গান্ধীর মনোনয়ন পায়নি এবং গান্ধীজী সেই পতাকার মধ্যে একটি সাদা রঙ জুড়ে দিতে বলেছিলেন। গান্ধীজীর পরামর্শে যে-পতাকাটি হল, তাতে সকলের উপরে ছিল সাদা রঙ, মাঝে সবুজ, নীচে লাল এবং মধ্যিখানে ছিল চরকার ছবি। সাদা রঙ সংখ্যালঘুদের, সবুজ মুসলিমদের এবং লাল হিন্দুদের বোঝাতে ব্যবহার করা হয়েছিল। এই পতাকাটি ‘স্বরাজ পতাকা’ নামে পরিচিত। এই সময় থেকেই চরকায় কাটা খাদির কাপড় দিয়েই পতাকা নির্মাণ শুরু হয়েছিল।

ভারতের জাতীয় পতাকা  - প্রাথমিক রূপ
স্বরাজ পতাকা

১৯৩১ সালের ২ এপ্রিল কংগ্রেস কর্মসমিতি একটি পতাকা সমিতি গঠন করেছিলেন। ১৯৩১ সালে করাচি অধিবেশনে পতাকা বিষয় সর্বেশষ প্রস্তাবটি পাশ হয় এবং সেই পিঙ্গালি ভেঙ্কাইয়া নির্মিত তিনরঙা পতাকাটিকে গ্রহণ করা হয়। এই পতাকাটি বর্তমান জাতীয় পতাকার মতোই কেবল মাঝের সাদা অংশে অশোকচক্রের বদলে তখন ছিল চরকার ছবি। সেইসময় আবার আজাদ হিন্দ ফৌজের ব্যবহৃত পতাকায় চরকার বদলে দেখা যায় লম্ফমান বাঘের ছবি। অহিংস নীতির বদলে সংহিসতার কথাই বলে এই প্রতীক।

অবশেষে ১৯৪৭ সালের ২৩ জুন পতাকা কমিটি গঠিত হয় এবং গেরুয়া, সাদা, সবুজ এই তিনরঙা পতাকাটির মধ্যে চরকার বদলে অশোকচক্র স্থাপন করে ভারতের জাতীয় পতাকা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

এই জাতীয় পতাকা উত্তোলনের এবং পাশাপাশি এটির যাতে কোনোরকম অবমাননা না হয়, তারজন্য বেশ কিছু নিয়মাবলী নথিবদ্ধ রয়েছে। মূলত ২০০২ সালের ‘ফ্ল্যাগ কোড অব ইন্ডিয়া’, এমব্লেমস এন্ড নেমস (প্রিভেনশন অব ইম্প্রপার ইউজ) অ্যাক্ট ১৯৫০ এবং প্রিভেনশন অব ইনসাল্টস টু ন্যাশানাল অনার অ্যাক্ট ১৯৭১ দ্বারা পতাকার ব্যবহার এবং অবমাননামূলক নিষেধাজ্ঞাগুলি নির্ধারিত হয়েছিল। ফ্ল্যাগ কোডের বিধান লঙ্ঘন করলে তিন বছর কারাদন্ড, জরিমানা বা উভয়ই হতে পারে।

২০০২ সালের পূর্ব পর্যন্ত স্বাধীনতা দিবস কিংবা প্রজাতন্ত্র দিবসের মতো জাতীয় দিবসগুলিতেই কেবলমাত্র জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা যেত। ২০০১ সালে নবীন জিন্দাল নামক এক ব্যক্তি এই বিধি ভেঙে তাঁর কার্যালয়ে পতাকা উত্তোলন করলে তাঁর পতাকাটি বাজেয়াপ্ত করা হয় এবং আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে সতর্ক করা হয়। নবীন জিন্দাল তখন দিল্লি হাইকোর্টে জনস্বার্থ মামলা দায়ের করেন এবং বলেন পূর্ণ মর্যাদা সহকারে জাতীয় পতাকা উত্তোলন তাঁর নাগরিক অধিকারের মধ্যে পড়ে। মামলাটি সুপ্রিম কোর্টের আওতায় গেলে কেন্দ্রীয় ক্যাবিনেট জাতীয় পতাকাবিধি সংশোধন করেন এবং ২০০২ সালের ২৬ জানুয়ারি থেকে সেই বিধি চালু হয়। এই বিধি অনুযায়ী, সমস্ত নাগরিক উপযুক্ত মর্যাদা ও সম্মান সহকারে বছরের যে-কোন দিনই পতাকা উত্তোলন করতে পারবে।

২০০৫ সাল পর্যন্ত পতাকার ছবি বস্ত্রে বা সাজপোশাকে ব্যবহার করা যেত না৷ তবে ২০০৫ সালের পতাকাবিধি সংশোধন করে বলা হয় কেবল কোমরের নীচে এবং অন্তর্বাস হিসেবে জাতীয় পতাকা ব্যবহার করা যাবে না।

আরও একটি সংশোধনের কথা বলা প্রয়োজন। ২০২১ সাল পর্যন্ত খাদি বা হাতে কাটা কাপড় দিয়েই একমাত্র পতাকা তৈরির অনুমতি ছিল। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে পতাকাবিধি সংশোধনের মাধ্যমে সরকার খাদি ছাড়াও সিল্ক বা অন্যান্য উপকরণ দিয়ে পতাকা তৈরির অনুমতি দিয়েছিল। পতাকা নির্মাণের পর ভারতীয় মানক ব্যুরো সেটির মান যাচাই করে ছাড়পত্র দিলে তবে তা বিক্রির জন্য বিতরণ করা হয়।

পতাকা প্রদর্শনের নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম রয়েছে। পতাকা উত্তোলন করলে খেয়াল রাখতে হবে যেন গেরুয়া রঙটি উপরদিকে থাকে। জাতীয় পতাকা যদি কোনও হলের মধ্যে অনুষ্ঠিত সভা-সমিতিতে প্রদর্শন করতে হয় তবে তা সর্বদাই বক্তার ডানদিকে অর্থাৎ দর্শকদের বামদিকে স্থাপন করতে হবে। তবে হলের অন্য কোথাও ব্যবহার করতে হলে দর্শকদের ডানদিকে পতাকাটি স্থাপন করতে হবে। যদি পোর্ডিয়ামের পিছনে পতাকা উল্লম্বভাবে ঝোলানো থাকে তবে অবশ্যই গেরুয়া রঙের দিকটি দর্শকদের বামদিকে থাকতে হবে। যানবাহনে পতাকা ওড়ানোর সুবিধা কেবল পান রাষ্ট্রপতি, উপরাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, রাজ্যগুলির রাজ্যপাল ও লেফটেন্যান্ট গভর্নর, মুখ্যমন্ত্রী, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ,ভারতের সংসদ সদস্য, বিধানসভা ও বিধান পরিষদের সদস্য, ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্টের বিচারক এবং সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর অফিসাররা। তাঁদের গাড়ির ডানদিকে পতাকাকে স্থাপন করতে হয়। যদি কোনো বিদেশি সরকার প্রদত্ত গাড়িতে ভ্রমণ করেন তবে ডানদিকে ভারতের পতাকা এবং বামদিকে সেই ব্যক্তির দেশের পতাকা থাকবে। যখন অন্যান্য দেশের পতাকার সঙ্গে ভারতের পতাকা ওড়ানো হবে, তখন অবশ্যই সকলের শুরুতে (যদি সরলরেখায় থাকে তবে একেবারে ডানদিকে) ভারতের পতাকাকে রাখতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে যে, ভারতের পতাকার থেকে অন্য কোনো দেশের পতাকার উচ্চতা বেশি না হয়ে যায়। অন্যদেশের পতাকার সঙ্গে ক্রস অবস্থায় রাখতে হলে ভারতের পতাকাটি থাকবে অন্য পতাকার ডানদিকে অর্থাৎ দর্শকদের বামদিকে। মিছিলে পতাকা ব্যবহার করতে হলে হয় মিছিলের ডানদিকে একদম শুরুতে কিংবা মিছিলের কেন্দ্রে একা একজনকে বহন করতে হবে। এতদিন সূর্যোদয়ের পরে পতাকা উত্তোলন করে সূর্যাস্তের আগে তা নামিয়ে ফেলতে হত, কিন্তু ২০২২ সালের ২০ জুলাই একটি সংশোধনের মাধ্যমে বলা হয়েছে যথাযথ মর্যাদা ও সম্মান বজায় রেখে দিবারাত্রই পতাকা উত্তোলিত রাখা যাবে।

জাতীয় পতাকা নিয়ে যেসব আচরণ করা যায় না, তারও নিয়মাবলী লিপিবদ্ধ করা আছে। প্রথমত, ছেঁড়া পতাকা কখনই উত্তোলন করা যাবে না। পতাকা মাটিতে রাখা যাবে না, জলে ডোবানোও চলবে না। পতাকা কুঁচকোনো অবস্থায় ব্যবহার করা অনুচিত। পতাকার ওপরে কোনও অক্ষর লেখা যাবে না। ক্ষতিগ্রস্ত বা নোংরা পতাকা যত্রতত্র ফেলে দেওয়া চলবে না। পতাকাকে কখনই কোনো বস্তুর আচ্ছাদন হিসেবে ব্যবহার করা অনুচিত এমনকি মঞ্চের সামনের অংশ ঢাকা দেওয়ার কাজেও জাতীয় পতাকা ব্যবহার করা যাবে না। কোনো বাণিজ্যিক কাজে পতাকাকে ব্যবহার করা যাবে না। উল্টো অবস্থায় পতাকা টাঙানোও অপরাধ। উত্তোলনের সময় ফুলের পাপড়ি ছাড়া অন্য কিছু পতাকার গায়ে লাগানো যাবে না। একই দন্ডের মধ্যে জাতীয় পতাকার সঙ্গে আর অন্য কোনো পতাকা সংযুক্ত করা যাবে না। জাতীয় পতাকা অবমাননার জন্য তিন বছর পর্যন্ত কারাদন্ড হতে পারে।

এছাড়া ১৫ আগস্ট ও ২৬ জানুয়ারি পতাকা উত্তোলনের পদ্ধতিতেও পার্থক্য আছে। ১৫ আগস্ট পতাকা দন্ডের নিচ থেকে (মাটি স্পর্শ করে নয়) উপরে তোলা (hoisting) হয়। অন্যদিকে ২৬ জানুয়ারি পতাকাটি দন্ডের উপরেই বাঁধা থাকে এবং সেখানে ওড়ানো (unfurling) হয়।

জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখবারও কিছু নিয়ম রয়েছে। একমাত্র রাষ্ট্রপতির নির্দেশ অনুসারে কোনো শোকের চিহ্ন হিসেবে পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়। মূলত রাষ্ট্রপতি, উপরাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী কিংবা রাষ্ট্রীয় কোনো উচ্চপদাধিকারী ব্যক্তি যেমন, লোকসভার অধ্যক্ষ, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি, রাজ্যপাল বা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের মৃত্যুতেই শোকপালনের চিহ্ন হিসেবে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়। রাষ্ট্রমন্ত্রীদের মৃত্যু হলে জাতীয় পতাকা দিল্লিতে অর্ধনমিত রাখা হয় এবং মুখ্যমন্ত্রী বা রাজ্যপালের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট রাজ্যে তা করা হয়ে থাকে। বিকেলবেলা কোনো পদাধিকারীর মৃত্যুসংবাদ এলে এবং পরদিন সূর্যোদয়ের আগে তাঁর সৎকার সম্পূর্ণ না হলে পরদিন পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়।  নতুন নিয়ম অনুসারে পতাকা অর্ধনমিত করার আগে সেটিকে সম্পূর্ণরূপে উত্তোলন করে তারপর অর্ধনমিত করা হয়।

জাতীয় পতাকা সমস্ত দেশের মতোই ভারতেরও গর্ব। জাতীয় পতাকার প্রতি যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শন ভারতের প্রত্যেক নাগরিকের দায়িত্ব এবং কর্তব্য।

আপনার মতামত জানান