দার্জিলিং

দার্জিলিং ভ্রমণ

সমুদ্র বলতে যেমন বাঙালি বোঝে দীঘা বা পুরী তেমনই হিল স্টেশন বা শৈলশহর বলতে দার্জিলিং। কথাতেই তো আছে দী-পু-দা অর্থাৎ দীঘা, পুরী আর দার্জিলিং হল বাঙালির প্রিয় ঘোরার জায়গা। গরম পড়লেই ব্যাগ গুছিয়ে দার্জিলিং বেরিয়ে পড়া বাঙালির বার্ষিক রুটিন এর মধ্যে পড়ে। তবে শুধু গরমই নয়, সারা বছর ধরেই এখানে ভিড় থাকে। আর শুধু বাঙালিই না, ভারত তথা বিশ্বের বিভিন্ন জায়গা থেকেও প্রচুর মানুষ দার্জিলিং ঘুরতে যান। এমনি এমনি কি আর দার্জিলিংকে বলা হয় “পাহাড়ের রানী”! পাহাড়ি এলাকার মনোরম পরিবেশ, কাঞ্চনজঙ্ঘার ভিউ, দারুণ চা-এর স্বাদ, ট্রয় ট্রেন সব মিলিয়ে দার্জিলিং এক অন্য স্বাদে ভরা। এখানের চায়ের স্বাদ তো পৃথিবীবিখ্যাত। ট্রয় ট্রেনও পৃথিবী বিখ্যাত বটেই, কারণ ইউনেস্কো এটিকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের তালিকাভুক্ত করেছে। আর যেটা ছাড়া দার্জিলিং অসম্পূর্ণ তা হল, টাইগার হিল থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘায় সূর্যোদয় দেখা। দার্জিলিং-তে ভ্রমণের স্মৃতি হিসাবে সকলের অ্যালবামে এই ছবিটি থাকবেই। তবে শুধু পর্যটকদেরই না, সিনেমানির্মাতাদেরও এক অন্যতম পছন্দ এই শহর। বহুদিন ধরে বহু টলিউড, বলিউড এমনকি হলিউড ছবির শুটিং হয়েছে এখানে।

জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গের আংশিক স্বায়ত্ত্বশাসিত জেলা দার্জিলিং-এর সদর দফতর হল দার্জিলিং শহর। শহরটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৬৭০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত।

দার্জিলিং শব্দটি তিব্বতী দোর্জে ও লিং শব্দদুটি নিয়ে তৈরি হয়েছে। দোর্জে শব্দের অর্থ হিন্দু দেবতা ইন্দ্রের দণ্ড এবং লিং শব্দের অর্থ স্থান। ১৮২৮ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এক প্রতিনিধিদল দার্জিলিং অঞ্চলে থাকার সময় এখানকার মনোরম পরিবেশ দেখে ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনীর জন্য স্বাস্থ্যনিবাস বা স্যানিটারিয়াম তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেন। কোম্পানির একজন আধিকারিক আর্থার ক্যাম্পবেল এবং রবার্ট নেপিয়ার এই শহর গঠনে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন। ব্রিটিশ আধিকারিকেরা গ্রীষ্মকালের প্রচণ্ড গরম থেকে রক্ষা পেতে ধীরে ধীরে দার্জিলিংয়ের মনোরম আবহাওয়ায় বসবাস শুরু করেন। তারপর ১৮৩৫ থেকে ১৮৪৯ সালের মধ্যে পাহাড়ের ঢালে চাষাবাদ ও ব্যবসা বাণিজ্য শুরু হলে দার্জিলিংয়ের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায়। তারপর এই অঞ্চলে প্রচুর চা বাগান গড়ে ওঠে। ধীরে ধীরে দার্জিলিং চা আন্তর্জাতিক স্তরে স্বীকৃতি লাভ করে এবং বিশ্বের সর্বাধিক জনপ্রিয় কালো চা গুলোর মধ্যে অন্যতম স্থান অধিকার করে। ১৮৭৯ থেকে ১৮৮১ সালের মধ্যে নির্মিত হয় দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়ে। যা স্থানীয় ভাষায় ট্রয় ট্রেন নামে অধিক পরিচিত। ১৯৯৯ সালের ২ ডিসেম্বর ইউনেস্কো এটিকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের তকমা দেয়। এখানে বিভিন্ন সংস্কৃতির মিশ্রণ ঘটেছে। এখনও ব্রিটিশ ধাঁচের একাধিক পাবলিক স্কুল রয়েছে এখানে। ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত, এমনকি প্রতিবেশী রাষ্ট্র থেকেও ছাত্রছাত্রীরা সেখানে পড়াশোনা করতে আসে। লেপচা, খাম্পা, গোর্খা, নেওয়ার, শেরপা, ভুটিয়া, বাঙালি এইরকম বিভিন্ন জাতি ও ভাষাগোষ্ঠীর মানুষের পাশাপাশি বাস দার্জিলিংকে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য এনে দিয়েছে।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

শহরের কোলাহল আর দূষণে ভরা জীবন থেকে কয়েকদিনের মুক্তি পেতে আপনার ঠিকানা হতে পারে দার্জিলিং। নীল আকাশের নীচে পাহাড়ের গায়ে ছোট কাঠের বাড়ি, পাইন, দেবদারু আর রডোড্রেনড্রন, দূরে দেখা যাচ্ছে কাঞ্চনজঙ্ঘা। সঙ্গে আসাধারণ চায়ের স্বাদ। গাড়ি করে যাবার সময় পাশ দিয়ে এখনও যেখানে ছুটে চলে কু ঝিক ঝিক টয় ট্রেন। এই হল দার্জিলিং যাকে বলা হয় পাহাড়ের রানী।

দার্জিলিং-তে বিভিন্নভাবে যাওয়া যায়। প্লেনে এলে বাগডোগরা বিমানবন্দরে নামতে হবে। তারপর প্রি-পেইড ট্যাক্সি স্ট্যান্ড থেকে ট্যাক্সি ভাড়া করে সরাসরি হোটেলে যাওয়া যায়। কলকাতা বিমানবন্দর থেকে বাগডোগরা বিমানবন্দরে যাওয়ার বিভিন্ন প্লেন রয়েছে। প্লেনের ওপর নির্ভর করে সময় লাগে মোটামুটি এক থেকে দেড় ঘণ্টা। ট্রেনে করে আসতে চাইলে সবথেকে ভালো হয় হাওড়া বা শিয়ালদহ থেকে রাতের ট্রেনে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন। তারপর প্রি-পেইড ট্যাক্সি স্ট্যান্ড থেকে ট্যাক্সি ভাড়া করে সরাসরি হোটেলে যাওয়া যায়। ২০২১ সালের পাওয়া তথ্য অনুযায়ী কয়েকটি ট্রেনের বিস্তারিত তুলে ধরা হল। এগুলো ছাড়াও অনেক ট্রেন আছে।

ট্রেন নাম্বারট্রেনের নামকোথা থেকে ছাড়বেকখন ছাড়বেনিউ জলপাইগুড়ি কখন পৌঁছবেকোন দিন চলে
০৩১৪১তিস্তা তোর্সা ফেস্টিভ স্পেশাল শিয়ালদহদুপুর ২টোরাত ২টা ৫০ মিনিটসবদিন
০২৩৪৩দার্জিলিং মেইল ফেস্টিভ স্পেশাল শিয়ালদহরাত ১০টা ৫ মিনিটসকাল ৮টা ১৫ মিনিটসবদিন
০২৩৭৭পদাতিক কোভিড - ১৯
এস এফ স্পেশাল (পিটি)
শিয়ালদহরাত ১১টা ২০ মিনিটসকাল ৯টা ১০ মিনিটসবদিন
০৫৯৬১কামরূপ স্পেশাল (বগীবিল হয়ে)হাওড়াসন্ধ্যে ৬টাসকাল ৬টা ৫ মিনিটসোম, শুক্র
০৫৯৫৯কামরূপ স্পেশাল (গুয়াহাটি হয়ে)হাওড়াসন্ধ্যে ৬টাসকাল ৬টা ৫ মিনিটসোম, শুক্র বাদে সবদিন
০২৩৪৫সরাইঘাট কোভিড - ১৯ স্পেশাল (পিটি)হাওড়াবিকাল ৩টে ৫৫ মিনিটরাত ১টা ৪০ মিনিটসবদিন

তবে একটু কমভাড়ায় গাড়ি পেতে হলে দার্জিলিং-মোড় থেকে গাড়ি ভাড়া করা যায়। স্টেশন থেকে রিকশা করে দার্জিলিং-মোড় আসতে হবে। সেখান থেকে গাড়ির ভাড়া গাড়িবিশেষে এবং হোটেলের জায়গা অনুযায়ী মোটামুটি ২৫০০ থেকে ৪০০০ পড়বে। এছাড়া শেয়ারের গাড়িও পেয়ে যাবেন।

তবে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন পৌঁছে ন্যূনতম ভাড়ায় যদি হোটেল অবধি যেতে চান, তাহলে শিলিগুড়ির তেনজিং নোরগে বাস স্ট্যান্ড থেকে দার্জিলিং বাস স্ট্যান্ড অবধি বাসে যেতে পারেন। সেক্ষেত্রে খরচ পড়বে জনপ্রতি ১০০ টাকা মত। ক্ষেত্রবিশেষে ২৫০ টাকা অবধি হতে পারে। সকালের দিকে পরপর তিনটি বাস রয়েছে। যদি কলকাতা থেকে সরাসরি বাসে যেতে চান, সেক্ষেত্রে এসপ্ল্যানেড থেকে বাস ছাড়ে। টিকিটের দাম ১২০০ থেকে ১৫০০ টাকার মধ্যে।

দার্জিলিং এ বিভিন্ন বাজেটের হোটেল, রিসোর্ট, লজ এবং হোম স্টে পাওয়া যায়। ভালো হোটেলে প্রতিরাতের ভাড়া ১৫০০ থেকে শুরু করে ৪০০০ টাকার মধ্যে হয়। এর থেকেও অনেক বেশি দামের হোটেল আছে। অবধি হোটেল টাকা বাজেটের মধ্যে একরাতের থাকার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। তবে হোটেলগুলো দার্জিলিং মল অঞ্চলে নিলে যাতায়াতের সুবিধা। মল অঞ্চল থেকে দূরে নিলে হোটেল ভাড়া কম পড়বে। তবে যেহেতু বিভিন্ন জায়গায় গাড়ি করে ঘুরতে হবে,তাই ঘোরাঘুরির জন্য হোটেলের নিজস্ব ব্যবস্থায় পে করে গাড়ি বা  জিপ আছে কিনা তা দেখে নিতে হবে। একইসাথে হোটেলের রুমগুলিতে গিজার ও রুম হিটার আছে কি না দেখে নিতে হবে। জলের ব্যবস্থা কেমন সেটাও জেনে নেওয়া ভালো।

এখানে বহু দর্শনীয় স্থান রয়েছে। সেগুলো ঘোরার জন্য গাড়িভাড়া করতে হবে। গাড়ি ভাড়া করার আগে জিজ্ঞেস করে নেবেন কোন কোন স্থান তারা দেখাবে। ওদের তালিকায় বেশ কিছু পয়েন্ট ধরা থাকে। মোটামুটি ২৫০০ থেকে ৩৫০০ টাকা পড়বে। অনেকক্ষেত্রেই কিন্তু বৌদ্ধমন্দির বা কোন দর্শনীয় স্থান বন্ধ থাকলে বাইরে থেকে দেখিয়ে সেটাকে তারা গুনতির মধ্যে ধরে। তাই আগে থেকে কথা বলে নেওয়া ভালো।

টাইগার হিল থেকে  ভোরবেলা এবং সকালবেলায় কাঞ্চনজঙ্ঘার ভিউ।
টাইগার হিল থেকে ভোরবেলা এবং সকালবেলায় কাঞ্চনজঙ্ঘার ভিউ।

টাইগার হিল – টাইগার হিল থেকে বিশ্বের তৃতীয় উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘার বরফাচ্ছাদিত শৃঙ্গের সৌন্দর্য দেখা দার্জিলিং-এর অন্যতম আকর্ষণ। তবে তার জন্য মোটামুটি রাত সাড়ে ৩টে থেকে ৪টের যেতে হবে টাইগার হিলে। গরমকালে আরও আগে যেতে হবে। সূর্যোদয়ের পরে কাঞ্চনজঙ্ঘার তুষারাবৃত গিরিশৃঙ্গ যে আগুনের রূপ নেয়, তা লিখে বোঝানো মুস্কিল। বেশ কিছুক্ষণ এখানে থাকতে ইচ্ছে হবে। সময় কখন বেরিয়ে যাবে বুঝতেও পারবেন না। কিছুক্ষণ পর সকালবেলায় কাঞ্চনজঙ্ঘার শৃঙ্গের রঙ দেখবেন কেমন বদলে গেছে। ধবধবে সাদা। টাইগার হিলে শীতের জামাকাপড় বেশি করে পড়বেন। এখানে প্রচুর ঠাণ্ডা থাকে।

টয় ট্রেন
টয় ট্রেন। ছবি ইন্টারনেট

টয় ট্রেন – দার্জিলিংয়ে যাবেন আর টয় ট্রেনে চাপবেন না এমনটা হতে পারে না। নিউ জলপাইগুড়ি থেকে পাহাড়ি রাস্তার আঁকাবাঁকা পথে দার্জিলিং স্টেশন অবধি টয় ট্রেন চলে। তবে এতটা পথ সাধারণত টয় ট্রেনে আসে না লোকে, কারণ সময় অনেক বেশি নেবে। পর্যটকেরা টয় ট্রেনের জয় রাইড (joy ride) বুক করে। এটি অনলাইনে সরাসরি বুক করতে পারেন বা দার্জিলিং-তে এসেও বুক করতে পারেন। করোনার কারণে ২০২০ সালের মার্চ মাস থেকে বন্ধ ছিল টয় ট্রেনের সার্ভিস। আবার ২০২০ সালের ডিসেম্বর ২৫ থেকে ফের চালু হয়েছে এই ট্রেন। জয় রাইড দার্জিলিং স্টেশন থেকে ঘুম স্টেশন হয়ে আবার দার্জিলিং স্টেশনে আপনাকে নামিয়ে দেবে। ট্রেনে চেপে পাহাড়ি পথে ঢিমে তালে যেতে যেতে পাহাড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করুন। পৃথিবীর সর্বোচ্চ রেল স্টেশন ঘুম ঘোরার অভিজ্ঞতা সারাজীবন মনের মণিকোঠায় রেখে দেওয়া যায়। প্রতি বছর, প্রায় ৬০,০০০ যাত্রী এই জয় রাইড উপভোগ করেন।

 বাতাসিয়া লুপ
বাতাসিয়া লুপ

বাতাসিয়া লুপ – টয়ট্রেনের জন্য তৈরি একটি সর্পিল রেলপথ হল বাতাসিয়া লুপ। এটি ১৯১৯ সালে চালু হয়েছিল। টয় ট্রেনের জয় রাইডে ১০ মিনিটের জন্য ট্রেন এখানে থামে। তবে ট্রেনে না চড়লেও এখানে আলাদাভাবে আসাই যায়। এখানে ভারতীয় সেনাবাহিনীর গোর্খা সৈন্য়, যারা দেশের জন্য তাদের জীবন উৎসর্গ করেছিল, তাদের সম্মান জানিয়ে একটি স্মৃতিসৌধ রয়েছে। এই স্মৃতিসৌধের পেছনে কাঞ্চনজঙ্ঘার তুষারাবৃত গিরিশৃঙ্গ দেখা যায়। সে এক অপরূপ দৃশ্য।

দার্জিলিং রোপওয়ে – এখানে রোপওয়েতে চড়তে পারেন। রোপওয়ে থেকে দার্জিলিংয়ের অসাধারণ ভিউ পাওয়া যায়। ২০০৩ সালে রোপওয়ে দুর্ঘটনায় চারজন পর্যটকের মৃত্যুর পর থেকে পরিষেবা বন্ধ ছিল। আবার সব ঠিক করে ২০১২ সাল থেকে পরিষেবা চালু হয়েছে।

রক গার্ডেন
রক গার্ডেন

রক গার্ডেন – দার্জিলিং থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে রক গার্ডেন অবস্থিত। ঘুম স্টেশনের পূর্বে ডানদিকে মোড় নিয়ে রক গার্ডেন যাওয়া যায়। এখানে সুন্দর ফুলের বাগানের পাশাপাশি বিভিন্ন উচ্চতায় পাহাড়ের গা ঘেঁষে বসার স্থান তৈরি হয়েছে। সঙ্গে আছে সুন্দর ঝর্না। বর্তমানে বেশ কিছু দোকানপাঠও হয়েছে।

গঙ্গা মায়া পার্ক – রক গার্ডেন থেকে ৩ কিলোমিটার নিচে গঙ্গা মায়া পার্ক অবস্থিত। জিএনএলএফ প্রতিবাদে পুলিশের গুলিতে নিহত ব্যক্তির নামে এই পার্কের নামকরণ। এখানে বোটিং ছাড়াও পর্যটকদের জন্য গোর্খা লোকনৃত্যের আয়োজন করা হয়।

দার্জিলিং চিড়িয়াখানা – এর পোশাকি নাম পদ্মজা নাইডু হিমালয়ান জুলজিক্যাল পার্ক। ৬৭.৫ একর জায়গা জুড়ে গড়ে ওঠা এই পার্কে স্নো লেপার্ড, রেড পাণ্ডার মত বিরল প্রজাতির প্রাণীর দেখা পাওয়া যায়। চিড়িয়াখানা ভালো করে ঘুরে দেখতে প্রায় তিন থেকে চার ঘন্টা সময় লাগবে। টিকিট কেটে এখানে প্রবেশ করতে হয়। এর ভিতরেই আছে হিমালয়ান ইন্সটিটিউট অফ মাউন্টেনিয়ারিং এবং তাদের মিউজিয়াম। এছাড়াও এর মধ্যেই আছে বেঙ্গল ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম।

হ্যাপি ভ্যালি টি স্টেট থেকে ভিউ।

হ্যাপি ভ্যালি টি স্টেট – এটি দার্জিলিং শহরের দ্বিতীয় প্রাচীনতম চা বাগান। ৪৪০ একর জুড়ে রয়েছে। ২০০৮ সাল থেকে বাগানটি জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে। গাইড সহ এখানে ঘুরতে পারেন এবং অবশ্যই চা কিনতে পারেন। এখান থেকে চা বাগানের খুব সুন্দর ভিউ নেওয়া যায়, বিভিন্ন পোশাক পরে ছবি তুলতে পারবেন। পোশাকের চার্জ আলাদা। তবে এখানের সব জায়গায় ছবি তোলা যায়না। সেই ব্যাপারে অবশ্যই নজর দেবেন।

এছাড়াও এখানে অন্যান্য বেশ কিছু চা বাগান আছে যেখানে যেতে পারেন। কোন চা বাগান পর্যটকদের জন্য খোলা সেই ব্যাপারে গাইডের সাথে কথা বলে নেওয়া বেশি ভালো। তবে যেখানেই যান না কেন, চা পাতা তুলে দেখবার কোন প্রয়োজন নেই। দূর থেকেই দেখুন।

মন্দির, চার্চ এবং বৌদ্ধমঠ – দার্জিলিং-তে অনেক পুরনো মন্দির, বৌদ্ধমঠ এবং চার্চ আছে, যেগুলো দেখার মত। ঘুম মনাস্ট্রি এদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে আটহাজার ফুট উচ্চতায় অবস্থিত এই মঠে ১৫ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট একটি বুদ্ধমূর্তি বর্তমান। এছাড়াও অন্যান্য উল্লেখযোগ্য জায়গাগুলো হল মহাকাল মন্দির, পিস প্যাগোডা, ডালি মনাস্ট্রি, ভুটিয়া বস্তি মনাস্ট্রি, সেন্ট আন্ড্রিউ চার্চ ইত্যাদি।

এতো গেল দার্জিলিং-তে কি কি দেখবেন। দার্জিলিং থেকে গাড়ি ভাড়া করে বেশ কিছু জায়গা ঘোরা যায়। দার্জিলিং ম্যালে থেকে দাওয়াইপানি গ্রাম যাওয়া যায়। গোটা গ্রামটাই যেন কাঞ্চনজঙ্ঘার ভিউ পয়েন্ট। দার্জিলিং থেকে মাত্র ১৯ কিলোমিটার দূরে লেপচাদের অদ্ভুত সুন্দর এক আদিবাসী গ্রাম। নিজের গাড়ি বা শেয়ারের জিপে মিরিক ঘুরে আসা যায়। মিরিক যাবার রাস্তায় পড়বে মহানন্দা অভয়ারণ্য। এছাড়া টয় ট্রেনে কার্শিয়াং আসতে পারেন। কার্শিয়াং এ দেখা যেতে পারে দোহিল ইকো পার্ক, গিদ্দাপাহাড় ভিউ পয়েন্ট, মাকাইবাড়ি টি এস্টেট। এছাড়া দার্জিলিং থেকে চার ঘণ্টার দুরত্বে আছে লাভা, লোলেগাঁও এর মত জনপ্রিয় হিল স্টেশন।

দার্জিলিং যাওয়ার সবচেয়ে ভালো সময় হল মার্চ থেকে জুন মাস এবং অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর। বর্ষার সময় দার্জিলিংয়ের বিভিন্ন জায়গায় ধ্বস নামে তাই এসময় দার্জিলিং না যাওয়াই ভালো।

দার্জিলিং-তে চায়ের স্বাদ তো অবশ্যই নিতে হবে। তাছাড়াও এখানের মোমো ,থুপকা এগুলো খুবই জনপ্রিয়। থুপকা হল তিব্বতের জনপ্রিয় নুডলস স্যুপ। শুধু থুপকাই না, বিভিন্ন ধরনের স্যুপ এখানে পাওয়া যায়। এগুলো অবশ্যই খেয়ে দেখুন। এছাড়া বিভিন্ন তিব্বতি ডিশ খেয়ে দেখতে পারেন।

কেনাকাটির কথা বললেই প্রথমেই দার্জিলিং এর চা পাতার কথা আসবে। চা পাতা কিনতে গেলে ভালো টি স্টেট থেকে কিনতে হবে। আর কেনাকাটির জন্য অবশ্যই দার্জিলিং ম্যাল অঞ্চল। এখানে ছোট বড় দোকানগুলি থেকে কেনা যেতে পারে শীতের পোষাক সোয়েটার, মাফলার, লেদার জ্যাকেট, লেদার সু, বিভিন্ন গিফটের জিনিস ইত্যাদি কিনতে পারেন । তবে দোকানে জিনিসগুলোর যা দাম পাবেন, যদি টাইগার হিল বা অন্য কোন ভিউপয়েন্টের বাইরে রাস্তার ওপর যারা জিনিস বিক্রি করে তাদের কাছে কেনেন, তাহলে দাম অনেক কম পাবেন।


ট্রিপ টিপস

  • কিভাবে যাবেন – প্লেনে এলে বাগডোগরা বিমানবন্দরে নামতে হবে। তারপর প্রি-পেইড ট্যাক্সি স্ট্যান্ড থেকে ট্যাক্সি ভাড়া করে সরাসরি হোটেলে যাওয়া যায়। ট্রেনে করে আসতে চাইলে সবথেকে ভালো হয় হাওড়া বা শিয়ালদহ থেকে রাতের ট্রেনে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন। তারপর প্রি-পেইড ট্যাক্সি স্ট্যান্ড থেকে ট্যাক্সি ভাড়া করে সরাসরি হোটেলে যাওয়া যায়। তবে একটু কমভাড়ায় গাড়ি পেতে হলে দার্জিলিং-মোড় থেকে গাড়ি ভাড়া করা যায়। যদি কলকাতা থেকে সরাসরি বাসে যেতে চান, সেক্ষেত্রে এসপ্ল্যানেড থেকে বাস ছাড়ে।
  • কোথায় থাকবেন – দার্জিলিং এ বিভিন্ন বাজেটের হোটেল, রিসোর্ট, লজ এবং হোম স্টে পাওয়া যায়। হোটেলগুলো দার্জিলিং মল অঞ্চলে নিলে যাতায়াতের সুবিধা। মল অঞ্চল থেকে দূরে নিলে হোটেল ভাড়া কম পড়বে।
  • কি দেখবেন – টাইগারহিল থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘায় সূর্যোদয়, টয় ট্রেনে ভ্রমণ, বাতাসিয়া লুপ, রক গার্ডেন, রোপওয়েতে ভ্রমণ, গঙ্গা মায়া পার্ক, হ্যাপি ভ্যালি টি স্টেট, ঘুম মনেস্ট্রি, মহাকাল মন্দির, পিস প্যাগোডা, ডালি মনাস্ট্রি, ভুটিয়া বস্তি মনাস্ট্রি, সেন্ট আন্ড্রিউ চার্চ, বেঙ্গল ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম, দার্জিলিং চিড়িয়াখানা।
  • .কখন যাবেন – দার্জিলিং যাওয়ার সবচেয়ে ভালো সময় হল মার্চ থেকে জুন মাস এবং অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর।
  • সতর্কতা
    • গাড়ি ভাড়া করার আগে জিজ্ঞেস করে নেবেন কোন কোন স্থান তারা দেখাবে। ওদের তালিকায় বেশ কিছু পয়েন্ট ধরা থাকে। অনেকক্ষেত্রেই কিন্তু কোন দর্শনীয় স্থান বন্ধ থাকলে বাইরে থেকে দেখিয়ে সেটাকে তারা গুনতির মধ্যে ধরে। তাই আগে থেকে কথা বলে নেওয়া ভালো।
    • টাইগার হিলে শীতের জামাকাপড় বেশি করে পড়বেন। এখানে প্রচুর ঠাণ্ডা থাকে।
    • বর্ষাকালে দার্জিলিং এ ধস নামে তাই বর্ষায় যাওয়া এড়ানোই ভালো।
    • চা বাগানে এসে চা পাতা ছিঁড়বেন না।
  • বিশেষ পরামর্শ –
    • দার্জিলিং মোড় থেকে হোটেল অবধি গাড়িভাড়া স্টেশন থেকে নেওয়া গাড়ির তুলনায় কম। তবে দার্জিলিং মোড়ে বিকেল ৪টে অবধি গাড়ি পাওয়া যায়। স্টেশন থেকে সবসময় গাড়ি পাওয়া যায়।
    • টয় ট্রেনে জয় রাইড অবশ্যই করবেন। তবে টয় ট্রেন চেপে স্টেশন থেকে আসবার দরকার নেই, প্রচুর সময় লাগে।

তথ্যসূত্র


  1. নিজস্ব প্রতিবিধি
  2. https://en.wikipedia.org/
  3. https://timesofindia.indiatimes.com/
  4. https://vromonguide.com/
  5. https://indiarailinfo.com/

5 comments

আপনার মতামত জানান