ছবি বিশ্বাস

ছবি বিশ্বাস

ছবি বিশ্বাস (Chhabi Biswas) ছিলেন ভারতীয় বাংলা সিনেমার এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। তিনি তাঁর চলচ্চিত্র জীবনে নিখুঁত অভিনয়ের মাধ্যমে দর্শকদের মন জিতে নিয়েছেন খুবই কম সময়ের মধ্যে। অ্যামেচার থিয়েটারে অভিনয় করার পাশাপাশি শিশির ভাদুড়ী ও নরেশ মিত্রের মতো বড় মাপের মঞ্চাভিনেতাদের সাথেও অভিনয় করেছেন। পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় অভিনয় করেছেন কালজয়ী সব বাংলা ছবিতে।

ছবি বিশ্বাসের জন্ম তারিখ ও জন্ম সাল নিয়ে রয়েছে দ্বিমত। অনেকে মনে করেন ১৯০০ সালে ছবি বিশ্বাসের জন্ম হয়। আবার অনেকের মত অনুসারে ১৯০২ সালে তাঁর জন্ম হয়। জন্ম তারিখ কারো মতে ১৩ জুলাই আবার কেউ মনে করেন ১২ জুলাই। তাঁর জন্ম হয় কলকাতার আহিরিটোলায়। ছবি বিশ্বাসের আসল নাম শচীন্দ্রনাথ বিশ্বাস (Shachindranath Biswas)। সম্ভ্রান্ত জমিদার বংশের ছেলে ছিলেন তিনি। তাঁর বাবার নাম ভূপতিনাথ বিশ্বাস (Bhupatinath Biswas) এবং মায়ের নাম কাত্যায়ানী বিশ্বাস (Katyayani Biswas)। ছবি বিশ্বাসের বাবা ছিলেন একজন সমাজ সেবক। চার ভাইয়ের মধ্যে সবথেকে ছোট ছিলেন শচীন্দ্রনাথ অর্থাৎ ছবি বিশ্বাস। মাত্র এক বছর বয়সে তাঁর মায়ের মৃত্যু হয়। এত ছোটবেলায় মাকে হারিয়ে তিনি বড় হয়েছেন জ্যাঠাইমার কাছে। ছোটবেলায় তাঁর মা তাঁকে আদর করে ‘ছবি’ নামে ডাকতেন। মায়ের আদর মাখা এই ‘ডাক নাম’ চিরকাল তাঁর পরিচয় হয়ে রয়ে গেলো।

তাঁর পূর্বপুরুষরা কলকাতা নিবাসী ছিলেন না। এমনকি তাঁদের উপাধি প্রথমে ‘দে’ ছিল। জানা যায় ১৬০০ সালের প্রথম দিকে দিল্লির সম্রাট আকবরের কাছ থেকে ছবি বিশ্বাসের পূর্বপুরুষ তিতুরাম দে ‘বিশ্বাস’ উপাধিটি পেয়েছেন। তাঁর উত্তরপুরুষ রামকান্তের পুত্র চণ্ডীচরণ দে বিশ্বাস ১৭০০ সালে বড়ো জাগুলিয়া থেকে ২৪ পরগনার বারাসাতের ছোট জাগুলিয়ায় এসে বসবাস শুরু করেন। বসতবাড়িটির নাম ‘কালিনিকেতন’, কিন্তু এখানেও স্থায়ী বসবাস হয়ে ওঠেনি। পরবর্তীকালে শিক্ষা ও ব্যবসা-বাণিজ্যের উদ্দেশ্য নিয়ে ছবি বিশ্বাসের পরিবার কলকাতায় চলে আসেন। তবে জাগুলিয়ায় যাতায়াত রইল শুধুমাত্র পূজা পার্বণ উপলক্ষ্যে।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

ছোট থেকেই ছবি বিশ্বাসের অভিনয়ের প্রতি একটা টান ছিল। ছোটবেলায় যৌথ পরিবারে ভাই বোন সবাই মিলে আবৃত্তি, গান, নাটক উৎসাহ নিয়ে করতেন। খুবই মেধাবী ছাত্র ছিলেন তিনি, পড়াশোনার পাশাপাশি অভিনয়েও তিনি বেশ দক্ষ হয়ে উঠতে থাকেন। তাঁর শিক্ষা জীবন শুরু হয় নয়নচাঁদ স্ট্রিটের একটি কিন্ডারগার্ডেনে। পরে ক্ষুদিরাম বসু লেনের সেন্ট্রাল কলেজিয়েট স্কুলে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করার পর ভর্তি হয়েছেন হিন্দু স্কুলে। স্নাতকশ্রেণির পড়াশোনা করার জন্য তিনি প্রথমে প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হলেও পরে বিদ্যাসাগর কলেজে ভর্তি হয়েছেন।

চলচ্চিত্র জগতে আসার আগে তিনি অভিনয় করেছেন যাত্রা ও নাটকে। পড়াশোনা চলাকালীন তিনি অভিনয়কে পেশা হিসেবে বেছে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। অভিনয় জীবনে তাঁর হাতেখড়ি মদন মিত্র লেনের নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্রের বৈঠকখানায় ‘বারবেলা বৈঠক ক্লাবে’। ‘শ্রী রঙ্গম মঞ্চে’ তিনি একসময় বিনা পারিশ্রমিকেও অভিনয় করেছেন। অভিনয়কে গভীরভাবে ভালবেসে ফেলেন, অভিনয় দক্ষতার সাথে উপহার দিতে থাকেন সুন্দর সুন্দর যাত্রা, নাটক ও সিনেমা। ছবি বিশ্বাস সংগীত চর্চাও করেছিলেন। তাঁর সঙ্গীতচর্চার সূত্রপাত ওস্তাদ জামিরুদ্দিন খাঁ সাহেবের কাছে। ‘ভীষ্ম’ নাটকেও তিনি অভিনয় করেছেন। একজন পেশাদার শিল্পী হিসেবে ১৯৩৮ সালে ‘নাট্য নিকেতন মঞ্চে’ আত্মপ্রকাশ করেন।

এই সব কিছুর মধ্যে গোপীমোহন লেনের বাসিন্দা শচীন্দ্রনাথ বসুর কন্যা সমীরা দেবীর সঙ্গে ছবি বিশ্বাসের বিবাহ হয়। সমীরা দেবীর আরও একটি নাম নীহারবালা দেবী। ছবি বিশ্বাস ও সমীরা দেবীর একমাত্র কন্যা সন্তান মঞ্জুলা বিশ্বাস।

যাত্রা, নাটকে অভিনয় করার পাশাপাশি তিনি ধীরে ধীরে চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশ করতে থাকেন। একজন পেশাদার অভিনেতা হিসেবে চলচ্চিত্রজগতে এসেছেন বেশ খানিকটা বেশি বয়সে। তাঁর প্রথম ছবি ‘অন্নপূর্ণার মন্দির’ (১৯৩৬)। পরবর্তীতে তিনি সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় ‘জলসাঘর’, ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’, ‘দেবী’, ইত্যাদি ছবিতে অভিনয় করেন। তপন সিংহের পরিচালনায় বিখ্যাত ‘কাবুলিওয়ালা’ (১৯৫৭) ছবিতেও অভিনয় করেছেন তিনি। রাষ্ট্রপতি স্বর্ণপদক প্রাপ্ত এবং বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে উচ্চ প্রশংসিত এই ছবিতে তিনি নাম ভূমিকায় ছিলেন। এছাড়াও আরও অনেক ছবিতে তিনি অসাধারণ দক্ষতার সাথে অভিনয় ফুটিয়ে তুলেছেন। তাঁর পরিবারের আভিজাত্যের ছোঁয়া তাঁর অভিনয়ের মাধ্যমেও ফুটে উঠত অনেক সময়। চলচ্চিত্র জগতে ছবি বিশ্বাস মূলত সাহেবি ও রাশভারী ব্যক্তিত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করার জন্য বিশেষ খ্যাতি লাভ করেছেন। তাঁর আভিজাত্যপূর্ণ অভিনয়ের জন্য সত্যজিত রায়ের ‘জলসাঘর’ চলচ্চিত্রের রাশভারি জমিদারের ভূমিকায় স্বাভাবিক পছন্দের তালিকায় ছিলেন। জলসাঘর সিনেমায় তাঁর অভিনয় সমস্ত বাঙালির হৃদয়ে আঁকা আছে। পরবর্তীকালে সত্যজিত রায়ের পরিচালনায় আরও দুটি সিনেমা দেবী ও কাঞ্চনজংঘায় অভিনয় করেন।

তাঁর অভিনয় করা উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র হল:চোখের বালি (১৯৩৮), চাণক্য (১৯৩৯), নিমাই সন্ন্যাসী (১৯৪০), প্রতিশ্রুতি (১৯৪১), গরমিল (১৯৪২), জীবনসঙ্গিনী (১৯৪২), ছদ্মবেশী (১৯৪৪), পথ বেঁধে দিলো (১৯৪৫), রাজলক্ষ্মী (১৯৪৫)দুইপুরুষ (১৯৪৫), বিরাজ বউ (১৯৪৬), প্রেম কি দুনিয়া (১৯৪৬), চন্দ্রশেখর (১৯৪৭), দৃষ্টিদান (১৯৪৮), মঞ্জুর (১৯৪৯), মানদণ্ড (১৯৫০), বিদ্যাসাগর (১৯৫০), দুর্গেশ নন্দিনী (১৯৫১),ষোড়শী (১৯৫৪), যদুভট্ট (১৯৫৪), ওরা থাকে ওধারে (১৯৫৪), সবার উপরে (১৯৫৫), সাহেব বিবি গোলাম (১৯৫৬), কাবুলিওয়ালা (১৯৫৬), অসবর্ণ (১৯৫৬), ভোলা মাস্টার (১৯৫৬), রাত ভোরে (১৯৫৬), পৃথিবী আমারে চায় (১৯৫৭),হরিশচন্দ্র (১৯৫৭), পথে হলো দেরি (১৯৫৭), পরশপাথর (১৯৫৮), জলসাঘর (১৯৫৮), স্মৃতিটুকু থাক (১৯৬০), হসপিটাল (১৯৬০), ক্ষুধিত পাষাণ (১৯৬০), দেবী (১৯৬০), সপ্তপদী (১৯৬১), মানিক (১৯৬১), মা (১৯৬১), কাঞ্চনজঙ্ঘা (১৯৬২), শুভদৃষ্টি (১৯৬২), ধূপছায়া (১৯৬২), দাদাঠাকুর (১৯৬২), অতল জলের আহ্বান (১৯৬২)।

তিনি প্রায় ২৫৬ টি বাংলা চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। শুধু চলচ্চিত্র জগতেই নয় তিনি বিখ্যাত ছিলেন মঞ্চ অভিনয়েও। ‘ধাত্রীপান্না’, ‘মীরকাশিম’, ‘সমাজ’, ‘দুই পুরুষ’, ‘বিজয়া’, ‘কাশিনাথ’, ‘চন্দ্রনাথ’, ‘চাঁদ সওদাগর’ ‘গৌরিক পতাকা’, ‘ডাক বাংলো’ সহ ৩৯ টি নাটকে তাঁর অভিনয় দর্শকের চোখ জুড়িয়েছে। ছবি বিশ্বাস প্রতিকার (১৯৪৪), এবং যার যেথা ঘর (১৯৪৯) এই ছবি দুটির পরিচালক ছিলেন। বহু পার্শ্বচরিত্রেও সুন্দর অভিনয় করেছেন। এর পাশাপাশি তিনি খুবই ভালো আবৃত্তিকারও ছিলেন। বাংলা সিনেমার পাশাপাশি তিনি হিন্দি সিনেমাতেও সমান ভাবে অভিনয় দক্ষতা দিয়ে জয় করেছেন দর্শকের মন। ১৯৫৬ সালে রাজ কাপুরের সুপার হিট হিন্দি সিনেমা ‘জাগতে রহো’তেও অভিনয় করেছেন তিনি। এই সিনেমাটি ‘একদিন রাত্রে’ নামে বাংলাতেও মুক্তি পায়। প্রতিটি ছবিতে তাঁর এই অসাধারণ অভিনয়ের জন্য ১৯৫৯ সালে ‘সংগীত নাটক একাডেমী’ তাঁকে ‘শ্রেষ্ঠ অভিনেতা’র সম্মান জানায়।

বাবার মতো সমাজসেবক ছিলেন তিনিও। ছোট জাগুলিয়ায় সরকারি স্বাস্থ্য কেন্দ্রের জন্য ছবি বিশ্বাস প্রায় ১০ বিঘা জমি দান করেছেন। ১৯৪২ থেকে ১৯৪৩ সালে দুর্ভিক্ষের সময় জাগুলিয়া গ্রামের ঘরে ঘরে চাল, ডাল, জামা, কাপড় এমনকি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পৌঁছে দিয়েছেন নিজের দায়িত্বে।

সবকিছু ভালভাবে চলতে চলতে হঠাৎ করেই সব এলোমেলো হয়ে যায়। ১৯৬২ সালের ১১ জুন এক মোটর গাড়ি দুর্ঘটনায় ছবি বিশ্বাসের মৃত্যু হয়। পরিবার নিয়ে জাগুলিয়ার পৈতৃক বাড়িতে যাওয়ার পথে এই দুর্ঘটনাটি ঘটে। যদিও তিনি খুবই ভাল গাড়ি চালাতেন, সেদিন ড্রাইভারকে সরিয়ে দিয়ে নিজে গাড়ি চালিয়েছেন। মধ্যমগ্রামের কাছে গঙ্গানগরে যশোর রোডে বিপরীত দিক থেকে আসা একটি মাল বোঝাই লরির সাথে ধাক্কা লাগে ছবি বিশ্বাসের গাড়ির। স্টিয়ারিং এর ধাক্কায় তাঁর বুকের পাঁজরের হাড় সঙ্গে সঙ্গে ভেঙে যায়। সেখান থেকে আর.জি.কর হাসপাতালে আনা হলেও তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করা হয়।

অভিনয়কে ভীষণভাবে ভালবেসে একের পর এক চিরসবুজ ছবি উপহার দিয়ে গেছেন। নিখুঁত অভিনয় যেন তাঁর শিরায় শিরায় ছিল। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত অভিনয় করে গেছেন। প্রতিটি ছবি তাঁর অভিনয় ও পরিচালনায় প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। বাংলা চলচ্চিত্র জগতে এমন অভিনেতা খুবই কম দেখা যায়। মৃত্যুর পরে আজও তিনি জীবিত রয়েছেন সিনেমাপ্রেমী মানুষের হৃদয়ে।

One comment

আপনার মতামত জানান