পিঙ্গালি ভেঙ্কাইয়া

পিঙ্গালি ভেঙ্কাইয়া

পিঙ্গালি ভেঙ্কাইয়া (Pingali Venkayya) ছিলেন একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং ভারতের জাতীয় পতাকার নকশাকার বা রূপকার। ভূবিদ্যা এবং কৃষিবিদ্যাতেও ছিল তাঁর অসামান্য দক্ষতা।

যদিও ভারতের জাতীয় পতাকার প্রকৃত নকশাকার কে এই নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। তবে একথা ঠিক যে, ভারতের জাতীয় পতাকার নকশাকার হিসেবে পিঙ্গালি ভেঙ্কাইয়ার নাম সর্বাধিক আলোচিত হয়েছে।

১৮৭৬ সালের ২ আগস্ট অন্ধ্রপ্রদেশের  (Andhra Pradesh) মছলিপত্তনমের (Machilipatnam) ভাটলাপেনুমারু (Bhatlapenumarru) গ্রামে পিঙ্গালি ভেঙ্কাইয়ার জন্ম হয়। তাঁর বাবার নাম পিঙ্গালি হনুমন্ত রায়াডু এবং মায়ের নাম ভেঙ্কট রত্নাম্মা। ছেলেবেলা থেকেই তিনি ছিলেন যথেষ্ট মেধাবী। আর্থিক সঙ্কট কখনও তাঁর পড়াশোনার পথে বাধা হয়ে উঠতে পারেনি। গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মছলিপত্তনমের উচ্চ বিদ্যালয়ের থেকে শিক্ষা গ্রহণের পর তিনি ভূতত্ত্ববিদ্যা নিয়ে  সিলনে পড়তে যান। পরে সেখান থেকে মুম্বইতে যান। কিছুদিন পড়াশোনার পরে অস্ত্র চালানো শিখে মাত্র ঊনিশ বছর বয়সে যোগ দেন ইংরেজ সেনাবাহিনীতে। আফ্রিকায় তখন নতুন করে শুরু হয়েছে ইঙ্গ-আফ্রিকান ‘বোয়ের যুদ্ধ’। ভেঙ্কাইয়া সেই যুদ্ধে সৈনিক হিসেবে অংশগ্রহণ করেন। সেখানেই গাঁধীজির সঙ্গে প্রথম পরিচয়। এক দিকে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ আর অন্যদিকে মানবতাবাদী অহিংস ধর্মের পাঠ। দুই ভিন্নধর্মী চিত্র প্রভাব ফেলেছিল তাঁর ব্যক্তিত্বে।
ক্রমে গাঁধীজীর আদর্শে অনুপ্রাণিত হন  তিনি। দেশে ফিরে তিনি রেলের গার্ডের চাকরিতে যোগদান করেন। কিন্তু পরবর্তীকালে এই চাকরি ছেড়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন মাদ্রাজের প্লেগ দুর্গত মানুষজনের সাহায্যে। তবে একই সঙ্গে পড়াশোনাও চালিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। মাতৃভাষা তেলুগু আর হিন্দির পাশপাশি, লাহোরের অ্যাংলো বৈদিক কলেজ থেকে শিখে নিয়েছিলেন উর্দু, সংস্কৃত এবং জাপানি ভাষা। ১৯০৪ সালে রাশিয়া-জাপান যুদ্ধে জাপানের সংগ্রাম দেখে অভিভূত হয়ে ভেঙ্কাইয়া জাপানের ইতিহাস, সাধারণ মানুষের জীবন ও দর্শন সম্পর্কে জানতে আগ্রহী হয়েছিলেন। আর এর জন্যই তিনি জাপানি ভাষা শিখতে শুরু করলেন। তাই অনেকে তাঁকে ‘জাপানি ভেঙ্কাইয়া’ বলে ডাকতেন। 

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

ভারতীয় কৃষি গবেষণার ক্ষেত্রেও তাঁর অবদান রয়েছে। ১৯১৮- ১৯১৯‌ সালে গাঁধীজীর নেতৃত্বে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে খাদি আন্দোলনের সূচনা হয়। বিভিন্ন জায়গায় শুরু হয়েছিল স্বদেশী কাপড় তৈরি ও তুলো উৎপাদনের কাজ। যদিও কাপড় তৈরীর জন্য উন্নত মানের কাপাস তুলোর যথেষ্ট অভাব ছিল। সেই সময় সম্পূর্ণ নিজের উদ্যোগে আমেরিকা থেকে কম্বোডিয়ান জাতের তুলো বীজ নিয়ে এসে ভারতীয় বীজের সঙ্গে সংকরায়ণ ঘটিয়ে পিঙ্গালি ভেঙ্কাইয়া তৈরি করেছিলেন উন্নতমানের তুলো বীজ। তাই তিনি পরিচিত হয়েছিলেন ‘পট্টি ভেঙ্কাইয়া’ নামে। কৃষিক্ষেত্রে তাঁর এই গবেষণার জন্য তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে তিনি ‘রয়্যাল সোসাইটি অব এগ্রিকালচার’-এর আজীবন সদস্যপদ লাভ করেছিলেন।

তবে পিঙ্গালি ভেঙ্কাইয়া জীবনে সব থেকে বেশি পরিচিত হয়েছিলেন ‘ঝাণ্ডা ভেঙ্কাইয়া’ হিসেবেই। কারণ ১৯০৬ সালের জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনের পর পিঙ্গালি ভেঙ্কাইয়া কংগ্রেস দলের কার্যবাহী কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর থেকেই কংগ্রেসের প্রায় প্রতিটি অধিবেশনেই তিনি নিয়ম করে প্রশ্ন তুলতেন ব্রিটিশ পতাকার প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে। শুধু তাই নয়, ১৯১৬ সালে দেশের নানা প্রান্ত থেকে তথ্য সংগ্রহ করে বহু পরিশ্রমে বানিয়েছিলেন স্বাধীন ভারতের জন্য সম্ভাব্য তিরিশটি পতাকার ক্যাটালগ বা তালিকাসূচী। গাঁধীজীর আদর্শে বিশ্বাসী ভেঙ্কাইয়া চেয়েছিলেন স্বাধীন ধর্মনিরপেক্ষ ভারতবর্ষের জন্য একটি ভাষা ও একটি ধর্মনিরপেক্ষ প্রতীক। তাই তাঁর ক্যাটালগের অধিকাংশ পতাকার নকশা তৈরি করা হয়েছিল মূলত ভাষা, ধর্ম ও আঞ্চলিক প্রতীক চিহ্নের মতো তিনটি বিষয়ের উপরে নির্ভর করে। দেশের প্রধান আটটি ধর্মের জন্য তিনি ব্যবহার করেছিলেন রামধনুর অনুকরণে সমান্তরালে বিন্যস্ত আটটি পৃথক বর্ণ। এছাড়াও ছিল দেশের প্রধান, অপ্রধান উনিশটি ভাষার জন্য উনিশটি পাঁচ বাহু বিশিষ্ট তারা। বিভিন্ন ধর্মের জন্য তিনি বেছে নিয়েছিলেন বিভিন্ন রং ও চিহ্ন। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে জনপ্রিয় পদ্মফুল, ময়ূর, তীর-ধনুক, লাঙল, কৈলাস পর্বতের মতো নানা প্রতীক চিহ্ন স্থান পেয়েছিল তাঁর তৈরি ক্যাটালগে। তিনি স্বাধীন ভারতের বিভিন্ন জাতীয় উৎসবের জন্যও তৈরি করেছিলেন বিশেষ কয়েকটি ধরনের পতাকার নকশা।

১৯২১ সালের মার্চ মাসে জাতীয় কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় সন্মেলনে পিঙ্গলি ভেঙ্কাইয়াই প্রথম ভারতের একটি স্বতন্ত্র পতাকার প্রস্তাব পেশ করেন। পিঙ্গলি ভেঙ্কাইয়ার সেই প্রস্তাবকে সমর্থন করেছিলেন ‘জাতির জনক’ মহাত্মা গান্ধী। এরপর কংগ্রেসের পক্ষ থেকে তাঁকেই জাতীয় পতাকার নকশা তৈরির জন্য অনুরোধ করা হলে তিনি তাতে সম্মত হন।

জাতীয় পতাকার নকশা তৈরি করার জন্য পিঙ্গলি ভেঙ্কাইয়া প্রথমে বেছে নিয়েছিলেন দুটি রঙ। একটি গেরুয়া এবং অন্যটি সবুজ। জাতীয় পতাকার প্রথম নকশায় সাদা রঙের উল্লেখই ছিল না। গেরুয়া এবং সবুজ, দুই রঙা জাতীয় পতাকা তৈরির কথাই গান্ধীজীকে জানান পিঙ্গলি ভেঙ্কাইয়া। পরে জাতীয় পতাকায় গেরুয়া এবং সবুজের মাঝে সাদা রঙের অন্তর্ভুক্তি করেন তিনি।

১৯২৩ সালে জালিয়ানওয়ালা বাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে শুরু হওয়া অন্দোলনে প্রথম বারের জন্য উত্তোলিত হয় ভেঙ্কাইয়ার নকশা করা পতাকা। লাল, সাদা ও সবুজ বর্ণে শোভিত সেই পতাকার কেন্দ্রে ছিল ভারতের স্বনির্ভরতার অন্যতম প্রতীক চরকা। স্বাধীনতার সময়ে যখন জাতীয় পতাকা নিয়ে চিন্তা ভাবনা শুরু হল তখন পিঙ্গালি ভেঙ্কাইয়ার তৈরি পতাকাকেই ভিত্তি হিসেবে ধরা হয়েছিল। জওহরলাল নেহরু, সর্বোপল্লি রাধাকৃষ্ণণ, সরোজিনী নাইডু, আম্বেডকরের মতো ব্যক্তিরা অনেক অলোচনার পরে স্থির করেছিলেন জাতীয় পতাকায় লাল রঙের পরিবর্তে ব্যবহার করা হবে গেরুয়া। আর চরকার জায়গায় স্থান পেয়েছিল অশোকচক্র। 

তাই পরবর্তীকালে পিঙ্গলি ভেঙ্কাইয়াকৃত ত্রিবর্ণরঞ্জিত পতাকার  কেন্দ্রস্থলে চরকার পরিবর্তে অশোক চক্র ব্যবহৃত হয়। ভারতের পতাকা গেরুয়া, সাদা‌ ও সবুজ এই তিনটি বর্ণে রঞ্জিত। এর কেন্দ্রে রয়েছে ২৪টি দন্ডযুক্ত নীল বর্ণের অশোক চক্র। ১৯৪৭ সালের ২২ জুলাই গণপরিষদের একটি অধিবেশনে  পতাকার বর্তমান রূপটি ভারতে সরকারি পতাকা হিসেবে গৃহীত হয়েছিল। পরবর্তীকালে এই পতাকা ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের জাতীয় পতাকার মর্যাদা লাভ করে। ১৯৪৭ সালের ১৫ অগাস্ট স্বাধীন ভারতে অশোক চক্র সমন্বিত ত্রিবর্ণ রঞ্জিত এই পতাকা প্রথম বার উত্তোলিত হয়। স্বাধীন ভারতের এই পতাকায় গেরুয়া রং ত্যাগের প্রতীক, সবুজ রং সমৃদ্ধির প্রতীক এবং সাদা রং শান্তির প্রতীক ও অশোক চক্র সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতার প্রতীক।

পিঙ্গলি ভেঙ্কাইয়া ছিলেন একজন শিক্ষাবিদ। তাই একজন শিক্ষাবিদ হিসেবে তিনি নিজের জন্মস্থান মছলিপত্তনমে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরি করেছিলেন।

কিন্তু স্বাধীনতা আন্দোলনের পথিকৃৎ পিঙ্গালি ভেঙ্কাইয়া জীবনসায়াহ্নে  অবহেলায় ও হত দরিদ্র অবস্থায় দিনযাপন করতেন। এমনকি তাঁর নিজের দল অর্থাৎ কংগ্রেসও তাঁকে ভুলে গিয়েছিল। অবশেষে ১৯৬৩ সালের ৪ জুলাই পিঙ্গলি ভেঙ্কাইয়ার মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৬ বছর।

২০১১ সালে ভারত সরকার জাতীয় পতাকার রূপকার পিঙ্গলি ভেঙ্কাইয়াকে মরনোত্তর ভারতরত্ন দেওয়ার প্রস্তাব গ্রহণ করে। যদিও পরবর্তী পর্যায়ে এর ফল কি হয়েছিল তা জানা যায়নি। ২০০৯ সালে তাঁর স্মৃতি রক্ষার্থে একটি ডাকটিকিট প্রকাশ করা হয়েছিল।

One comment

আপনার মতামত জানান