আমরা দেখি কীভাবে

আমরা দেখি কীভাবে

চোখ একটি মূল্যবান এবং সংবেদনশীল ইন্দ্রিয়। এটি আমাদের চার পাশের সুন্দর পৃথিবীর রূপ ও রঙ দেখতে সাহায্য করে। চোখ বন্ধ করার পর আমরা হয়ত গন্ধ, স্বাদ, স্পর্শ বা শব্দের সাহায্যে কোনো বস্তুর রূপ কল্পনা করতে পারি কিন্তু তাদের প্রকৃত রূপ বা সৌন্দর্য দেখতে, উপভোগ করতে একমাত্র চোখই সাহায্য করে। তাই চোখের গুরুত্ব বা বলা ভাল দেখার গুরুত্ব অপরিসীম। এখন প্রশ্ন জাগতেই পারে যে আমরা দেখি কীভাবে? এখানে সেই বিষয়ে আলোকপাত করা হল।

আমরা চোখ দিয়ে দেখি তাই আমরা দেখি কীভাবে জানতে গেলে সবার আগে চোখের গঠন জানা প্রয়োজন। চোখ নিম্নলিখিত অংশ দিয়ে তৈরি (চিত্র – ১ ) :
১. অক্ষিগোলক (Eye Ball ) – চোখের কোটরের অভ্যন্তরে অবস্থিত ও একটি নিদিষ্ট সীমার চারদিকে ঘুরতে সক্ষম।
২. কর্নিয়া (Cornea) – এটি শ্বেত মন্ডলের সামনের স্বচ্ছ পর্দা।
৩. শ্বেত মন্ডল (Sclera) – এটি শক্ত, সাদা, অস্বচ্ছ বস্তু দিয়ে তৈরী। এটি চোখের আকৃতি ঠিক রাখে ও বাইরের আঘাত থেকে রক্ষা করে।
৪. কৃষ্ণ মন্ডল (Choroid) – এটি শ্বেত মন্ডলের অভ্যন্তরের একটি কালো আস্তরণ যা চোখের ভিতরের অভ্যন্তরীণ প্রতিফলন রোধ করে।
৫. আইরিশ (Iris) – কর্নিয়ার ঠিক পিছনের অর্ধস্বচ্ছ পর্দা যা লেন্সের ওপর আপতিত আলোক রশ্মির পরিমান নিয়ন্ত্রণ করে।
৬ পিউপিল (Pupil ) – আইরিশ এর মধ্যে যে ছিদ্রের মাধ্যমে চোখের মধ্যে আলো প্রবেশ করে।
৭. লেন্স (Lens) – আইরিশের ঠিক পিছন দিকে সিলিয়ারি পেশী ও সাসপেন্সারি লিগামেন্টের সাহায্যে অক্ষিগোলকের সাথে যুক্ত থাকে। এটি চোখের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
৮. রেটিনা (Retina) – চোখের লেন্সের পিছনের আলোক সংবেদনশীল অংশ এটি।
৯. আকুয়াস হিউমার ও ভিট্রিয়াস হিউমার (Aqueous humour And Vitreous humour) – কর্নিয়া ও লেন্সের মধ্যবর্তী স্থানে যে স্বচ্ছ লবণাক্ত জলীয় পদার্থ পূর্ণ থাকে তাকে আকুয়াস হিউমার বলে।রেটিনা ও চোখের লেন্সের মধ্যে যে জেলি জাতীয় পদার্থ পূরণ থাকে তাকে ভিট্রিয়াস হিউমার বলে।

চিত্র -১

মানবদেহে দুটি চোখ কয়েক সেন্টিমিটার দূরত্বে অবস্থান করে। তাই দুটি চোখে সামান্য আলাদা প্রতিবিম্ব তৈরী হয়। একটি চোখের মাধ্যমে আনুভূমিক তলে ১৫০ ডিগ্রি এবং দুটি চোখের মাধ্যমে প্রায় ১৮০ ডিগ্রি দেখতে পাই। মস্তিষ্ক এই প্রতিবিম্ব দুটিকে একত্রিত করে।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

এই দর্শন প্রক্রিয়াটি বেশ জটিল এবং কয়েকটি ধাপের মাধ্যমে সংগঠিত হয়। ধাপগুলি হল :
১. চোখে আলোক রশ্মির প্রবেশ
২. রেটিনাতে বস্তুর প্রতিবিম্ব গঠন
৩. প্রবিষ্ট রশ্মির বৈদ্যুতিক সিগনালে রূপান্তর
৪. প্রতিবিম্ব সম্পর্কিত স্নায়ু অনুভূতি মস্তিষ্কে প্রেরণ
৫. মস্তিষ্কে স্নায়ু অনুভূতির বিশ্লেষণ ও দর্শন

চিত্র – ২

মানুষের চোখ একটি ক্যামেরার মত। এর লেন্স সিস্টেম রেটিনা নামক আলোক সংবেদনশীল (Light sensitive) পর্দার ওপর প্রতিবিম্ব (Image) সৃষ্টি করে। আলোকরশ্মি কর্নিয়া নামক একটি পাতলা স্বচ্ছ পর্দার (Transparent Membrane) মত অংশের মাধ্যমে চোখের মধ্যে প্রবেশ করে। চোখের মধ্যে প্রবিষ্ট বেশিরভাগ আলোক রশ্মির প্রতিসরণ (Refraction) কর্নিয়ার বহির্পৃষ্ঠের মাধ্যমেই হয়। স্ফটিকাকার লেন্স (Prism Shaped) ফোকাল লেন্থের (Focal Length) সূক্ষ্ম পরিবর্তন করে রেটিনার বিভিন্ন দূরত্বে থাকা বস্তুগুলির ওপর ফোকাস করে। চোখ ন্যূনতম ২৫ সেন্টিমিটার (Near point) থেকে দূরবর্তী স্থান (Far point) অবধি দেখতে পায় । সিলিয়ারি পেশির (Ciliary Muscle) সাহায্যে চোখের ফোকাল লেন্থ পরিবর্তনের এই ক্ষমতাকে একোমোডেশন পাওয়ার (Accomodation Power) বলে। কর্নিয়ার ঠিক পিছনেই আইরিশ থাকে। আইরিশ হল কালো রঙের একটি পেশীযুক্ত ডায়াফ্রাম। এটি পিউপিলের আকার পরিবর্তন করতে সাহায্য করে। পিউপিল চোখের মধ্যে প্রবিষ্ট আলোর পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করে।

চোখের লেন্স রেটিনার ওপর বস্তুর একটি উল্টানো বাস্তব (Inverted Real) চিত্র তৈরী করে। রেটিনা একটি সূক্ষ্ম ঝিল্লি (Transparent Membrane) যা প্রচুর সংখ্যক আলোক সংবেদী কোষ (Photo Receptor Cell) দিয়ে তৈরী। আলোক সংবেদী কোষ দুই ধরণের হয় – রড কোষ (rod cell) ও কোন কোষ (cone cell)। রড কোষগুলি আলোর প্রকৃতি (Nature) শনাক্ত করে আর কোন কোষগুলি আলোর বর্ণ (Colour) শনাক্ত করে এবং সেই অনুযায়ী মস্তিষ্কে সিগন্যাল প্রেরণ করে। আমাদের চোখ লাল, নীল, সবুজ এই তিন ধরনের আলোক তরঙ্গ শনাক্ত করতে পারে ও এই তিন বর্ণের সিগনালের সমন্বয়ে মস্তিষ্কে তৈরী হয় নানা রকমের যৌগিক বর্ণ।

কোন কোষ তৈরী হয় অপসিন (Opsin) নামের বর্ণ সংবেদনশীল প্রোটিন দিয়ে। আলোর ফোটন (Photon) কণা যখন অপসিনে এসে আঘাত করে তখন কোন কোষগুলি আলোক তরঙ্গ (Light Wave) শনাক্ত করে, আলোর মাত্রা অনুযায়ী আকৃতি পরিবর্তন করে ও মস্তিষ্কে সংকেত প্রেরণ করে। কোন কোষগুলি রেটিনার কেন্দ্র স্থলে ফোভিয়া (Fovia) নামক একটি ক্ষুদ্র বিন্দুতে কেন্দ্রীভূত থাকে। এই বিন্দুতে যখন ফোকাস হয় তখন রঙিন ছবিটি দর্শন কেন্দ্রে প্রতিভাত হয়। আলোক সংবেদী কোষগুলি প্রবিষ্ট আলোকরশ্মি দ্বারা সক্রিয় হয় এবং বৈদ্যুতিক সংকেত তৈরী করে। এই সংকেতগুলি অপটিক নার্ভের (Optic Nerve) মাধ্যমে মস্তিষ্কের ভিজ্যুয়াল কর্টেক্সে (Visual Cortex) প্রবেশ করে।

কিন্তু মস্তিষ্কে যাওয়ার পূর্বে সিগন্যালটি বেশ কয়েকটি ধাপ অতিক্রম করে। সিগন্যালগুলিকে অন্তর্বর্তী নিউরোন (Inter neuron), নিউরোন বা গ্যাংগ্লিয়ন কোষের (Gangleon cell) মাধ্যমে যেতে হয়। এই কোষগুলি ক্রস লিঙ্কড। প্রাপ্ত সিগনালগুলির তুল্যমূল্য বিচার করে, বেছে গ্যাংলিয়নগুলি সেগুলিকে মস্তিস্কে পাঠায়। অপটিক নার্ভ দুটি মস্তিকে প্রবেশের পূর্বে অপটিক কায়সমা (Optic chiasma) বিন্দুতে একত্রিত হয়। এখানে উভয় চোখের বাম দিকের সিগন্যালটি মস্তিস্কের বাম দিকে এবং ডান দিকের সিগন্যালটি মস্তিস্কের ডান দিকে প্রবেশ করে। দুটি সিগনাল এরপর একত্রিত হয়। সিগনাল থ্যালামাসের মাধ্যমে মস্তিস্কে যায়। এখানে আগত তথ্যগুলি দুইভাগে বিভক্ত হয়। একটিতে থাকে বর্ণ ও অন্যান্য খুঁটিনাটি বিষয়বস্তু । আর একটিতে থাকে বস্তুটির গতিময়তা (Movement) বা অন্যান্য বিশ্লেষণ। এবার বার্তা মস্তিষ্কের পিছনের অংশে পৌঁছায়। সেখান থেকে ভিজ্যুয়াল কর্টেক্স অংশে। ভিজ্যুয়াল কর্টেক্সটি এমনভাবে বিন্যস্ত থাকে যে এটি রেটিনার পিছনে আয়নার মত কাজ করে।

রেটিনার ওপর যে প্রতিবিম্ব গঠিত হয় সেটি উল্টানো। মস্তিষ্কে অপটিক নার্ভের মাধ্যমে আগত সংকেতগুলির বিশ্লেষণ হয়। বিশ্লেষণের পর আমাদের মস্তিষ্ক সেটিকে সোজা হিসাবেই ধরে। বস্তুগুলির পুনর্গঠিত ও সম্পূর্ণ রূপ আমরা দেখতে পাই।

আমরা দেখি কীভাবে তা সহজে বোঝার জন্য উপরে বর্ণিত জটিল পদ্ধতির সরল পথটি ফ্লো চার্টের ( চিত্র – ৩ ) মাধ্যমে দেখানো হল।

চিত্র – ৩

এছাড়া পঞ্চেন্দ্রিয় অর্থাৎ নাক, কান ইত্যাদি দিয়ে ঘ্রাণ গ্রহণ, শোনা ইত্যাদি কীভাবে হয় সেই সম্পর্কে আমরা এই লিঙ্কে জেনেছি।

তথ্যসূত্র


  1. NCERT Science Text book ( Class -x, 2019, Page - 187-88)
  2. https://www.news-medical.net/
  3. http://keratoconuscanada.org/
  4. https://en.m.wikipedia.org

2 comments

আপনার মতামত জানান