আমাদের ভারতবর্ষ অনেক ক্ষেত্রেই সংকীর্ণ মানসিকতার দেশ। উপযুক্ত যৌনশিক্ষার অভাবের কারণেই সমকামকে এদেশের সাধারণ মানুষ সহজ দৃষ্টিতে দেখেনি কখনও। এ ধরনের সম্পর্কে লিপ্ত থাকা মানুষেরা সামাজিক নানারকম হেনস্থার শিকার হয়েছেন বরাবরই এবং ভারতীয় সংবিধানের ৩৭৭ ধারাটি সমলিঙ্গের সম্পর্ককে অপরাধ হিসেবে গণ্য করত এতদিন। সেই কারণে নৃত্যশিল্পী নভতেজ সিং জোহার-সহ মোট পাঁচজন ৩৭৭ ধারাটির সাংবিধানিকতাকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ জানিয়ে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। আবেদনকারীদের বক্তব্য ছিল যে, তাঁদের মতো সমকামীরা এই ধারাটির জন্য বহুবার হেনস্থার সম্মুখীন হয়েছেন এবং এই ৩৭৭ ধারা তাঁদের মৌলিক অধিকারে হস্তক্ষেপ করে এবং তাকে খর্ব করে। এই মামলার বিরোধিতা করেছিলেন অনেকেই, কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট ৩৭৭ ধারাকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করে সমকামীদের অধিকার এবং নিরুপদ্রব জীবনযাপনের নিশ্চয়তা প্রদান করেছিল। এই রায় নিঃসন্দেহে এক ঐতিহাসিক রায়।
২০১৬ সালের ২৭ এপ্রিল নভতেজ সিং জোহারের নেতৃত্বে ভারতীয় দন্ডবিধির ৩৭৭ ধারার সাংবিধানিকতাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে ভারতের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিলেন কয়েকজন। আবেদনকারীরা ২০১৩ সালের কৌশাল বনাম নাজ মামলার প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছিলেন। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৪, ১৫, ১৯ এবং ২১ লঙ্ঘনের জন্য ২০০৯ নাজ ফাউন্ডেশন ৩৭৭ ধারার সাংবিধানিকতাকে চ্যালেঞ্জ করেছিল। তখন অবশ্য সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছিল যে, ৩৭৭ ধারার অধীনে সম্মতিপ্রাপ্ত প্রাপ্তবয়স্কদের যৌন কার্যকলাপের জন্য শাস্তি প্রদান করলে তা এই ধরনের ব্যক্তিদের সমতা, গোপনীয়তা এবং ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অধিকার লঙ্ঘন করে। এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে ২০১৩ সালে সুরেশ কুমার কৌশাল আদালতের দ্বারস্থ হন এবং কৌশাল বনাম নাজ মামলায় আদালত ৩৭৭ ধারাকে সরাসরি অসাংবিধানিক ঘোষণা না করে বরং জানায় শুধুমাত্র সংসদই সমকামিতাকে অপরাধমুক্ত করতে পারে। ২০১৩ সালের সুপ্রিম কোর্টের এই রায়কেই চ্যালেঞ্জ করে ফের ২০১৬ সালে মামলা করে নভতেজ সিং জোহাররা। এখানে উল্লেখ্য যে, ২০১৭ সালের বিচারপতি কে এস পুট্টস্বামী বনাম ভারত ইউনিয়ন মামলায় আদালত সর্বসম্মতভাবে সংবিধানের গোপনীয়তার অধিকারকে নিশ্চিত করেছে। এই মামলাটি খতিয়ে দেখে আদালত স্বীকার করেছিল যে, যৌন অভিযোজন একজন ব্যক্তির গোপনীয়তারই একটি অংশ। নভতেজ সিং জোহার মামলার রায় ঘোষণার পথ প্রশস্ত করেছিল এই পুট্টস্বামী বনাম ভারত ইউনিয়ন মামলাটি।
১৫৩৩ সালে রাজা সপ্তম হেনরির নেতৃত্বে ইংল্যান্ডে পাশ হয়েছিল এই ৩৭৭ ধারার আইনটি। এই আইনানুসারে সমকাম এবং পশুদের সঙ্গে যৌন কার্যকলাপ অপ্রাকৃত এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এদেশে ব্রিটিশ আধিপত্যের ফলে তাদের হাত ধরেই ৩৭৭ ধারার অনুপ্রবেশ ঘটেছিল ভারতে। তারপর এই ধারাকে অসাংবিধানিক করবার জন্য লড়াই করেও ব্যর্থ হয়েছিল নাজ ফাউন্ডেশন। অবশেষে প্রধান আবেদনকারী নর্তকি এবং এলজিবিটি সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত নভতেজ সিং জোহার ভারতীয় সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদ অনুসারে একটি রিট পিটিশন দায়ের করেন আদালতে। তাঁর সঙ্গে আরও যে কজন আবেদনকারী ছিলেন তাঁরা হলেন সাংবাদিক সুনীল মেহরা, শেফ রিতু ডালমিয়া, হোটেল ব্যবসায়ী আমান নাথ, কেশব সুরি এবং ব্যবসায়ী আয়েশা কাপুর। আবেদনকারীদের মূল বক্তব্যগুলি সূত্রাকারে দেখে নেওয়া যাক –
আবেদনকারীর মতে যৌন সঙ্গী নির্বাচনের অধিকার এবং যৌন স্বায়ত্তশাসনের অধিকার ভারতের সংবিধানের ২১ অনুচ্ছেদের আওতায় আসা উচিত। তাছাড়া ৩৭৭ ধারার কারণে ২১ অনুচ্ছেদে বর্ণিত গোপনীয়তার অধিকার এলজিবিটি সম্প্রদায়ের মানুষদের ক্ষেত্রে প্রহসনে পরিণত হয়েছে।
আবেদনকারীরা এও বলেন যে, এই ৩৭৭ ধারাটি ভারতীয় সংবিধানের ১৪ এবং ১৫ অনুচ্ছেদকে লঙ্ঘন করে। ১৫ অনুচ্ছেদে বৈষম্যকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে ফলে আবেদনকারীরা যৌনতার ক্ষেত্রে এরূপ বৈষম্য এবং হেনস্তা কেন সেই প্রশ্ন তোলে আদালতের সামনে। অনুচ্ছেদ ১৪ তে বর্ণিত আছে সমতার অধিকার, কিন্তু সেই অনুচ্ছেদে অপ্রাকৃতিক শারীরিক মিলনকে সংজ্ঞায়িত করা হয়নি। আবেদনকারীদের মতে, প্রাকৃতিক এবং অপ্রাকৃত সম্মত যৌনতার মধ্যে কোন বোধগম্য পার্থক্য বা যুক্তিসঙ্গত শ্রেণীবিভাগ ছিল না অনুচ্ছেদ ১৪-এর মধ্যে। অতএব এটি ভীষণই অস্পষ্ট একটি যুক্তি। এছাড়াও অনুচ্ছেদ ১৯-এ বর্ণিত মত প্রকাশের স্বাধীনতাকেও ৩৭৭ খর্ব করেছে বলে দাবি জানান আবেদনকারী দল। যেহেতু যৌনসঙ্গী পছন্দের মাধ্যমে নিজের যৌন পরিচয় স্বচ্ছন্দে তুলে ধরায় এবং সে বিষয়ক মতপ্রকাশের প্রধান অন্তরায় এই ৩৭৭ ধারা, অতএব এটি যে অনিবার্যভাবে ১৯ অনুচ্ছেদ লঙ্ঘন করে তা জোর দিয়ে উপস্থাপন করেছিলেন আবেদনকারীরা। অতএব জোরালো যুক্তি সহকারে নভতেজ সিং-এর দল সমকামীদের অধিকারকে মর্যাদাসহ প্রতিষ্ঠা দেওয়ার জন্য আদালতকে যে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিল তা সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ এক ঘটনা। আবেদনকারীরা জানিয়েছিল যে, সুরেশ কুমার কৌশাল বনাম নাজ মামলায় সমকামকে প্রকৃতির বিরুদ্ধে বলা হয়েছিল কিন্তু এর প্রকৃত অর্থ কী তা বর্ণনা করা হয়নি সেই মামলায় এবং ৩৭৭-এর শাস্তিযোগ্য অপরাধ অংশটিকে বহাল রেখে এলজিবিটি সম্প্রদায়ের মানুষদের মৌলিক অধিকারকে খর্ব করা হয়েছিল।
অবশ্য বিপক্ষে দাঁড়িয়ে থাকা সরকার পক্ষের আইনজীবী আবেদনকারীদের উত্থাপিত অভিযোগগুলিরও পাল্টা জবাব দিয়েছিলেন। বিপক্ষের যুক্তি ছিল, প্রথমত, ৩৭৭ সংবিধানের ১৪ অনুচ্ছেদকে লঙ্ঘন করে না, কারণ এটি শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট অপরাধ ও শাস্তিকে সংজ্ঞায়িত করে এবং আইনের উদ্দেশ্যে কাকে শ্রেণী হিসেবে নির্ধারণ করা হবে সে ক্ষমতা রয়েছে রাষ্ট্রের হাতে।
তাঁরা আরও বলেন ৩৭৭ ধারা ১৫ অনুচ্ছেদটিকেও লঙ্ঘন করে না কারণ উল্লিখিত অনুচ্ছেদটি ধর্ম, জাতি, লিঙ্গ, জন্মস্থান, বর্ণের উপর ভিত্তি করে বৈষম্যকে নিষিদ্ধ করে কিন্তু যৌন অভিমুখিতা বিষয়ে সেখানে বিশেষভাবে কিছু বলা নেই। বিপক্ষের আইনজীবীরা ‘অস্বাভাবিক’ যৌনকর্মে লিপ্ত ব্যক্তিদের এইডস সংক্রমণ এবং তার বিস্তারের জন্যও দায়ী করেছিলেন সরাসরি। এইডসের বদলে তাদের গোপনীয়তার অধিকার বাড়িয়ে দেওয়া চলে না বলেই মত তাঁদের। সরকারী আইনজীবীরা আরও বলেন যে, ৩৭৭ ধারার অধীন অপরাধটি যৌন বিকৃতিকে বোঝায় এবং দুই ব্যক্তির মধ্যে শারীরিক মিলন যা আপত্তিকর, ক্ষতিকর এবং প্রকৃতির নিয়মের বিরুদ্ধে; এটির উপর যুক্তিসঙ্গত বিধিনিষেধ আরোপ করা রাষ্ট্রের এক্তিয়ারের মধ্যে পড়ে। তাঁরা বলেন যে, এই ধরনের যৌন সম্পর্ক পারিবারিক ব্যবস্থাকে ধ্বংস করবে এবং বিবাহের প্রতিষ্ঠানটিকেও ক্ষতিকারকভাবে প্রভাবিত করবে। ৩৭৭ ধারাকে অসাংবিধানিক করার জন্য জমা দেওয়া পিটিশনের বিরোধিতা করেছিল অ্যাপোস্টোলিক অ্যালায়েন্স অফ চার্চেস, উৎকল খ্রিস্টান কাউন্সিল এবং ট্রাস্ট গড মিনিস্ট্রিজ। প্রথম দুইজনের প্রতিনিধিত্ব করেন অ্যাডভোকেট মনোজ জর্জ এবং তৃতীয়টির আইনজীবী ছিলেন কে এস রাধাকৃষ্ণান। এনডিএ সরকার একটি নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়েছিল এই মামলায়।
বাদী ও বিবাদী পক্ষের আইনজীবীদের সওয়াল জবাব ও দীর্ঘ শুনানির পর ২০১৮ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট যে রায় জানিয়েছিল তা নিঃসন্দেহে এক ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত ছিল। এই মামলার দায়িত্ব ছিল মোট পাঁচজন বিচারপতি সম্বলিত একটি বেঞ্চের হাতে। প্রধান বিচারপতি ছিলেন দীপক মিশ্র এবং বাকি চার বিচারপতি হলেন, এ এম খানউইলকর, ডিওয়াই চন্দ্রচূড়, আরএফ নরিমান এবং ইন্দু মালহোত্রা।
প্রথমত আদালত সুরেশ কুমার কৌশাল বনাম নাজ ফাউন্ডেশনের রায়টিকে বাতিল করেছিল কারণ সেই মামলাটিতে ৩৭৭-এর সাংবিধানিকতা খর্ব করা হয়নি। নভতেজ সিং মামলার পর আদালত দেখেছে যে, সম্মতিপ্রাপ্ত প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে যৌন ক্রিয়াকলাপের অপরাধীকরণ ভারতের সংবিধান দ্বারা নিশ্চিত করা সমতার অধিকার লঙ্ঘন করে। এছাড়াও ৩৭৭ ধারাটি এলজিবিটি সম্প্রদায়ের মানুষদের মানবিক মর্যাদা এবং তাদের ব্যক্তিগত পছন্দকে খর্ব করে, তাদের গোপনীয়তার অধিকার লঙ্ঘন করে যা ধারা ২১ এর অধীনে অন্তর্ভুক্ত। আদালত জানায় যে, ৩৭৭ ধারা বজায় রাখার মূল উদ্দেশ্য হল, নারী এবং শিশুদের যৌন নির্যাতন থেকে রক্ষা করা কিন্তু এলজিবিটিদের সম্মতিমূলক শারীরিক মিলন নারী ও শিশুদের পক্ষে ক্ষতিকর নয়। তাছাড়া অসম্মতিমূলক কাজগুলিকে ইতিমধ্যেই ৩৭৫ ধারার অধীনে অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করা আছে। ফলে ৩৭৭ সমাজের একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের জন্য অপ্রয়োজনীয় এবং বৈষম্যমূলক এবং তা অনুচ্ছেদ ১৪-কেও লঙ্ঘন করে, ফলে ৩৭৭কে অসাংবিধানিক ঘোষণা করাই যুক্তিযুক্ত বলে মনে করেছে আদালত। এখানে উল্লেখ্য যে, ৩৭৭ থেকে সমকামের অপরাধীকরণ অংশটুকুকেই অসাংবিধানিক বলে রায় দিয়েছিল আদালত, কিন্তু অসম্মতিমূলক যৌন ক্রিয়াকলাপ যেমন ধর্ষণ এবং পাশবিকতা ইত্যাদি অংশগুলি বলবৎ থাকে৷
বিচারপতি ইন্দু মালহোত্রা বলেছিলেন সমকাম যে সম্পূর্ণ একটি প্রাকৃতিক ব্যপার এ বিষয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অজ্ঞতা রয়েছে। দীপক মিশ্রের ভাষায় ৩৭৭ ধারাটি একটি স্বেচ্ছাচারী ধারা, কারণ এটি এলজিবিটি সম্প্রদায়কে তাদের মৌলিক অধিকারগুলি উপভোগ করা থেকে বিরত রাখে এবং এই ধারাটি এলজিবিটি সম্প্রদায়কে লক্ষ্যবস্তু করতে এবং তাদের হয়রানি করার অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে যা একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয় ফলত, দীপক মিশ্রের বেঞ্চ রায় দেয়, যে, ভারতের এলজিবিটি সম্প্রদায় ভারতের সংবিধান দ্বারা সুরক্ষিত স্বাধীনতা সহ সমস্ত সাংবিধানিক অধিকারের অধিকারী হবে। রায়ে আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে এলজিবিটি সম্প্রদায় বৈষম্য ছাড়াই আইনের অধীনে সমান নাগরিকত্ব এবং সুরক্ষা পাওয়ার অধিকারী।
সুরেশ কৌশাল জানিয়েছিলেন মোট জনসংখ্যার একটি ক্ষুদ্র ভগ্নাংশই কেবল এলজিবিটি সম্প্রদায়। কিন্তু নভতেজ সিং মামলায় আদালত পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দেয় সংবিধান প্রণেতাদের কখনই এই উদ্দেশ্য ছিল না, যে মৌলিক অধিকারগুলি শুধুমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠের সুবিধার জন্য প্রসারিত করা হবে। প্রধান বিচারপতির কথায় সুরেশ কুমার কৌশল মামলায় প্রদত্ত দৃষ্টিভঙ্গি ভুল ছিল এবং এটি সাংবিধানিক নীতিরও পরিপন্থী এবং আদালতের দায়িত্ব সমস্ত সম্প্রদায় নির্বিশেষে এই দেশের প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার রক্ষা করা।
অতএব ৩৭৭ ধারাকে আংশিকভাবে অসাংবিধানিক ঘোষণা করে সুপ্রিম কোর্ট এলজিবিটি সম্প্রদায়ের মানুষদের মৌলিক অধিকার সুরক্ষিত করেছে, তাঁদের দিয়েছে চিন্তামুক্ত এক জীবন। এই রায় ভারতীয় বিচারের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকবে।