ঘন সবুজ অরণ্য, পার্বত্য উপত্যকা এবং কাঞ্চনজঙ্ঘা, সৌন্দর্য্যের এই ত্রিবেণী সঙ্গম একসঙ্গে উপভোগ করবার সুযোগ কোন ভ্রমণপিপাসুই বা ছাড়তে চাইবেন! যদি এমনই আরণ্যক এক পরিবেশের ভিতরে, পাহাড়ী স্নিগ্ধতায় হারিয়ে যেতে মন চায় তবে কালিম্পং-এর এক ছোট্ট পাহাড়ি গ্রাম লোলেগাঁও (Lolegaon) এক আকর্ষণীয় পর্যটন ক্ষেত্র হতে পারে পর্যটকদের জন্য। কুয়াশাবৃত জঙ্গলের ভিতরে ঝুলন্ত কাঠের সেতু দিয়ে হেঁটে যাওয়ার রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হলে হিমালয় ঘেঁষা এই গ্রামে ঘুরে যেতে হবে একবার। সর্বোপরি কাঞ্চনজঙ্ঘায় সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্তের যে অভূতপূর্ব দৃশ্য উপভোগের সুযোগ মিলবে এখানে তা সারাজীবনের সম্পদ হয়ে থাকতে পারে।
পশ্চিমবঙ্গের কালিম্পং জেলার কালিম্পং সদর মহকুমার ব্লক ২-এর অন্তর্গত একটি গ্রাম হল লোলেগাঁও । হিমালয়ের শেষ প্রান্তে অবস্থিত একটি লেপচা গ্রাম লাভা থেকে ২৪ কিলোমিটার দূরে ১৬৭৫ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত। কালিম্পং লোলেগাঁও এর দূরত্ব ৫৫ কিলোমিটার।
প্রকৃতিপ্রেমী ভ্রমণপিপাসুদের জন্য লোলেগাঁও এক আদর্শ ভ্রমণস্থল। পাইন, সাইপ্রাসের জঙ্গলঘেরা এই পাহাড়ি উপত্যকার স্নিগ্ধ সবুজে, বিচিত্রবর্ণ অর্কিডের সৌন্দর্যে নিত্যদিনের ক্লান্তির যেন নিরাময় ঘটে। এছাড়াও ভাল্লুক, পাহাড়ী ছাগলের মতো বিপন্ন হিমালয়ান প্রজাতির প্রাণী, অসংখ্য রঙিন পাখি, প্রজাপতি ইত্যাদি সব মিলিয়ে হিমালয়ের কোলে অবস্থিত এই শান্ত নির্জন গ্রামটিতে নৈসর্গিক দৃশ্য দর্শনের যে অভিজ্ঞতা লাভ করা যাবে, তা জীবনের এক অমূল্য সম্পদ হয়ে থাকবে নিঃসন্দেহে। এছাড়াও ভ্রমণের সঙ্গে সঙ্গে যাঁরা অ্যাডভেঞ্চার চাইবেন তাঁদের জন্যেও রয়েছে ক্যানোপি ওয়াকের মতো আকর্ষণ। কুয়াশাচ্ছন্ন ঘন সবুজ অরণ্যের শোভা উপভোগ করা এবং সেই সঙ্গে দোদুল্যমান এক কাঠের সেতুর ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া, এমন রোমাঞ্চকর মুহূর্তের আস্বাদ গ্রহণের জন্য লোলেগাঁও ঘুরে যাওয়া আবশ্যক। এর পাশাপাশি রয়েছে ট্রেকিংয়েরও ব্যবস্থা, যা দুঃসাহসিক অভিযানের এক অনুভূতি তৈরি করে মনের মধ্যে। যদি ভাগ্য ভালো থাকে, তবে তুষারাবৃত মাউন্ট এভারেস্টের শিখরদেশটির দর্শন পাওয়ারও সম্ভাবনা আছে এখান থেকে। সেই বৃহতের সম্মুখে নিতান্তই তুচ্ছ ক্ষুদ্র মনে হয় এই জীবন। প্রাচীন ত্রিকালজ্ঞ এক ধ্যানী ঋষির মতো দাঁড়িয়ে থাকা হিমালয়ের সামনে মাথা নত হয়ে আসে। অরন্যের বিচিত্র রোমহর্ষক ধ্বনিতে শিউরে উঠতে হয়। প্রকৃতিপ্রেমী পর্যটকদের কাছে এমন অভিজ্ঞতা তুলনাহীন।
কলকাতা থেকে লোলেগাঁও পৌঁছনোর রাস্তা কঠিন কিছু নয়। ট্রেনে বা বিমানে দুরকম পরিবহনেই লোলেগাঁও যাওয়া যেতে পারে। ট্রেনে যেতে হলে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে নামতে হবে পর্যটকদের। সেখান থেকে লোলেগাঁও-এর দুরত্ব ১০০ কিলোমিটার। স্টেশনের বাইরে থেকে গাড়ি ভাড়া করে চারঘন্টার মধ্যে পৌঁছে যাওয়া যায় লোলেগাঁওতে। আবার যদি কেউ বিমানপথে যাওয়ার কথা ভাবেন তবে তাঁকে নামতে হবে বাগডোগরা বিমানবন্দরে। সেখান থেকে শিলিগুড়ি হয়ে লোলেগাঁও যাওয়া যায়। বাগডোগরা থেকে ১০৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত লোলেগাঁও। গাড়ি ভাড়া করে নিলে বিমানবন্দর থেকে ঘন্টা পাঁচেক সময় লাগার কথা গন্তব্যে পৌঁছতে। শিলিগুড়ি থেকে গরুবাথান হয়ে লোলেগাঁও পৌঁছনোর জন্য সরকারী বাস, মিনিবাস বা ট্যাক্সি সবসময় পাওয়া যায়। যদি সড়কপথে প্রাইভেট গাড়িতে আসার পরিকল্পনা থাকে তবে, কলকাতা থেকে এনএইচ১২ (উত্তর দিনাজপুর-কলকাতা হাইওয়ে) ধরে যেতে হবে। সময় লাগতে পারে প্রায় পনেরো ঘন্টা মতো।
লোলেগাঁও মূলত অফবিট জায়গা হওয়ায় এখানে থাকবার ব্যবস্থা একটা সময় অবধি ততখানি উন্নত ছিল না। কিন্তু বর্তমানে এখানকার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাওয়ায় বেশ কিছু নেচার রিসর্ট ও হোম স্টে গড়ে উঠেছে এখানে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পর্যটন দপ্তর দ্বারা পরিচালিত লোলেগাঁও নেচার রিসর্টে পর্যটকদের থাকবার সুবন্দোবস্ত রয়েছে। সেখানে বন ফায়ারেও ব্যবস্থা যেমন রয়েছে, তেমনি গাড়ি পার্কিং-এর জায়গা, প্রশস্ত কক্ষ, ইত্যাদি সবরকম সুবিধাই পাওয়া যাবে সেখানে। এছাড়াও বেসরকারিভাবে লোলেগাঁও ভ্যালি রিট্রিট, মাউন্ট ভিউ রিট্রিট ইত্যাদি বেশ কয়েকটি হোমস্টে পাওয়া যাবে ধারেকাছেই।
লোলেগাঁওতে যেমন অসাধারণ সব দ্রষ্টব্য স্থান আছে, তেমনই তার পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলিও ভ্রমণপিপাসুদের মন কেড়ে নেবে। প্রথমত বলতে হয় লোলেগাঁও-এর ভিআইপি বাংলো ভিউ পয়েন্টের কথা। সেখানকার গ্যালারিতে বসে চমৎকার সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত উপভোগ করা যায় এবং সেখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার তুষার চুড়াগুলির শোভাও লাগে অপরূপ। এরপরেই বলতে হয় ঝান্ডি দারা ভিউ পয়েন্টের কথা। এটি এমন একটি জায়গায় অবস্থিত যে, যেখান থেকে ডুয়ার্সের সমভূমি, দার্জিলিং, কালিম্পং, কাঞ্চনজঙ্ঘা এবং নাথুলার দৃশ্য চোখে পড়ে। এখান থেকে মাউন্ট এভারেস্টের তুষারাবৃত শৃঙ্গের এক দারুণ দৃশ্য দেখা যায়। লোলেগাঁও-এর কাছে অবস্থিত সামথার মালভূমিও একটি সুন্দর দ্রষ্টব্য স্থান। প্রায় ১৪০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত এই স্থানটিতে পাহাড় এবং বিক্ষিপ্ত কিছু কুঁড়েঘরে ঘেরা শান্ত মনোরম এক পরিবেশ বিরাজ করছে। লোলেগাঁওতে সবচেয়ে বিখ্যাত একটি ভ্রমণের জায়গা হল সেই ১৮০ মিটার দীর্ঘ এক কাঠের সেতু। বড় বড় গাছের সঙ্গে সংযুক্ত এই সেতুর ওপর দিয়ে হেঁটে জঙ্গলের শোভা উপভোগ করার ব্যবস্থা রয়েছে। এটি ক্যানোপি ওয়াক নামে পরিচিত। যাঁরা প্রকৃতিপ্রেমী মানুষ তাঁদের জন্য ১০ মিনিটের হাঁটা দূরত্বে অবস্থিত হেরিটেজ ফরেস্ট একটি উপযুক্ত স্থান হতে পারে। নানারকম অর্কিড, বন্যপ্রাণীতে ভরপুর সে-অঞ্চল। নকদরা বোটিং কমপ্লেক্সে গিয়ে স্বচ্ছ জলের হ্রদে বোটিং করতে পারবেন পর্যটকেরা। লোলেগাঁও থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত চারখোল আরেকটি নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ভরা স্থান। এখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার অসামান্য ছবি ধরা পড়ে। এছাড়াও কালিম্পং, লাভা ইত্যাদি দিকেও ঘুরে আসা যেতে পারে।
সারাবছরই প্রায় পর্যটকদের যাতায়াত লেগে থাকে লোলেগাঁওতে। বেশ উচ্চতায় অবস্থিত বলেই সারাবছর এখানকার আবহাওয়া শীতল থাকে। গ্রীষ্মকালে সমতল থেকে গিয়ে পর্যটকেরা ভিড় করেন। আবার শীতকালে প্রকৃতির প্রাচুর্য উপভোগের জন্যেও দলে দলে হাজির হন ভ্রামণিকের দল। অতএব সেপ্টেম্বর থেকে জুন মাসের মধ্যে যে-কোনো সময়তে লোলেগাঁও ঘুরতে যাওয়া যেতে পারে। বর্ষাকালে পাহাড়ী রাস্তায় ধ্বস নামার সম্ভাবনার কারণে এই সময়টা এড়িয়ে যাওয়াই ভালো।
ট্রিপ টিপস
- কীভাবে যাবেন – ট্রেনে গেলে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে নেমে গাড়ি ভাড়া করে যাওয়া যাবে। বিমানে গেলে বাগডোগরা বিমানবন্দর থেকে শিলিগুড়ি হয়ে যাওয়া যায়। শিলিগুড়ি থেকে গরুবাথান হয়ে বাস বা ট্যাক্সি করেও যাওয়ার ব্যবস্থা আছে। আবার কলকাতা থেকে সড়ক পথে গেলে এনএইচ ১২ ধরে চলে যাওয়া যায়।
- কোথায় থাকবেন – পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পর্যটন দপ্তর দ্বারা পরিচালিত লোলেগাঁও নেচার রিসর্টে পর্যটকদের থাকবার সুবন্দোবস্ত রয়েছে। এছাড়াও বেসরকারিভাবে লোলেগাঁও ভ্যালি রিট্রিট, মাউন্ট ভিউ রিট্রিট ইত্যাদি বেশ কয়েকটি হোমস্টে পাওয়া যাবে ধারেকাছেই।
- কী দেখবেন – ভিআইপি বাংলো ভিউ পয়েন্ট এবং ঝান্ডি দারা ভিউ পয়েন্ট থেকে সূর্যোদয়, সূর্যাস্তে অপরূপ কাঞ্চনজঙ্ঘা অবশ্য দর্শনীয়। এছাড়াও রালি উপত্যকা, সামথার মালভূমি, নকদরা বোটিং কমপ্লেক্স, ১৫ কিমি দূরে অবস্থিত চারখোল ইত্যাদি নানা দ্রষ্টব্য স্থান রয়েছে।
- কখন যাবেন – মূলত সেপ্টেম্বর থেকে জুন মাসের মধ্যে কোনো এক সময়ে লোলেগাঁও যাওয়ার উৎকর্ষ সময়। গ্রীষ্মকালে যারা চাইবেন তারা মার্চ থেকে জুন মাসের মধ্যে ঘুরে আসতে পারেন।
- সতর্কতা –
- প্রথমত বর্ষাকালে যেহেতু ভূমিধ্বসের ভয় থাকে তাই সেসময়টা এড়িয়ে যাওয়াই ভালো৷ এছাড়াও এখানে ঔষধের দোকান যত্রতত্র পাওয়া যাবে না ফলে সঙ্গে পর্যাপ্ত পরিমাণ ওষুধের বন্দোবস্ত রাখা দরকার। এটিএমের সংখ্যাও বেশি নয়।
- ক্রেডিট/ডেবিট/পেটিএম ইত্যাদির উপর ভরসা না করাই ভালো। পর্যাপ্ত পরিমাণ নগদ টাকা সবসময় কাছে রাখা উচিত।
- বিশেষ পরামর্শ –
- এই পাহাড়ী গ্রামে দুঃসাহসিক ট্রেকিং এবং ক্যানোপি ওয়াকে ঝুলন্ত সেতুর ওপর দিয়ে হাঁটা, এই অভিজ্ঞতা দুটি সংগ্রহ করতে না পারলে লোলেগাঁও ভ্রমণ যেন অসম্পূর্ণ থেকে যায়৷
One comment