বাংলা আধুনিক মহাকাব্য ধারার শেষ কবি হিসেবেই সুপরিচিত কায়কোবাদ (Kaykobad)। পিছিয়ে পড়া বাঙালি মুসলমান সম্প্রদায়কে তাঁদের লুপ্ত গৌরব পুনরুদ্ধারের পথে উজ্জীবিত করে তোলাই কায়কোবাদের কাব্যসাধনার মূল উদেশ্য ছিল। ‘মহাশ্মশান’ তাঁর লেখা একটি বিখ্যাত দীর্ঘ কাব্যগ্রন্থ। এছাড়াও তাঁর অন্যান্য বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘কুসুমকানন’, ‘অশ্রুমালা’, ‘শিব মন্দির’, ‘মহরম শরীফ’ ইত্যাদি। ‘নিখিল ভারত সাহিত্য সঙ্ঘ’ তাঁকে যথাক্রমে ‘কাব্যভূষণ’, ‘বিদ্যাভূষণ’ এবং ‘সাহিত্যরত্ন’ আখ্যায় ভূষিত করেছে।
১৮৫৭ সালের ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ উপজেলার আগলা পূর্বপাড়া গ্রামে কায়কোবাদের জন্ম হয়। তাঁর আসল নাম কাজেম আল কুরেশি। তাঁর বাবা শাহামাতুল্লাহ আল কুরেশি ওরফে এমদাদ আলী ঢাকার জেলা জজ আদালতে সম্মানীয় একজন উকিল ছিলেন। তাঁর মায়ের নাম ছিল জরিফুন্নেসা খাতুন। কায়কোবাদের ঠাকুরদাদার নাম ছিল নেয়ামতউল্লাহ্ আল কুরেশি। বলা হয় তাঁর পূর্বপুরুষ মাহবুবউল্লাহ্ আল কুরেশি সম্রাট শাহজাহানের সময়েই বাগদাদ থেকে ভারতে এসেছিলেন। মাত্র ১১ বছর বয়সে কায়কোবাদ তাঁর বাবাকে হারান এবং তার পরের বছরই তাঁর মা মারা যান।
প্রথমে পোগোস স্কুল এবং পরে সেন্ট গ্রেগরিস স্কুলে পড়াশোনা সম্পন্ন করেন কায়কোবাদ। তারপর ঢাকা মাদ্রাসায় ভর্তি হন তিনি। কিন্তু প্রবেশিকা পরীক্ষা না দিয়েই তিনি ঢাকা মাদ্রাসা ত্যাগ করেন।
বাবার অকালমৃত্যুর পরে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে পোস্টমাস্টারের চাকরি নিয়ে কায়কোবাদ পুনরায় আগলা গ্রামে ফিরে আসেন। আগলাতেই অবসর গ্রহণের আগে পর্যন্ত কাজ করেছিলেন তিনি। ১৯৩২ সালে বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সম্মেলনের মূল অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেছিলেন তিনি। কায়কোবাদ আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রথম মুসলমান কবি এবং মুসলমান কবিদের মধ্যে প্রথম সনেট রচয়িতা। রবীন্দ্র-যুগেই তাঁর কাব্য প্রতিভার বিকাশ ঘটে। প্রেম ও বেদনার পাশাপাশি আধ্যাত্মচিন্তা, স্বদেশপ্রেম এবং ইতিহাসপ্রীতি ছিল তাঁর কাব্যের মূল বৈশিষ্ট্য। ১৮৭০ সালে তাঁর লেখা প্রথম কবিতার বই ‘বিরহবিলাপ’ প্রকাশিত হয়। ১৮৭৩ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সে তিনি লিখে ফেলেন ‘কুসুমকানন’ কাব্য। এরপরে ১৮৯৪ সালে প্রকাশ পায় কায়কোবাদ রচিত অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাব্য ‘অশ্রুমালা’। ক্রমে ক্রমে তিনি মহাকাব্য রচনায় মনোনিবেশ করেন। তারপরেই ১৯০৪ সালে কায়কোবাদ সেই বিখ্যাত মহাকাব্যটি লেখেন যার নাম ‘মহাশ্মশান’। মুসলমানদের গৌরবময় ইতিহাস থেকে কাহিনিসার নিয়ে কায়কোবাদ রচনা করেছিলেন তাঁর ‘মহাশ্মশান’ কাব্যটি। এই কাব্য রচনা করেই তিনি সাহিত্য জগতে বিখ্যাত হয়ে ওঠেন এবং ‘মহাকবি’ উপাধি পান। তৃতীয় পাণিপথের যুদ্ধ অবলম্বনে রচিত এই কাব্যে জয় ও পরাজয়ের থেকেও বড় হয়ে উঠেছে এক ভয়াবহ বিধ্বংসী পটভূমি। ভারতের মারাঠা হিন্দু শক্তির সঙ্গে আহমদ শাহ আবদালীর মুসলমান শক্তির এই যুদ্ধকে কায়কোবাদ উভয়ের শক্তিক্ষয়ের খেলা বলেই মনে করতেন। ‘মহাশ্মশান’ কাব্যটিতে মোট তিনটি খণ্ড রয়েছে যেগুলি যথাক্রমে ১৯ সর্গ, ২৪ সর্গ এবং ৭ সর্গে সমাপ্ত হয়েছে। এই কাব্যের মধ্যে পূর্বজ মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত এবং নবীনচন্দ্র সেনের রচনারীতির বহুল প্রভাব রয়েছে। যুদ্ধের ভয়াবহতা থাকলেও এই কাব্যের মধ্যে বহু প্রণয়-কাহিনিও সংযোজন করেছিলেন কায়কোবাদ। কাব্যের শুরুতেই দেখা যায় ‘কবির বীণা ও কল্পনা’, ‘আল্লাহ আকবর’ ইত্যাদি শীর্ষক বন্দনা অংশ। ১৯১৪ সাল পর্যন্ত কাব্যটিতে বহুল পরিমার্জন করেন তিনি। এরপর একে একে ‘শিব মন্দির’ (১৯২১), ‘অমিয়ধারা’ (১৯২৩), ‘মহরম শরীফ’ (১৯৩৩), ‘শ্মশান ভস্ম’ (১৯৩৮) ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থগুলি লিখে ফেলেন কায়কোবাদ।
মূলত গীতিকাব্য এবং মহাকাব্যই লিখেছেন কায়কোবাদ। নবীনচন্দ্র সেন ছিলেন কাব্যের দুনিয়ায় তাঁর পরম আদর্শ। নবীনচন্দ্র সেনের ‘পলাশীর যুদ্ধ’ কাব্যটি তাঁকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে এক অসাম্প্রদায়িক বাতাবরণ গড়ে তোলার মানসিকতা ছিল তাঁর। অন্যদিকে সমাজে পিছিয়ে পড়া বাঙালি মুসলমানদের হৃত গৌরব ফিরিয়ে এনে তাঁদের পুনরুজ্জীবিত করাই কায়কোবাদের কাব্যসাধনার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বলে মনে করা হয়। তাঁর মৃত্যুর পরেও কিছু কিছু কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল যার মধ্যে রয়েছে ‘প্রেমের ফুল’ (১৯৭০), ‘প্রেমের বাণী’ (১৯৭০), ‘প্রেম-পারিজাত’ (১৯৭০) এবং ‘মন্দাকিনী ধারা’ (১৯৭১) ইত্যাদি। তাঁর সুদীর্ঘ ৮২ বছরের জীবনে প্রায় সমগ্র জীবনই উৎসর্গীকৃত ছিল সাহিত্য সাধনায়।
‘নিখিল ভারত সাহিত্য সঙ্ঘ’ তাঁকে যথাক্রমে ‘কাব্যভূষণ’, ‘বিদ্যাভূষণ’ এবং ‘সাহিত্যরত্ন’ আখ্যায় ভূষিত করেছে।
১৯৫১ সালের ২১ জুলাই কায়কোবাদের মৃত্যু হয়।
2 comments