পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্গত পূর্ব মেদিনীপুর জেলার অন্তর্গত হলদিয়া সাবডিভিশনের একটি ইতিহাস প্রসিদ্ধ জনপদ হল মহিষাদল (Mahishadal) । ভৌগোলিক দিক থেকে দেখলে মহিষাদল ২২°১১′০০.০″উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৭°৫৯′০০.০″পূর্ব দ্রাঘিমাংশ বরাবর অবস্থান করছে।

মহিষাদল এক সময়ে সমুদ্রের তলায় নিমজ্জিত ছিল। পরবর্তীকালে ধীরে ধীরে পলি পড়ে চর তৈরি হয়। সমুদ্রগর্ভ থেকে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে আজকের মহিষাদল। সপ্তম শতকের শুরুতে হিউয়েন সাঙয়ের তাম্রলিপ্ত বন্দরে আগমনকালীন তাঁর বিবরণ থেকে এখনকার মহিষাদলের একসময়ে সমুদ্রগর্ভে অবস্থানের সাক্ষ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়।
মহিষাদল নামের উৎপত্তি নিয়ে সাধারণভাবে তিনটি মত প্রচলিত আছে। কেউ বলেন এই দ্বীপটির আকার ছিল মোষ বা মহিষের মতাে। আবার কারও মতে, এই দ্বীপে প্রচুর বুনো মোষ দেখা যেত। অন্য একটি সূত্র অনুযায়ী মাহিষ্য জাতি থেকে এই জায়গার নাম মহিষাদল।তবে বেশীরভাগ ঐতিহাসিক মনে করেন মহিষাদল নামটি এসেছে মহিষ থেকে। উইলিয়াম হেজেস তাঁর ডায়েরিতে মহিষাদলকে Buffalo Pt. বলেছেন। ১৭০১ সালে নাবিকদের pilot chart এ মহিষাদলকে Buffalo Pt. হিসেবে উল্লেখের নজির পাওয়া যায়। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে জেলা কালেক্টর বেইলী সাহেব মহিষাদলের এই বুনো মোষের কান্ডকারখানা স্বচক্ষে দেখেছিলেন। তিনি তাঁর লেখা ‘মেমােরান্ডা অফ মিডনাপোর’ বইতে এই বুনাে মােষের অত্যাচারের বর্ণনা দিয়েছেন।
মহিষাদলের প্রাচীন ইতিহাস বিষয়ে নানান বিতর্ক আছে। মহিষাদলের বিভিন্ন স্থান থেকে পাওয়া মানুষের বিভিন্ন ফসিল ও বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক সামগ্রী দেখে ধারণা করা এটি যথেষ্ট প্রাচীন একটি জনপদ। আর্কেওলোজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার মতে মহিষাদলে প্রাপ্ত এসব পুরা সামগ্রী এই ধারণাই প্রমাণ করে যে এখানে প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে আধুনিক কাল অবধি মনুষ্য বসতি ছিল।
মহিষাদলের নাম উঠলেই অবশ্যম্ভাবী রাজবাড়ীর কথা ওঠে। মহিষাদলের প্রথম রাজা হিসেবে কল্যাণ রায়চৌধুরীকে ধরা হয়ে থাকে। ১৬৫৩ সালে এই রাজার রাজত্ব ছিল মহিষাদলে। কল্যাণ রায়চৌধুরীর আগে অবশ্য কোন রাজার নাম জানা যায়নি। তাঁর রাজধানী ছিল গড়গুমাই। ষষ্ঠদশ শতকে উত্তরপ্রদেশ থেকে জনৈক জনার্দন উপাধ্যায় ব্যবসার জন্য মহিষাদলে আসেন এবং কল্যাণ রায়চৌধুরির থেকে মহিষাদলের স্বত্ব কিনে তিনি নতুন রাজা হন। আধুনিক মহিষাদলকে গড়ে তোলবার পিছনে যাঁর ভূমিকা সর্বাধিক তিনি হলেন রাজা দেবপ্রসাদ গর্গ। দেব প্রসাদ গর্গ বহুমুখী প্রতিভাধর ও শিকারে পটু ছিলেন। ১৯৫২ এবং ১৯৫৭ সালের সাধারণ নির্বাচনে নির্দল প্রার্থী হিসেবে তিনি জয়ী হয়েছিলেন। মহিষাদল রাজ কলেজের প্রতিষ্ঠাতাও তিনি। এখানকার বহু প্রতিষ্ঠানেই তিনি মুক্ত হস্তে দান করেছেন।
মহিষাদলের কোনায় কোনায় ইতিহাস যেন লুকোচুরি খেলে। এখানকার উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থানগুলি হল-
রঙ্গিবসান রাজবাটী: ১৮৪০ সালে রাজা জগন্নাথ গর্গের আমলে নির্মিত হয় এই রাজপ্রাসাদ। এই প্রাসাদে ৩৫-৪০টি বিশাল ঘর আছে।
ফুলবাগ রাজবাটী: এটি তথাকথিত আধুনিক এখানকার অন্যান্য রাজবাড়ীর তুলনায়। ১৯৩৪ সালে নির্মিত এই রাজবাড়ী তৈরি করান রাজা সতীপ্রসাদ গর্গ।
মিউজিয়াম: ফুলবাগ রাজবাড়ীতে রয়েছে এই মিউজিয়াম। রাজবাড়ীর সদস্যদের ব্যবহৃত সামগ্রী এখানে প্রদর্শিত আছে। একসময় এখানে কবি ফারদৌসী রচিত শাহনামা গ্রন্থটি এই বাড়ির অধিকারে ছিল।
গোপাল জীউর নবরত্ন মন্দির: এই মন্দিরটির স্থাপনকাল ১৭৭৮। এটি রাজবাড়ীর ভেতরেই অবস্থিত।
লালকুঠি: এই লালকুঠির নির্মাণ সম্পর্কে জানা যায় এটি ১৮৯২ সালে প্রতিষ্ঠিত।
গেঁওখালি: ভাগীরথী এবং রূপনারায়ণের সঙ্গম স্থলের দক্ষিণ তীরে অবস্থিত গেঁওখালি ২৪ পরগণা, হাওড়া ও মেদিনীপুর জেলার সঙ্গমস্থল। এখানে হিজলি টাইডাল ক্যানেলও এসে মিলেছে। ১৮৮৮ সালে উইলিয়াম কেরী গেঁওখালিতে এসেছিলেন ধর্মপ্রচার করতে। জগমোহন পন্ডিতের দেশবলি বিবৃতিতে তমলুকের কিছুদূরের এক জলাধারকে গঙ্গাখালি নামে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য গেঁওখালি পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছে।
দেওয়ান সাহেবের বাড়ি : রামবাগে অবস্থান করছে এই বিশাল দেওয়ান বাড়ি। ১৯০৩ সালে রাজা সতীপ্রসাদ গর্গ ভগ্নিপতি প্রভাতচন্দ্র দুঁবেকে দেওয়ান নিযুক্ত করলে সেই থেকেই এই বাড়ির নাম দেওয়ান সাহেবের বাড়ি।
নাটশাল: নাটশাল থেকে প্রত্নতাত্ত্বিক শ্রী প্রশান্ত কুমার মন্ডল মানুষের দেহের বিভিন্ন অংশের ফসিল ও হাড় এবং হরিণের শিঙ এর অনেক শিল্প কার্য আবিষ্কার করেন। মনে করা হয় এগুলি পুরাতন প্রস্তর যুগের সময়কালের অর্থাৎ ১০-১৫ হাজার বা তারও বেশি প্রাচীন।
মীরপুর: মহিষাদলের রাজা আনন্দীলাল উপাধ্যায় এর শাসনকালে বর্গী আক্রমণ থেকে বাঁচতে রাজা আনন্দীলাল একদল পর্তুগিজ গোলন্দাজ নিযুক্ত করেছিলেন। তিনি তাদের মীরপুরে ১০০ বিঘা জমিও দান করেছিলেন। এখানকার বাসিন্দাদের দেখতে বাঙালী হলেও নাম কিন্তু পর্তুগিজ। এরা সকলেই খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী।
ভোলসরা লকগেট: এটি একটি অনবদ্য পিকনিক স্পট। ভোলসরা খাল ও রূপনারায়ণের পাড়ে এটি অবস্থিত।
মহিষাদলে যেমন প্রাচীন ইতিহাসের সাক্ষ্য ছড়িয়ে আছে সমগ্র জনপদজুড়ে তেমনি এই জনপদ বহু কৃতী সন্তানেরও গর্বিত জননী। দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে মহিষাদলের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা বহু মানুষই জানেননা। জানেননা অনেকেই স্বাধীন তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকারের সর্বাধিনায়ক সতীশ সামন্ত এখানকারই ভূমিপুত্র। তাম্রলিপ্ত সরকারের আরেক সক্রিয় সদস্য সুশীল ধাড়ার রাজনৈতিক কার্যাবলীর ক্ষেত্রও ছিল এই মহিষাদল। তাঁর প্রচেষ্টাতেই এলাকার প্রসূতি ও স্থানীয় মানুষদের চিকিৎসার জন্য গড়ে উঠেছিল ‘মাতৃ ভবন’। রাষ্ট্রপতি পুরস্কার প্রাপ্ত স্বাধীনতা সংগ্রামী চিত্তরঞ্জন সামন্ত এখানকারই বাসিন্দা। স্বাধীনতা আন্দোলনের বহু ঘটনার সাক্ষী এই মহিষাদল। স্বাধীনতা আন্দোলনের কথাই যখন উঠল তখন গান্ধীজীর কথা বলতেই হয়।
মহিষাদলের সাথে যে গান্ধীজিরও যোগ আছে তা হয়ত অনেকেই জানেন না। ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনে মহিষাদল ব্লকের লক্ষ্যা এলাকার তিনটি গ্রাম মাসুরিয়া, ডিহি মাসুরিয়া ও চণ্ডীপুর যোগদান করেছিল। ব্রিটিশ অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন এখানকার ৪৬ জন মহিলা। তা সত্ত্বেও লড়াই থেকে পিছপা হননি তাঁরা। এ বিষয়ে বাংলার ছোটলাটের অভিযোগের তদন্ত করতে গান্ধীজি জলপথে ১৯৪৫ সালের ২৫ ডিসেম্বর মহিষাদল এসেছিলেন। ছিলেন ২৯ ডিসেম্বর অবধি। গান্ধীজির এই মহিষাদল গমনকে কেন্দ্র করে প্রতি বছর এখানে গান্ধী মেলা অনুষ্ঠিত হয়। এক্তারপুর ক্যানেলের পশ্চিমপাড়ে যে ঘরে তিনি ছিলেন তা আজ গান্ধী কুটির নামে খ্যাত।
মহিষাদলে দুটি ডিগ্রি কলেজ রয়েছে। মহিষাদল রাজ কলেজ যার অন্যতম। জেলার একমাত্র মহিলা কলেজও এখানেই রয়েছে। এছাড়াও চারটি উচ্চমাধ্যমিক ও দুটি মাধ্যমিক স্কুল রয়েছে এখানে।
অনেকেই জানেননা আধুনিক হিন্দি সাহিত্যের অন্যতম খ্যাতনামা কবি সূর্যকান্ত ত্রিপাঠী এখানকার ভূমিপুত্র। এখানেই রামচরিত মানসের বহুবর্ণ চিত্রিত পুঁথি আঁকা হয়েছিল। এই ধরণের পুঁথি পশ্চিমবঙ্গে এখানেই একমাত্র পাওয়া গেছে।
প্রাচীন ইতিহাস ও স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস বুকে নিয়ে এগিয়ে চলা মহিষাদলের আরও একটি সম্পদ তার রথযাত্রা। মহিষাদলের অতি প্রাচীন এবং বিখ্যাত রথযাত্রা সম্পর্কে জানুন এখানে।
ইতিহাস, সংগ্রাম ও ধর্মের এক অপূর্ব সঙ্গমস্থল এই মহিষাদল।
তথ্যসূত্র
- https://en.wikipedia.org/
- https://www.anandabazar.com/
- https://www.anandabazar.com/
- https://www.anandabazar.com/
- https://www.anandabazar.com/
- মেদিনীকথা - পূর্ব মেদিনীপুর, পর্যটন ও পুরাকীর্তিঃ অরিন্দম ভৌমিকঃ পৃষ্ঠা ৭৯-৯৫
খুবই সুন্দর লেখা।