বাঙালির নিত্যদিনের সকাল শুরুর একটাই ঠিকানা গরম চা-বিস্কুট আর এই চা নিয়ে বাঙালির খুঁতখুঁতেমি রয়েছে অঢেল, স্বাদ আর গন্ধের পাল্লায় কখনও দার্জিলিং চা, কখনও আসাম চা ভারী হয়ে পড়ে। তবে স্বাদে ও গন্ধে দার্জিলিং চা যে তুলনাহীন তা সকলেই স্বীকার করবেন আর এই দার্জিলিং চা-এর দুনিয়ায় সুপ্রাচীন ঐতিহ্য নিয়ে আজও বহমান মকাইবাড়ি চা বাগান ওরফে মকাইবাড়ি টি এস্টেট। দার্জিলিং-এর প্রথম চা বাগান নাকি গড়ে উঠেছিল এখানেই। বিশ্বের মধ্যে আজও মকাইবাড়ির চায়ের স্বাদ ও গন্ধ অতুলনীয় এবং এর খ্যাতি ক্রমবর্ধমান। দার্জিলিং তো বাঙালির গতে বাঁধা ঘোরার জায়গা, কিন্তু এই দার্জিলিং থেকে ফেরার পথেই কার্শিয়াং ছাড়িয়ে যে মকাইবাড়ি টি এস্টেট রয়েছে তা ঘুরে দেখার কথা সচরাচর ভাবেন না সকলে। চায়ের স্বাদ ও গন্ধ কীভাবে বেড়ে ওঠে পাহাড়ের ঢালে, চা বাগানের গান শুনতে শুনতে তা উপভোগ করতে হলে অবশ্যই আসতে হবে মকাইবাড়ি টি এস্টেট ভ্রমণে।

পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং জেলার কার্শিয়াং মহকুমার অন্তর্গত এই মকাইবাড়ি টি এস্টেট। দার্জিলিং থেকে ফেরার পথে কার্শিয়াং ছাড়িয়ে পাঙ্খাবাড়ি রোডের ধারেই দেখা মেলে এই চা বাগানের। মূলত কার্শিয়াং-এর কোদোবাড়ি, ফুলবাড়ি, কৈলাপানি, চেপ্টে, মকাইবাড়ি, থাপাথালি এবং ছুঙ্গে এই সাতটি গ্রাম নিয়েই সমগ্র টি এস্টেটটি বিস্তৃত। মোট ৬৭০ হেক্টর জমির মধ্যে মাত্র ১২০ হেক্টর জমিতেই এখানে কেবল চা চাষ হয়ে থাকে। সমুদ্রতল থেকে ১৫০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত মকাইবাড়ি টি এস্টেটের মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে তিনটি নদী যারা আবার বালাসোন নদীতে গিয়ে মিশেছে।
স্থানীয় ভাষায় ‘মকাইবাড়ি’ কথার অর্থ হল ভুট্টার ক্ষেত। মূলত ব্রিটিশদের হাত ধরেই সমগ্র দার্জিলিং জেলায় চা উৎপাদন শুরু হয়েছিল। বলা ভালো ব্রিটিশদের মাধ্যমেই দার্জিলিং-এর শ্রীবৃদ্ধি ও আধুনিকীকরণ ঘটে। দার্জিলিং টি কোম্পানির এজেন্ট জনৈক ব্রিটিশ অফিসার ক্যাপ্টেন সামলার প্রথম কার্শিয়াং-এর কাছে মকাইবাড়ি টি এস্টেট গড়ে তোলেন। সালটা ১৮৫২। পরবর্তীকালে সেই চা বাগানের মালিকানা হস্তান্তরিত হয় সামলার সাহেবের ঘনিষ্ঠ বন্ধু গিরিশচন্দ্র ব্যানার্জির কাছে। এই গিরিশচন্দ্র ব্যানার্জি সেই সময় দার্জিলিং-এর একটি কমিশনারি ও ডাক পরিষেবা চালাতেন। সেই সময় থেকেই বাঙালি মালিকানার অধীনে বেড়ে উঠেছে এই চা বাগান। ১৮৫৯ সালে প্রথম মকাইবাড়ি টি এস্টেটে চা উৎপাদন কারখানাটি চালু হয়। ফলে সমগ্র দার্জিলিং-এর মধ্যে এটিই সবথেকে প্রাচীন চা বাগান। যদিও ১৯৩৩ সালে এই চা উৎপাদন কারখানাটি বন্ধ হয়ে যায়। মকাইবাড়ি টি এস্টেটে ক্যাপ্টেন সামলারের সংক্ষিপ্ত মালিকানা থাকলেও বাকি পুরো অংশটাই ছিল ব্যানার্জিদের অধীনে। ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ব্যানার্জি পরিবারের চতুর্থ প্রজন্ম চা-উৎপাদক ও গবেষক স্বরাজ কুমার ব্যানার্জি এই টি এস্টেট ও কারখানাটি পরিচালনা করেছেন। ২০১৪ সালে লক্ষ্মী গ্রুপ মকাইবাড়ি টি এস্টেট অধিকার করে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ২০১৭ সাল পর্যন্ত এই কোম্পানির চেয়ারম্যান পদে আসীন ছিলেন স্বরাজ কুমার ব্যানার্জি। এই লক্ষ্মী গ্রুপের অধীনে আসাম, দার্জিলিং, রোয়ান্ডা ও উত্তরবঙ্গের মোট ২৫টি চা বাগান রয়েছে। কোম্পানির পরবর্তী চেয়ারম্যান দীপঙ্কর চ্যাটার্জী দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে চা উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত। ২০১৭ সালেই রুদ্র চ্যাটার্জীর হাতে সমস্ত দায়িত্ব অর্পণ করে স্বরাজ কুমার ব্যানার্জি মকাইবাড়ি টি এস্টেট ছেড়ে চলে যান। ঠিক তার পরের বছর ২০১৮ সালে তিনি ঘোষণা করেন যে মকাইবাড়ি টি এস্টেট ও ট্রেডিং কোম্পানিতে তাঁর যে পরিমাণ অংশীদারি কলকাতা কেন্দ্রিক লক্ষ্মী গ্রুপকে বিক্রি করার পরেও অবশিষ্ট ছিল তার ১২ শতাংশ এই চা বাগানের কর্মীদের উপহার দেবেন। অনেকে বলে থাকেন বিশ্বের প্রথম চা বাণিজ্য সংস্থা গড়ে উঠেছিল এই মকাইবাড়িতেই। ‘ফেয়ার ট্রেড’ আখ্যাপ্রাপ্ত প্রথম চা বাগান ছিল এটি এবং এখানেই প্রথম তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে মহিলাদের নিযুক্ত করার রীতি চালু হয়। আজও এখানে স্থানীয় সম্প্রদায়ভুক্ত যে ৭০০ কর্মী কাজ করেন, তার ৭০ শতাংশই মহিলা। ১৯৮৮ সালে প্রথম এই চা বাগানটিই সম্পূর্ণ জৈব চা বাগান হিসেবে প্রত্যয়িত হয়।
মকাইবাড়িতে চা বাগানের পাশাপাশি রয়েছে এক বিরাট অরণ্যাঞ্চল। কোনও কোনও প্রান্তে এই চা বাগান মিশে গিয়েছে গভীর জঙ্গলে। মকাইবাড়ির জঙ্গলে ২০ রকম প্রজাতির বাঁশ জন্মায়, তাছাড়া পাওয়া যায় বার্চ, ম্যাপল, ফার্নও। টি এস্টেট ও বনাঞ্চল জুড়ে প্রায় তিনশ প্রজাতির পাখির দেখা মেলে। সঙ্গে গভীর অরণ্যে প্রায়ই হরিণ, বুনো শুয়োর, বাঁদর আর চিতার আনাগোনা দেখা যায়। পাহাড়, নদী, অরণ্য, চা বাগিচা, ফুল, পাখি সব মিলিয়ে এই মকাইবাড়ি টি এস্টেট জুড়ে একটি সুষম বাস্তুতন্ত্র গড়ে উঠেছে। এস্টেটের পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তে মোট সাতটি গ্রাম রয়েছে যেখানে প্রায় দেড় হাজার মানুষের জীবন-জীবিকা এই টি এস্টেটের উপরেই নির্ভরশীল। মকাইবাড়ি টি এস্টেটের এক অতি পরিচিত স্লোগান ‘হেলদি সয়েল হেলদি ম্যানকাইন্ড’। বছরে প্রায় এক লক্ষ কেজি চা উৎপাদিত হয় মকাইবাড়ি চা বাগান থেকে। যেখানে দার্জিলিং চায়ের গড় মূল্য কেজি প্রতি ৯৭০ থেকে ১০৫০ টাকা হয়ে থাকে, সেখানে মকাইবাড়ি চায়ের দাম গড়ে কেজি প্রতি ৩০০০ টাকা ধার্য হয়। তাছাড়া ২০১৪ সালে মকাইবাড়ির ফ্লাশ চায়ের মূল্য নীলামে প্রায় দেড় লক্ষ টাকা পর্যন্ত উঠেছিল যা এখনও পর্যন্ত বিক্রি হওয়া সবথেকে দামি চা।
ট্রেনে করে মকাইবাড়ি টি এস্টেট আসতে হলে নিকটবর্তী নিউ জলপাইগুড়ি রেল স্টেশনে নামতে হবে। তারপর স্টেশন থেকে প্রথমে গাড়ি ভাড়া করে কার্শিয়াং-এ এসে তারপর একটা জিপ চড়ে ঘন্টাখানেকের মধ্যেই মকাইবাড়ি পৌঁছান যায়। তাছাড়া প্লেনে করে আসতে হলে নিকটস্থ বাগডোগরা বিমানবন্দরে নেমে সেখান থেকে একইভাবে গাড়ি ভাড়া করে অথবা বাসে ৪০ কিমি. পথ পেরিয়ে মকাইবাড়ি টি এস্টেট আসা যায়।
‘ভলেন্টিয়ার ইন মকাইবাড়ি’ প্রকল্পের আওতায় মকাইবাড়ি টি এস্টেটে পর্যটকদের থাকা এবং ঘোরার সুব্যবস্থা করা হয়েছে। এই প্রকল্পটি গ্রামের কিছু ছেলেরা মিলেই শুরু করেছে যারা এখানের গ্রামে ট্যুরিজমের দেখাশোনা করে। গ্রামগুলিতে রয়েছে অনেকগুলি হোম স্টে। সেই হোম-স্টেগুলিতে গোর্খা চা শ্রমিকরা নিজেদের বাড়ির লাগোয়া অংশে অতিথিদের থাকার ব্যবস্থা করেছে। ২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী এই হো-স্টেগুলিতে থাকার খরচ মাথাপিছু প্রতি রাতে প্রায় ১০০০ টাকা যার মধ্যে বাড়িতে বানানো প্রাতরাশ ও দুই বেলার আহারও অন্তর্ভুক্ত। এছাড়া কিছু ‘ইকো-হাট’ও রয়েছে। তবে মকাইবাড়িতে থাকতে হলে আগে থেকে ফোনে বুকিং করে আসা জরুরি।
মকাইবাড়ি টি এস্টেট ভ্রমণ বলতে এক ও একমাত্র চা বাগানের মনোরম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগই প্রধান। বিস্তৃত চা বাগানের মধ্য দিয়ে হাঁটতে পারেন অনেক অনেক দূর পর্যন্ত। চারপাশে চা-শ্রমিকদের চা পাতা তোলা দেখতে পারেন। বিশেষ দ্রষ্টব্যের মধ্যে মকাইবাড়ির সুপ্রাচীন চা প্রস্তুতি কারখানাটিও রয়েছে। কাঠ, বাঁশ ও কাস্ট আয়রন দিয়ে নির্মিত এই কারখানাটি আজও সমানভাবে কার্যকর রয়েছে, কারখানার গায়ে জড়িয়ে আছে দেড় শতক আগের ইতিহাসের গন্ধ। কীভাবে চা প্রস্তুত হয় তার সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি নিপুণভাবে পর্যবেক্ষণ করতে পারেন এই কারখানাতে, চাইলে টি-মাস্টারের সঙ্গে বিশেষ অনুমতি নিয়ে চায়ের স্বাদও নিরীক্ষণ করে দেখতে পারেন। আর চায়ের বাগানে পাখি দেখা কিংবা জঙ্গলের মধ্য দিয়ে বহুদূর ট্রেক করে চলে যাওয়ার বিকল্প তো আছেই। সাইটসিইং বলতে একমাত্র নিকটস্থ কার্শিয়াং রয়েছে। ডাউ হিল, ফরেস্ট মিউজিয়াম, ঈগলস ক্রেগ ভিউ পয়েন্ট, গিদ্দা পাহাড় ভিউ পয়েন্ট এবং নেতাজি সুভাষ বসু সংগ্রহশালাটি একে একে ঘুরে দেখে নিতে পারেন। তিন-চার দিনের ট্যুরে এলে ভালভাবে সব জায়গা ঘুরে দেখা যায়।

বছরের যে কোনও সময়েই মকাইবাড়ি টি এস্টেট যাওয়া যায়, কিন্তু বর্ষাকালটা এড়িয়ে চলাই ভাল। যদিও বর্ষাকালেই চা বাগান অপরূপ মোহনীয় হয়ে ওঠে। কিন্তু বৃষ্টির কারণে ঘোরার পরিকল্পনা মাটি হতে পারে। তবে অল্প শীতে অর্থাৎ অক্টোবর-নভেম্বর কিংবা ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে এলে খুবই ভাল পরিবেশ পাওয়া যাবে।
মকাইবাড়ি ঘুরতে আসবেন আর মকাইবাড়ির চা খাবেন না তা তো হয় না। তাই সাধ্যে কুলোলে এক প্যাকেট মকাইবাড়ি স্পেশাল চা অল্প হলেও কিনে নিতেই পারেন। বিভিন্ন ধরনের এবং দামের মকাইবাড়ি চা পাওয়া যায় এখানে। স্মৃতি হিসেবে সেই চায়ের চুমুকে বাড়ি ফিরে বারবারই মনে পড়বে মকাইবাড়ির কথা।
ট্রিপ টিপস
- কীভাবে যাবেন – ট্রেনে করে মকাইবাড়ি টি এস্টেট আসতে হলে নিকটবর্তী নিউ জলপাইগুড়ি রেলস্টেশনে নামতে হবে। তারপর স্টেশন থেকে প্রথমে গাড়ি ভাড়া করে কার্শিয়াং-এ এসে তারপর একটা জিপ চড়ে ঘন্টাখানেকের মধ্যেই মকাইবাড়ি পৌঁছান যায়। তাছাড়া প্লেনে করে আসতে হলে নিকটস্থ বাগডোগরা বিমানবন্দরে নেমে সেখান থেকে একইভাবে গাড়ি ভাড়া করে অথবা বাসে ৪০ কিমি. পথ পেরিয়ে মকাইবাড়ি টি এস্টেট আসা যায়।
- কোথায় থাকবেন – মকাইবাড়ি টি এস্টেটের গ্রামগুলিতে রয়েছে অনেকগুলি হোম স্টে। ২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী এই হোমস্টে গুলিতে থাকার খরচ মাথাপিছু প্রতি রাতে প্রায় ১০০০ টাকা যার মধ্যে বাড়িতে বানানো প্রাতরাশ ও দুই বেলার আহারও অন্তর্ভুক্ত।
- কী দেখবেন – মকাইবাড়ির চা বাগান ও বিস্তৃত অরণ্য এখানকার বিশেষ দ্রষ্টব্য। তাছাড়া বিশেষ দ্রষ্টব্যের মধ্যে মকাইবাড়ির সুপ্রাচীন চা প্রস্তুতি কারখানাটিও রয়েছে। সাইটসিইং-এর মধ্যে নিকটবর্তী কার্শিয়াং-এর ঈগলস ক্রেগ ভিউ পয়েন্ট, ডাউ হিল, গিদ্দ পাহাড় কিংবা নেতাজী সুভাষ বসু সংগ্রহশালা ঘুরে দেখতে পারেন।
- কখন যাবেন – বছরের যে কোনও সময়েই মকাইবাড়ি টি এস্টেট যাওয়া যায়, কিন্তু বর্ষাকালটা এড়িয়ে চলাই ভাল। অল্প শীতে অর্থাৎ অক্টোবর-নভেম্বর কিংবা ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাস এলে খুবই ভাল পরিবেশ পাওয়া যাবে।
- সতর্কতা –
- জঙ্গলে ঘোরার সময় বন্য প্রাণী ও পাখিদের কোনওভাবেই উত্যক্ত করবেন না।
- গাছের পাতা ছেঁড়া গর্হিত অপরাধ।
- চা-শ্রমিকদের সঙ্গে শ্রদ্ধাবনত ব্যবহার করবেন। তাঁদের সম্মান প্রদর্শন অবশ্য কর্তব্য।
- মকাইবাড়ি টি এস্টেটের পরিবেশ যাতে কোনওভাবে নোংরা না হয়, সেদিকে সতর্ক থাকতে হবে।
- শিশুদেরও সঙ্গে নিয়ে আসা যায় এখানে, তবে চা বাগানের ভিতরে তাঁদের নিয়ে পিকনিক করতে বসে যাবেন না।
- বিশেষ পরামর্শ –
- মকাইবাড়ি চা বাগানের উৎকৃষ্ট চা অল্প হলেও খানিক সঙ্গে করে কিনে নিয়ে যেতে পারেন।