আমাদের পশ্চিমবঙ্গ মূলত ২৩টি জেলাতে বিভক্ত। বেশীরভাগ জেলাই স্বাধীনতার আগে থেকে ছিল, কিছু জেলা স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে গঠিত, আবার কিছু জেলা একটি মূল জেলাকে দুভাগে ভাগ করে তৈরি হয়েছে মূলত প্রশাসনিক সুবিধের কারণে। প্রতিটি জেলাই একে অন্যের থেকে যেমন ভূমিরূপে আলাদা, তেমনি ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক দিক থেকেও স্বতন্ত্র। প্রতিটি জেলার এই নিজস্বতাই আজ আমাদের বাংলাকে সমৃদ্ধ করেছে। সেরকমই একটি জেলা হল কালিম্পং (Kalimpong)।
১২৫০ মিটার গড় উচ্চতায় তিস্তা নদীর ধারে অবস্থিত কালিম্পং পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের অধুনা সৃষ্ট একটি জেলা। ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ সালে দার্জিলিং জেলার কালিম্পং মহকুমা পৃথক ভাবে কালিম্পং জেলা হিসাবে স্বীকৃতি পায়। কালিম্পং জেলা মূলত কালিম্পং শহরকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে। পর্যটন ছাড়াও এখানে ব্রিটিশ আমলে অবস্থিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির জন্য কালিম্পং পরিচিতি লাভ করেছে। এছাড়াও ভারতীয় সেনাবাহিনী-র XXXIII কর্পস-এর অন্তর্গত ২৭তম পর্বত বিভাগের সদর দপ্তরটি এই জেলায় অবস্থিত।
ভৌগলিক দিক থেকে দেখলে এই জেলার উত্তরে সিকিম, পূর্বে ভুটান, দক্ষিণে জলপাইগুড়ি এবং পশ্চিমে দার্জিলিং জেলা ঘিরে রয়েছে। তিস্তা, জলঢাকার মত সুবিশাল নদী ছাড়াও রাংপো, মেরং, রংবং -এর মত অজস্র পাহাড়ি নদী এই জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। ডেলো পাহাড় ও দুরপিন পাহাড়ের মধ্যে সংযোগ রক্ষাকারী শৈলশিরার ওপর অবস্থিত কালিম্পংয়ের আবহাওয়া অত্যন্ত ৷ এই মনোরম আবহাওয়া পর্যটন শিল্পের ক্ষেত্রে উপকারে এসেছে । এখানে পাঁচটি ঋতু চক্র লক্ষ্য করা যায়। যেমন- বসন্ত, গ্রীষ্ম, শরৎ, শীত ও বর্ষা। এখানকার বার্ষিক তাপমাত্রা সর্বোচ্চ ৩০ °সে থেকে সর্বনিম্ন ৯ °সে এর মধ্যে ওঠানামা করে।
১০৫৬ বর্গ কিমি বিস্তৃত কালিম্পং জেলা আয়তনের দিক থেকে পশ্চিমবঙ্গে বাইশতম স্থানে রয়েছে। এখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশ মনোরম জলবায়ু এখানে পর্যটন শিল্পের বিস্তারে সাহায্য করেছে৷ ২০১১ সালের আদমসুমারি অনুসারে জনসংখ্যার বিচারে কালিম্পং সর্বনিম্ন স্থান অধিকার করে৷ এখানে মোট জনসংখ্যা প্রায় ৪৯৪০৩ এবং জনঘনত্ব ৫৪০০ জন প্রতি বর্গ কিমিতে৷
ঊনবিংশ শতাব্দীর আগে পর্যন্ত কালিম্পং ও তার সংলগ্ন অঞ্চলগুলি শাসিত ছিল সিকিম ও ভুটান রাজ্যের দ্বারা। সিকিমি শাসনে এই অঞ্চল ডালিংকোট নামে পরিচিত ছিল। ১৭০৬ সালে ভুটান রাজা একটি যুদ্ধে জয়লাভ করে অঞ্চলটি সিকিম রাজার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেন এবং এই অঞ্চলের নতুন নাম রাখেন কালিম্পং। কালিম্পং শব্দটির সঠিক অর্থ জানা না গেলেও এই নামের উৎস নিয়েও বিভিন্ন মতবাদ প্রচলিত আছে, যেমন একটি মতানুসারে কালিম্পং কথাটি এসেছে ‘কালেনপাং’ শব্দ থেকে, লেপচা ভাষায় যার অর্থ ‘গোষ্ঠীর ছোটো পাহাড়’ (“Hillock of Assemblage”)। ‘কালেনপাং’ বিকৃত হয়ে হয় ‘কালীবাং’ এবং পরে আরও বিকৃত হয়ে হয় কালিম্পং। আবার অন্য একটি সূত্র মতে তিব্বতি ভাষায় কালিম্পং শব্দের অর্থ- ‘রাজার মন্ত্রীদের সভা’। ‘কালোন’ অর্থে রাজার মন্ত্রী ও ‘পং’ অর্থে বেড়া বা সভা বোঝায়। ১৯৩৪ সালে এই কালিম্পং হয়েই রাহুল সাংকৃত্যায়ন তিব্বত গিয়েছিলেন। কালিম্পং-এ রবীন্দ্রনাথ ১৯৩৮ ও ১৯৪০ সালের মধ্যে চার বার এসেছেন এবং গৌরীপুর ভবনে থেকেছিলেন। নেতাজি, জওহরলাল নেহরু, লাল বাহাদুর শাস্ত্রী থেকে শুরু করে বিধানচন্দ্র রায়, অনিল চট্টোপাধ্যায়, ভি.ভি গিরি, পিসি সরকার (সিনিয়র), শরৎ বসু, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় প্রভৃতি দিকপাল ব্যক্তিত্ব হাওয়া বদলের উদ্দেশ্যে এই কালিম্পং-এ ছুটি কাটাতে আসতেন।
এখানকার মনোরম জলবায়ুর কারণে ব্রিটিশরা গাঙ্গেয় সমভূমি অঞ্চলের তীব্র গরম থেকে রেহাই পেতে দার্জিলিংয়ের বিকল্প শৈলশহর হিসেবে কালিম্পংকে গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিয়েছিল। ভারত ও তিব্বতের মধ্যে পশুর লোম, উল ও খাদ্যশস্য আমদানি-রফতানিতে কালিম্পং একসময় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল। নেপাল থেকে অনুপ্রবেশকারীদের আগমন এখানে জনসংখ্যা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা ও দেশভাগের পর কালিম্পং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়।
কালিম্পংয়ের আঞ্চলিক ভাষা নেপালি, তিব্বতি, ভূটিয়া, শেরপা লেপচা, কিরান্তি। তবে সরকারি কাজ কর্ম নেপালী ও বাংলা ভাষায় হয়ে থাকে৷
কালিম্পংকে বৌদ্ধধর্মের কেন্দ্র বলা যেতে পারে৷ এখানকার জ্যাং ঢোক পালরি ফোডাং বৌদ্ধমঠে বহু দুষ্প্রাপ্য তিব্বতি বৌদ্ধ পুঁথি রক্ষিত আছে। এখানকার দর্শনীয় স্থানগুলির মধ্যে থারপা চোলিং মঠ (এখানে পুরানো ভাস্কর্য ও তথ্য সংরক্ষণ করে রাখা হয়), থোংসা মঠ(এলাকার প্রাচীনতম মঠ), ধর্মোদয় বিহার (নেপালি বৌদ্ধ মন্দির) এছাড়া পর্নমি মন্দির এবং মঙ্গল ধাম, দুরপিন দন্ড, আর্মি গলফ ক্লাব, ন্যাওড়া জাতীয় উদ্যান, রিশপ, লোলেগাঁও উল্লেখযোগ্য৷
মনোরম জলবায়ু ও সহজগম্যতা এবং আশেপাশের বেশ কিছু পর্যটন কেন্দ্র থাকায় কালিম্পংকে জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে। বর্তমান সময়ে কালিম্পং অঞ্চলের সেরা পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে মানা হয় রিশপ-রিম্বিককে। কালিম্পং-এর একটি ছোট্ট, শান্ত গ্রাম হল লোলেগাঁও অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ভ্রমন পিপাসু মানুষকে আকৃষ্ট করে৷
ডাওহিল স্কুল (Dowhill school) এই জেলার প্রাচীনতম বিদ্যালয় যা ১৮৭৯ সালে স্থাপিত হয়। উদ্যানপালনে কালিম্পং বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ এখানে নানাপ্রকার অর্কিড দেখা যায়, এখানকার নার্সারি গুলিতে হিমালয়ের ফুল, রাইজোমের ফলন চলে। কালিম্পং-এর অর্থনীতিতে এই ফুলের বাজার বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে৷
তথ্যসূত্র
- https://bn.wikipedia.org/
- https://en.wikipedia.org/
- https://www.anandabazar.com/
- https://kalimpongdistrict.in/
- https://www.anandabazar.com/
