দোবান ভ্যালি ভ্রমণ

দোবান ভ্যালি ভ্রমণ

পাহাড়, অরণ্য ও নদীর সৌন্দর্য্য যদি একইসঙ্গে উপভোগ করতে হয় তাহলে সিকিমের দোবান ভ্যালি সবচেয়ে উপযুক্ত ভ্রমণস্থল হতে পারে। ঘন জঙ্গল এবং তৃণভূমিতে ঘেরা পার্বত্য এই উপত্যকাটিতে লেগে থাকে পরিযায়ী পাখিদের আনাগোনাও। মন ভালো করা সকাল, নিস্তব্ধ অরণ্যের রাতে নদীর জল কল্লোল, এইসব মিলিয়ে যে নৈসর্গিক দৃশ্য এবং অভিজ্ঞতার সাক্ষী থাকার সুযোগ মিলবে তা জীবনের এক স্মরণীয় অধ্যায় হয়ে থাকবে। যেহেতু পার্বত্য অঞ্চল, সেকারণে অ্যাডভেঞ্চার পিপাসুরা ট্রেকিংয়ের সুযোগও পাবেন । কম খরচে এমন একটি অফবিট ভ্রমণস্থল নিশ্চয়ই পর্যটকদের আকৃষ্ট করবে।

শিলিগুড়ি থেকে প্রায় ৮৪ কিলোমিটার দূরে পশ্চিমবঙ্গের কালিম্পং জেলায় রংপো এবং রেশি নদীর সঙ্গমস্থলে পাহাড়ী অরণ্যে ঘেরা দোবান ভ্যালি অবস্থিত। সিকিমের সিল্ক রুট থেকে এর দুরত্ব মাত্র ৪০ কিলোমিটার।

দোবান (Doban) শব্দটি একটি নেপালী শব্দ। ‘দো’ এর অর্থ হল দুই এবং ‘বান’ শব্দের অর্থ বেঁধে রাখা। দোবান নামটি উক্ত দুটি নদীর বাঁধনকেই বোঝায় আসলে ।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

শহরের জনকোলাহল থেকে দূরে এক স্বল্পপরিচিত নির্জন অরণ্যে ঘেরা এরকম এক পাহাড়ী উপত্যকায় এসে কিছুদিন থাকলে এক স্মরণীয় অভিজ্ঞতা যে সঞ্চয় করা যাবে, সেবিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। দুই নদীর মিলিত জলকল্লোলে এক অসামান্য নৈসর্গিক আবহের সৃষ্টি হয়েছে এখানে। অসংখ্য পাখির কলরব জায়গাটিকে আরও সুন্দর করে তুলেছে। বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে অসংখ্য পরিযায়ী পাখি এসে এই উপত্যকা এবং তার পার্শ্ববর্তী অরণ্যে ভীড় করে। উৎসাহী পর্যটকেরা দেশ-বিদেশের পাখি দেখবার এক বিরল সুযোগ এখানে পেতে পারেন। নদীতে মাছ ধরলেও এখানে বারণ করার কেউ নেই। তবে এখানকার পরিবেশ অবশ্যই নষ্ট করবেন না। নুড়িপাথরের গায়ে ধাক্কা মেরে ছুটে চলা পাহাড়ী নদীর সঙ্গে মনও যেন পাল্লা দিয়ে ছোটে। এই বিস্তীর্ণ সবুজের মধ্যে দাঁড়িয়ে শহরের ধুলিধূসরিত ক্লান্ত জীবন যেন হঠাৎ জেগে উঠে প্রাণশক্তি ফিরে পায়। সূর্যাস্তের সময়ে ঘরে ফেরা পাখির দলের ঝাঁক বেঁধে অরণ্যের দিকে উড়ে আসা দেখতে দেখতেই নিঃশব্দে সন্ধ্যা নেমে আসে। নদীর ধারে তাঁবু ফেলে ক্যাম্প করেও থাকা যায় এখানে। রাতে আগুন জ্বালিয়ে তার ধারে যদি বসা যায় হাতে চা বা কফির কাপ নিয়ে, মনে হতেই পারে, আর ওই ইট-কাঠ-পাথরের শহরে ফিরে গিয়ে কি লাভ! দোবান ভ্যালি ভ্রমণের স্মৃতি মন থেকে সহজে মুছবার নয়। অল্প পরিচিত বলেই মানুষের ভীড় কম, তাই নির্জনতার মধ্যে প্রকৃতিকে যেন সম্পূর্ণ উপভোগ করবার অবসর মেলে এখানে।

ট্রেনে গেলে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে পৌঁছতে হবে প্রথমে। নিউ জলপাইগুড়ি থেকে আরও প্রায় ৮৫ কিলোমিটার গেলে তবে পাওয়া যাবে দোবান ভ্যালি। প্রায় তিন থেকে চারঘন্টা সময় লাগবে। স্টেশন থেকে গাড়ি বুক করে নেওয়া যাবে। গাড়ি করে চলে যেতে হবে রংপো। সেখান থেকে তারপর রোরথাং ব্রিজ পর্যন্ত যেতে হবে গাড়িতে। এবারে এই রোরথাং ব্রিজ থেকে চাইলে হেঁটেই হোমস্টে পর্যন্ত যাওয়া যায়, তবে গাড়ির ব্যবস্থাও আছে। তবে নদীর ধার দিয়ে এই পথটুকু হাঁটতে মন্দ লাগার কথা নয়। আবার কেউ চাইলে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকেই প্রাইভেট গাড়ি বুক করে সরাসরি একেবারে দোবান ভ্যালি পর্যন্তও চলে যেতে পারেন। সেক্ষেত্রে গাড়ির খরচ বেশি হবে।

দোবান ভ্যালি যেহেতু খুব একটা পরিচিত স্থান নয়, সেকারণে পর্যটকদের থাকার জন্য একটি ব্যতীত অন্য বিকল্প কোনো হোমস্টে সেখানে পাওয়া যাবে না। কান্নান ভ্যালি হোমস্টে নামক সেই একটিমাত্র থাকার জায়গাতেই পর্যটকদের আশ্রয় নেওয়া ছাড়া আর গত্যন্তর নেই। মূলত ভারতীয় খাবারই সেখানে পরিবেশন করা হয়ে থাকে। নদী থেকে সদ্য ধরা টাটকা মাছ, স্থানীয় মুরগি ইত্যাদি খাবারের হিসেবে পাওয়া যাবে।

দোবান ভ্যালি নিজে তো অপরূপ সুন্দর বটেই, এর চারপাশেও বেশ কিছু ভ্রমণের জায়গা আছে এখান থেকে সেসব জায়গাতেও চলে যাওয়া যায় অনায়াসেই। সিকিমের বিখ্যাত সিল্ক রুট ঘুরে আসতে পারেন এখান থেকে। তাছাড়াও কাছাকাছি কয়েকটি জনপ্রিয় দর্শনীয় স্থান রয়েছে এখানে যেমন – অরিতার, মানখিম, সিমানদারা প্রভৃতি। দোবান থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে অরিতার অবস্থিত। অরিতারে লাম্পোখারি লেক, ব্রিটিশ বাংলো ইত্যাদি দ্রষ্টব্য রয়েছে। মানখিম থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার অপূর্ব দৃশ্য প্রত্যক্ষ করা যায়। তাছাড়াও মানখিমে অবস্থিত একটি মঠেও ঘুরতে যেতে পারেন পর্যটকেরা।

দোবান ভ্যালিতে বেড়াতে যাওয়ার উপযুক্ত সময় হল অক্টোবর থেকে মে মাস। এইসময়েই পরিযায়ী পাখিরা সব ভীড় জমায় এসে এই উপত্যকায়। জুন থেকে সেপ্টেম্বর অর্থাৎ বর্ষাকালে বৃষ্টির ফলে জলস্তর বেড়ে যায়, ফলে এসময়ে দোবান ভ্যালি বন্ধ থাকে।


ট্রিপ টিপস

  • কীভাবে যাবেন – ট্রেনে করে গেলে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে নেমে স্টেশন থেকে গাড়ি নিয়ে রংপো, সেখান থেকে রোরথাং ব্রিজ তারপর বাকি পথটুকু কেউ হাঁটতে পারেন কেউ বা গাড়ি নিয়েও দোবান উপত্যকায় পৌঁছে যেতে পারেন। যদিও স্টেশন থেকে গাড়ি বুক করে সরাসরি পৌঁছনো যায় তবে সেক্ষেত্রে খরচ একটু বেশি হবে।
  • কোথায় থাকবেন – দোবান ভ্যালি যেহেতু ভীষণই স্বল্পপরিচিত একটি জায়গা, তাই সেখানে থাকার জন্য হোমস্টেই ভরসা।
  • কী দেখবেন – দোবান ভ্যালিতে রংপো ও রেশি নদীর সংযোগস্থল, পাহাড়ী অরণ্য ছাড়াও, এখান থেকে অল্প দূরেই আছে সিল্ক রুট, অরিতার, মানখিম, সিমানদারার মতো দর্শনীয় স্থান।
  • কখন যাবেন – অক্টোবর থেকে মে মাস দোবান ভ্যালি যাওয়ার উপযুক্ত সময়।
  • সতর্কতা
    • বর্ষাকালে এখানে না যাওয়াই ভালো, কারণ বৃষ্টিতে নদীর জলস্তর বেড়ে যায়, আর তাছাড়া এসময় বন্ধ থাকে এই ভ্যালি।
  • বিশেষ পরামর্শ
    • এখানে পায়ে হেঁটে ঘুরতে হবে এবং যেহেতু পাহাড়ী অঞ্চল, তাই বয়স্কদের জন্য একটু অসুবিধার হতে পারে। সঙ্গে প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র এবং নগদ টাকা রাখা খুবই জরুরি, কারণ হাতের কাছে কোনো ওষুধের দোকান বা এটিএম পাওয়া যাবে না এখানে।

সর্বশেষ সম্পাদনার সময়কাল – ২০২৩

আপনার মতামত জানান