ভারতীয় গণিতজ্ঞ এবং বিশিষ্ট গ্রন্থাগারিক শিয়ালী রামামৃতা রঙ্গনাথন (Siyali Ramamrita Ranganathan) গ্রন্থাগার বিজ্ঞানের পঞ্চ আইন তৈরিতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন। বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার বিজ্ঞানের অধ্যাপক রঙ্গনাথন ভারতে গ্রন্থাগার বিজ্ঞান এবং তথ্যায়নের জনক হিসেবেই অধিক পরিচিত। প্রতি বছর সারা ভারত জুড়ে তাঁর জন্মদিনে পালিত হয় জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস। গ্রন্থাগারে বই কীভাবে সাজিয়ে রাখা হবে, কীভাবে বইয়ের বিভাজন করা হবে সেই পদ্ধতিও আবিষ্কার করেন তিনি। ‘লাইব্রেরি অ্যাসোসিয়েশন অফ গ্রেট ব্রিটেন’-এর সহ-সভাপতি পদে আজীবন আসীন ছিলেন শিয়ালী রামামৃতা রঙ্গনাথন।
১৮৯২ সালের ৯ আগস্ট ব্রিটিশ-শাসিত ভারতে তামিলনাড়ুর তাঞ্জোভুর জেলার অন্তর্গত শিয়ালীতে শিয়ালী রামামৃতা রঙ্গনাথনের জন্ম হয়। অনেকের মতে তাঁর জন্মদিন হল ১২ আগস্ট এবং এই দিনটিতেই ভারতে গ্রন্থাগার বিজ্ঞানে তাঁর অপরিসীম অবদানের কথা মাথায় রেখে জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস পালিত হয় কিন্তু নিজের বইতে রঙ্গনাথন জন্মদিন হিসেবে ৯ আগস্ট দিনটিকেই স্বীকৃতি দিয়েছেন। তাঁর বাবার নাম ছিল রামামৃতা আইয়ার এবং মায়ের নাম সীতালক্ষ্মী।
শিয়ালীর হিন্দু হাই স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় রঙ্গনাথনের। এরপরে মাদ্রাজ ক্রিশ্চিয়ান কলেজ থেকে ১৯১৩ সালে গণিতে স্নাতক এবং ১৯১৬ সালে গণিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন তিনি। তাঁর ছোটোবেলা থেকেই ইচ্ছে ছিল গণিতের অধ্যাপনা করার। সেই লক্ষ্যে তিনি সবসময় শিক্ষকতার অনুমতিপত্র জোগাড় করার চেষ্টা করতেন এবং ১৯১৭ সালে মাদ্রাজের টিচার্স কলেজ থেকে লাইসেন্সিয়েট ইন টিচিং বা এল.টি লাভ করেন।
১৯২১ থেকে ১৯২৩ সালের মধ্যে ম্যাঙ্গালোর, মাদ্রাজ এবং কোয়েম্বাটোর বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন গণিত শিক্ষক হিসেবে অধ্যাপনা করেছেন রঙ্গনাথন। সেইসময় সমান যোগ্যতার পদেও ইংরেজ অধ্যাপকদের তুলনায় অনেক কম বেতন দেওয়া হতো ভারতীয়দের এবং এই বিষয়ে বহু জায়গায় প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন তিনি। ১৯২৩ সালে মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রন্থাগারিক পদ খালি হয় যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগ্রহের অত্যন্ত সাধারণ মানের বইগুলির রক্ষণাবেক্ষণ আর গ্রন্থাগারের মানোন্নয়নের কাজই ছিল প্রধান। ১৯২৪ সালে সেই পদে যোগ দিয়ে রঙ্গনাথনের কর্মজীবন শুরু হয়। সেই পদে নয়শো জন আবেদনকারীর মধ্যে কেউই প্রায় গ্রন্থাগারিকের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছিলেন না। কিন্তু রঙ্গনাথনের গবেষণার নথিপত্র দেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিটির পছন্দ হলে তিনিই এই পদে কাজের সুযোগ পান। ইন্টারভিউর আগের দিনই এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার গ্রন্থাগার বিষয়ক একটি প্রবন্ধ পড়ে তাঁর উপযুক্ত ধারণা হয়েছিল। প্রথমদিকে এই কাজের মধ্যে বেশ বিরক্ত বোধ করতেন রঙ্গনাথন, একঘেয়ে লাগতো তাঁর কাজগুলি। একা একা গ্রন্থাগারের মধ্যে কাজ করতে করতে বিরক্ত হয়ে তিনি পুনরায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিটির কাছে আবেদন করেন শিক্ষকের পদে পুনর্বহাল হওয়ার জন্য। ঠিক সেই সময় বিশ্ববিদ্যালয় এই মর্মে একটি চুক্তি করেন রঙ্গনাথনের সঙ্গে যে, তিনি প্রথমে লণ্ডন থেকে সমসাময়িক গ্রন্থাগারিকের পশ্চিমি প্রশিক্ষণ বিষয়ে পড়াশোনা করতে যাবেন এবং যদি সেই পড়াশোনা তাঁর ভালো না লাগে, দেশে ফিরে তিনি পুনরায় গণিতের অধ্যাপনা করতে পারেন। সেইমতো লণ্ডনের ইউনিভার্সিটি কলেজে যান এবং সমগ্র ব্রিটেনের মধ্যে একমাত্র সেখানেই তখন গ্রন্থাগার বিজ্ঞানে শুধুমাত্র স্নাতক স্তরের পড়াশোনা করানো হতো। সেই ইউনিভার্সিটি কলেজে একটি বিষয় ব্যতিরেকে অন্যান্য সকল বিষয়ে তিনি দারুণ কিছু ফল করেননি। বরং ঐ একটি বিষয় অর্থাৎ ‘বিন্যাসকরণ’-এ রঙ্গনাথন তাঁর গণিতের প্রতিভাকে কাজে লাগিয়েছিলেন। সেকালে জনপ্রিয় ডেসিমাল ক্লাসিফিকেশনের ত্রুটিগুলি সম্পর্কে তিনি বেশি করে মনোনিবেশ করেন এবং এই পদ্ধতির আরো নানা সম্ভাবনার দিকগুলি নিয়ে নিজেই চিন্তা করতে শুরু করেন তিনি।
গ্রন্থাগার বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে রঙ্গনাথন ‘অ্যাকনলেজমেন্ট অফ ডুপ্লিকেশন’-এর তত্ত্ব নির্মাণ করেন, যে তত্ত্ব অনুযায়ী তথ্য বিন্যাসের যে কোনো পদ্ধতিতেই প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে ন্যূনতম দুটি পৃথক বিন্যাস থাকা উচিত। তিনি ঘটনাচক্রে এই পুরো তত্ত্বটি ডিওয়ে ডেসিমাল ক্লাসিফিকেশনের সাহায্যে ব্যাখ্যা করেন। সেইজন্যে রঙ্গনাথন অনেকগুলি বই নিয়ে দেখান কীভাবে দুটি সম্পূর্ণ পৃথক ডিডিসি নম্বরের সাহায্যে দুভাবে সেই বইগুলিকে বিন্যস্ত করা যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ তিনি বলেন, ভারতের যুদ্ধ বিষয়ক বইগুলি যুদ্ধ বিভাগেও রাখা যেতে পারে আবার ভারত বিভাগেও রাখা যেতে পারে। তিনি দেখিয়েছেন যে ঐ একইভাবে একটি সাধারণ যুদ্ধের বইকে যুদ্ধ, ইতিহাস, সামাজিক সংগঠন, ভারতীয় প্রবন্ধ ইত্যাদি নানা বিভাগে রাখা যেতে পারে যেখানে মূলত যিনি বিন্যাস করছেন তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাপকভাবে ক্রিয়াশীল। তথ্য-পুনরুদ্ধার বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তাঁর আবিষ্কৃত এই পন্থা খুব দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং তা যথেষ্ট ক্রিয়াশীল হয়। ইংল্যাণ্ডে থাকাকালীনই এই সমস্ত পদ্ধতিটিকে তিনি লিপিবদ্ধ করে রাখতে শুরু করেন যা পরে ‘কোলোন ক্লাসিফিকেশন’ নামে পরিচিত হয়। এই গবেষণা করে তিনি দেশে ফিরে আসেন। জানা যায় এই পুরো সংগঠনটা তিনি লণ্ডনের একটি খেলনার দোকানে ‘মেকানো’ নামের একটি খেলনা দেখেই আবিষ্কার করেছিলেন। যে কাজের প্রতি একসময় বিরক্ত হয়ে পড়েছিলেন রঙ্গনাথন, সেই কাজের প্রতিই অনুরক্ত এবং স্থিতপ্রজ্ঞ হয়ে তিনি ভারতের জন্য উন্নতমানের গ্রন্থাগার তৈরির চিন্তা নিয়ে দেশে ফিরে আসেন। এরপর দীর্ঘ কুড়ি বছর যাবৎ মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ে রঙ্গনাথন গ্রন্থাগারিকের পদে আসীন ছিলেন আর এই বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারিক থাকাকালীন উন্নত গ্রন্থাগারের প্রকৃতি কেমন হওয়া উচিত সে ব্যাপারে কিছু নীতি প্রণয়ন করেন যা ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারেও প্রয়োগ করেন তিনি। সেগুলির মধ্যে সকাল আটটা থেকে রাত্রি আটটা পর্যন্ত গ্রন্থাগার খোলা রাখা, গ্রন্থাগারের মধ্যে উপযুক্ত পরিবেশ বজায় রাখা, প্রয়োজনে বই বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করা, বিশেষ সম্প্রদায়ের স্বাভাবিক চাহিদা অনুযায়ী বইয়ের সম্ভারকে বিন্যস্ত করা ছাড়াও ঐ গ্রন্থাগারে শুধুমাত্র গবেষক-পাঠকদের সহায়তা করার জন্য তিনি নতুন একটি পদ চালু করেন যার নাম –‘পিএআরএস’ অর্থাৎ পার্সোনালাইজড অ্যাসিসট্যান্স টু রিসার্চ স্কলারস। ১৯২৮ সালে তিনি ‘মাদ্রাজ লাইব্রেরি অ্যাসোসিয়েশন’ গড়ে তুলতে সহায়তা করেন এবং সমগ্র ভারতবর্ষে সাধারণ মানুষদের জন্য বিনামূল্যে গ্রন্থাগার পরিষেবা চালু করার কথা বলেন। একইসঙ্গে বিরাট বড়ো মাপের জাতীয় গ্রন্থাগার নির্মাণের প্রস্তাব দিয়েছিলেন তিনি। এই মাদ্রাজ লাইব্রেরি অ্যাসোসিয়েশনের উদ্যোগে সমগ্র মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি, মহীশূর জুড়ে গ্রন্থাগার আন্দোলন চালু করেছিলেন রঙ্গনাথন। জানলে অবাক হতে হয় যে, দুই দশক টানা মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি দৈনিক তেরো ঘন্টা করে কাজ করতেন, এমনকি কোনো ছুটিও নিতেন না তিনি। শোনা যায় ১৯২৮ সালে বিয়ের পরদিন রাতেই তিনি পুনরায় কাজে যোগ দিয়েছিলেন। এমন কাজপাগল মানুষ খুবই কম দেখা যায় ভারতের ইতিহাসে। মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করার সময়েই প্রথমে ১৯৩১ সালে ‘গ্রন্থাগার বিজ্ঞানের পঞ্চ আইন’ এবং ১৯৩৩ সালে ‘কোলোন বিন্যাস ব্যবস্থা’ নামে দুটি ভিন্নতর তত্ত্ব প্রণয়ন করেন তিনি। এই পঞ্চ আইন বলতে রঙ্গনাথন বুঝিয়েছেন – প্রথমত সব বইই ব্যবহারের জন্য, দ্বিতীয়ত প্রত্যেক পাঠকই একেকটি স্বতন্ত্র বই, তৃতীয়ত প্রত্যেক বইয়েরই একজন স্বতন্ত্র পাঠক আছে, চতুর্থত পাঠকের সময় বাঁচানো অবশ্যকর্তব্য এবং সর্বোপরি গ্রন্থাগার একটি বর্ধনশীল সংস্থা। সাধারণ মানুষের মধ্যে শিক্ষার বিস্তারের লক্ষ্যে তিনি গ্রন্থাগারকে সর্বজনীনভাবে উন্মুক্ত করার জন্য চেষ্টা করতে থাকেন। একটা ভালো লাইব্রেরি গড়ে তুলতে গেলে কখনোই অর্থকরীভাবে কার্পণ্য করা উচিত নয় বলে মনে করতেন রঙ্গনাথন।
মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৫৪ বছর বয়সে বাধ্য হয়ে গ্রন্থাগারিকের পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে ১৯৪৫ সালে শিয়ালী রামামৃতা রঙ্গনাথন বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রন্থাগার বিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। চার বছর কাজ করে প্রায় এক লক্ষ বই-জার্নাল বা পত্রিকার বিন্যাস করেছেন তিনি একেবারে নিজে হাতে। ১৯৪৪ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত ইণ্ডিয়ান লাইব্রেরি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি পদে আসীন ছিলেন রঙ্গনাথন। এরপর ১৯৪৯ থেকে ১৯৫৫ সালের মধ্যে তিনি দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্মানীয় অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন।
১৯৬২ সালে ব্যাঙ্গালোরের ইণ্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটের একটি বিভাগ ও গবেষণাকেন্দ্র হিসেবে রঙ্গনাথন গড়ে তোলেন ডকুমেন্টেশন রিসার্চ অ্যাণ্ড ট্রেনিং সেন্টার যেখানে দীর্ঘ পাঁচ বছর যাবৎ তিনি ডিরেক্টর পদে বহাল ছিলেন। তাঁর জীবৎকালে গ্রন্থাগার বিজ্ঞানের উপর অনেকগুলি বই লিখেছিলেন তিনি যার মধ্যে ‘দ্য ফাইভ ল’স অফ লাইব্রেরি সায়েন্স’-এর কথা আগেই বলা হয়েছে যা তিনি মাদ্রাজ ক্রিশ্চিয়ান কলেজের গণিতের শিক্ষক এডওয়ার্ড বার্ন্স রসকে উৎসর্গ করেছেন। এছাড়াও অন্যান্য বইগুলির মধ্যে ‘ক্লাসিফায়েড ক্যাটালগ কোড (১৯৩৪)’, ‘লাইব্রেরি অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (১৯৩৫)’, ‘প্রলেগোমেনা টু লাইব্রেরি ক্লাসিফিকেশন (১৯৩৭)’ ইত্যাদি অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য। যদিও তাঁর মৃত্যুর পরে রঙ্গনাথনের একটি আত্মজীবনী প্রকাশ পায় ১৯৯২ সালে যার নাম ‘এ লাইব্রেরিয়ান লুকস ব্যাক’।
১৯৫৭ সালে ভারত সরকার রঙ্গনাথনকে ‘পদ্মশ্রী’ পুরস্কারে সম্মানিত করে এবং পরে ১৯৬৫ সালে ভারতের ‘ন্যাশনাল রিসার্চ প্রফেসর’-এর সম্মানে ভূষিত হন শিয়ালী রামামৃতা রঙ্গনাথন।
১৯৭২ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ব্রঙ্কাইটিসে আক্রান্ত হয়ে শিয়ালী রামামৃতা রঙ্গনাথনের মৃত্যু হয়।
One comment