কলকাতার কাছেই অপূর্ব শান্তিমাখা গাদিয়াড়া তিন নদীর মিলনস্থল। দামোদর, রূপনারায়ণ আর হুগলি এই তিন নদী এসে মিশেছে এখানে। যদিও পূর্ব মেদিনীপুরের গেঁওখালিতেও এই তিনটি নদীর মিলনস্থল দেখা যায়, কিন্তু গাদিয়াড়ার সৌন্দর্য আর সুপ্রাচীন ঐতিহাসিক আবহ মিলেমিশে যেন এক অন্য মাত্রা এনে দেয় এখানকার পরিবেশে। নদীর পাড় ঘেঁষে পরপর বিরাট বিরাট গাছের সারির নিবিড় ছায়ায় হাঁটতে হাঁটতে সব নাগরিক ক্লান্তি ভুলে যেতে ঘুরতে আসতেই পারেন গাদিয়াড়া। এটা পিকনিক স্পট হিসেবেই অধিক পরিচিত।
কলকাতা থেকে মাত্র ৮৫ কিলোমিটার দূরত্ব অবস্থিত গাদিয়াড়া হাওড়া জেলার শ্যামপুর থানার অন্তর্গত। নদীপথে এখানে হাওড়ার সঙ্গে পূর্ব মেদিনীপুর এবং দক্ষিণ ২৪ পরগণার কিছু অংশ সংযুক্ত হয়ে আছে। ভৌগোলিক দিকের বিচারে গাদিয়াড়ার পূর্বদিকে দক্ষিণ ২৪ পরগণা আর দক্ষিণ দিকে পূর্ব মেদিনীপুর জেলার অবস্থান।
গাদিয়াড়া নামকরণের এক মজার ইতিহাস আছে। রূপনারায়ণ নদীর দক্ষিণ পাড়ে অবস্থিত গেঁওখালি থেকে আড়া তৈরির জন্য গরান গাছের কাঠ একসঙ্গে গাদাগাদি করে মানুষজন এই অঞ্চলে নিয়ে আসত এবং তারপর এখান থেকেই হাওড়ার অন্যান্য অঞ্চলে রপ্তানি করা হত সেই কাঠ। আড়ার গাদি থেকেই এই জনপদের নাম গাদিয়াড়া হয়েছে বলে মনে করা হয়। হাওড়া জেলার প্রাচীন ইতিহাসের এক অন্যতম অংশ এই গাদিয়াড়া । ‘হাওড়া ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার’ পত্রিকায় ১৯০৯ সালে এই অঞ্চলকে মাকড়া পাথর বলে বর্ণনা করা হয়েছিল। মাকড়া কথার আক্ষরিক অর্থ হল ঝামা পাথর। বস্তুত গাদিয়াড়া ফেরিঘাটের কাছেই নদীবাঁধের ধারে বটগাছের নীচে কয়েকটি কালো শিলাকে এখানকার স্থানীয় মানুষেরা আজও মাকড়চণ্ডী নামে পূজা করে থাকেন। এখানকার রূপনারায়ণ ও হুগলি নদী ক্রমশ বিস্তৃত হওয়ায় দক্ষিণ থেকে উত্তর দিকে এই পাথরগুলি সরে এসেছে বলে ঐতিহাসিকরা মনে করেন। এই অঞ্চলের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ‘জেমস অ্যাণ্ড মেরি চড়া’র এক রোমাঞ্চকর ইতিহাস। ইতিহাসবিদেরা বলেন যে ১৬৯৪ সালে বালেশ্বর থেকে একটি জাহাজ হুগলি নদীর মুখে আসার সময়ে তাম্বোলি পয়েন্টে চড়ায় ধাক্কা খেয়ে জলে ডুবে যায়। পরবর্তীকালে স্বামী বিবেকানন্দ রচিত পরিব্রাজক গ্রন্থেও দামোদর ও রূপনারায়ণের মুখে অবস্থিত এই চড়ার উল্লেখ দেখা যায়। তাঁর লেখাতেও বিবেকানন্দ বলেছেন ১৮৭৭ সালে ‘কাউন্টি অফ স্টারলিং’ নামে একটি জাহাজ ঠিক এখানেই চড়ায় ধাক্কা খেয়ে ডুবে গিয়েছিল। অনেক গবেষকের মতে, দামোদর আর রূপনারায়ণ নদীর খাত পরিবর্তনের কারণেই এই চড়ার উৎপত্তি হয়েছিল বর্তমানে যার পূর্ব দিক দিয়ে জলস্রোত প্রবাহিত হলেও, আগে পশ্চিম দিক দিয়ে জলস্রোত বয়ে যেত। আর এই দ্বিমুখী স্রোতের কারণে ঘূর্ণি সৃষ্টি হত জলের মধ্যে। এই অঞ্চলের নিজস্ব ইতিহাসের অন্যতম উপাদান হল ফোর্ট মর্নিংটন পয়েন্ট। এখন যেখানে নদীর পাড়ে রূপনারায়ণ ট্যুরিস্ট লজ, সেখানে বহু আগে ছিল বিশালাক্ষী রাইস মিল। রূপনারায়ণ ট্যুরিস্ট লজের সামনেই নদীর পাড়ে কিছুটা দূরে রয়েছে এই মর্নিংটন দূর্গ। তাছাড়া ট্যুরিস্ট লজের মধ্যেই প্রবেশপথের ডানদিকের বাড়িটি ‘হেরিটেজ বিল্ডিং’ নামে পরিচিত। ঐতিহাসিকরা মনে করেন যে লর্ড ক্লাইভ এই দূর্গ নির্মাণ করেছিলেন। মোটামুটিভাবে মনে করা হয় ১৭৬৫-৬৭ সালের মধ্যেই এই দূর্গটি নির্মিত হয়েছিল। স্থানীয় মানুষেরা বিশ্বাস করেন যে ক্লাইভের অনেক আগে থেকেই এখানে একটি বিশ্রামাগার ছিল যেখানে মূলত বেতড় বন্দর থেকে তাম্রলিপ্তগামী জাহাজগুলি নোঙর করত এবং এখানে জাহাজের লোকজন বিশ্রাম নিত। ব্রিটিশদের শাসনকালে এই বিশ্রামাগারই সংস্কার করে দূর্গ নির্মিত হয়। তবে এই দূর্গের নাম কেন মর্নিংটন রাখা হয়েছিল সে ব্যাপারে আজও কোনো স্পষ্ট ইতিহাস জানা যায়নি। ১৯৪২ সালে বাংলায় যে ভয়াবহ বন্যা হয়েছিল তার প্রকোপে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল এই দূর্গটি, পরে দূর্গের অনেকটাই জলের তলায় তলিয়ে যায়। আজও জলের মধ্যে মাথা তুলে জেগে আছে প্রাচীন দূর্গের ভগ্নাবশেষ, ইঁট আর সুরকি বিছানো পথ যা কিনা একমাত্র ভাটার সময়েই দৃশ্যমান হয়। তবে একটি লাইটহাউস ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আজও অক্ষত রয়ে গিয়েছে।

গাদিয়াড়ার নিসর্গ সৌন্দর্যের অন্যতম প্রধান উপাদান তিন নদীর মিলনস্থল আর তার পাড়ের নিবিড় গাছের সারির ছায়াঘেরা প্রশান্তি। সেই সব গাছের নীচে আলাদা করে ভ্রমণার্থীদের জন্য বসার জায়গাও করা হয়েছে। বাঁশ নির্মিত সুদৃশ্য সেই বেঞ্চে বসে এক দৃষ্টে প্রশস্ত শান্ত অথচ অতল জলের আহ্বান শুনতে পাবেন আপনি। নিশ্চুপ গাছেরা কানে কানে বলে যাবে ইতিহাসের কত গল্প। নদীর বুক চিরে আপনার দৃষ্টি চলে যেতে চাইবে আরও দূরে, নদী পেরোলেই প্রথমে পড়বে পূর্ব মেদিনীপুরের মহিষাদল। নদীর জলে স্পষ্ট দেখা যায় তিনটি ভিন্ন রঙের স্রোত। নাগরিক ক্লান্তি ভুলতে আশ্চর্য সুন্দর এই ছোট্ট জায়গাটি আপনাকে স্বর্গীয় শান্তি এনে দেবে নিশ্চিত।
ট্রেনে করে গাদিয়াড়া আসতে গেলে হাওড়া বা খড়গপুর থেকে প্রথমে বাগনান স্টেশনে নেমে স্টেশন থেকে কিছুটা হেঁটে গিয়ে বাগনান বাস স্ট্যাণ্ড থেকে বাস ধরে সোজা চলে আসা যায় গাদিয়াড়ায়। বাগনান থেকে বাসে করে এক ঘন্টা মত সময় লাগে গাদিয়াড়া পৌঁছাতে। বাগনানের বদলে উলুবেড়িয়া স্টেশনেও নামা যায়। বাগনান থেকে যেখানে ৩৩ কিলোমিটার রাস্তা, সেখানে উলুবেড়িয়া থেকে ৩৬ কিলোমিটার রাস্তা পেরোতে হবে। তবে এখানে বলে রাখা ভালো বাসে আসার সময় বেশ খানিকটা অংশ খুবই খারাপ রাস্তা পড়বে, তারপর থেকে রাস্তা অতীব সুন্দর। এছাড়া কলকাতার ধর্মতলা থেকেই সরাসরি বাস ধরে দুই-আড়াই ঘন্টা সময়ের মধ্যে গাদিয়াড়া চলে আসা যায়। আর নিজের গাড়ি থাকলে তো কথাই নেই। সরাসরি গাদিয়াড়ায় আসা যায় গাড়িতেই, কিন্তু এখানে গাড়ি পার্কিং করার খরচ তুলনায় অনেক বেশি। এছাড়াও দক্ষিণ ২৪ পরগণার নূরপুর কিংবা পূর্ব মেদিনীপুরের গেঁওখালি থেকে লঞ্চে করেও গাদিয়াড়া পৌঁছানো যায়।
থাকার জন্য এখানে হোটেলের অভাব নেই। ছোট-বড় অজস্র হোটেল রয়েছে এখানে। নদীর কাছাকাছি হোটেলে থাকলে হোটেল থেকেও নদীর সৌন্দর্য, শান্ত স্নিগ্ধ মিষ্টি বাতাস উপভোগ করা যায়। তবে এখানে মূলত পিকনিক করতে পর্যটকেরা আসেন তাই থাকার বিশেষ প্রয়োজন পড়ে না।

গাদিয়াড়ার বিশেষ দ্রষ্টব্যের মধ্যে রয়েছে একমাত্র তিন নদীর মিলনস্থল। পরিবহন দপ্তরের উদ্যোগে এখানে একটি ভেসেল চালু হয়েছে যাতে করে নদীপথে ঘুরে বেড়ানো যায়। লঞ্চ পরিষেবা সাধারণত এখানে চল্লিশ মিনিট অন্তর করা হলেও, পর্যটনের মরশুমে তা কমিয়ে ২৫ মিনিট অন্তর করা হয়। ভেসেলে করে নদীপথে ভ্রমণের আনন্দ নিতে ভুলবেন না যেন। নদীতে ভাটা থাকলে প্রাচীন মর্নিংটন দূর্গের ভগ্নাবশেষ চোখে পড়লে আপনি নিজেকে সৌভাগ্যবান বলে মনে করতেই পারেন। নদীপথে ভ্রমণের সময় সূর্যাস্ত উপভোগ করার মজাই আলাদা। শান্ত নদীর পাড়ে বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে ছোটখাটো পিকনিকও করে নেওয়া যায়। তবে মাথায় রাখতে হবে এখানকার জলে কিন্তু প্রবল শক্তিশালী স্রোত থাকে, তাই ভুলেও জলে নামার চেষ্টা করা উচিত নয়। নদীর পাড়ে ইঁট বাঁধানো বসার জায়গা আছে, নদীর দিকে পিছন দিয়ে সেখানে বসতে গেলে সাবধানতা অবলম্বন করা জরুরি। কারণ সেখান থেকে খাড়া ঢাল নেমে এসেছে সোজা নদীর পাড়ে। পাড় বাঁধানো নেই। ফলে অসাবধানতাবশত গড়িয়ে পড়লে জলে ডুবেও যেতে পারেন। তার থেকে নদীর দিকে মুখ করে বসুন, নদীকে দেখুন, উপভোগ করুন। বাইকে বা স্কুটিতে এলে নদীর পাড়ের রাস্তার উপর গাড়ি রেখে গাড়িতে বসে থাকা অনুচিত। গাড়ি নির্দিষ্ট জায়গায় পার্ক করে রেখে আসা দরকার। ঐ রাস্তাতে বড় গাড়িও চলাচল করে, তাই কোনভাবেই রাস্তা আটকে বাইক বা স্কুটি রাখা উচিত নয়। লঞ্চে করে নদী ভ্রমণের সময় নদীতে কোন প্লাস্টিকের বোতল, বা বর্জ্য কিছু ফেলা উচিত নয়। আশেপাশে সাইটসিইং-এরও কিছু কিছু জায়গা আছে। তার মধ্যে চাইলে নদী পেরিয়ে ওপাড়ে পূর্ব মেদিনীপুরের মহিষাদল রাজবাড়ি দেখে আসা যায়। লঞ্চে করে ঘুরে আসা যায় গেঁওখালি কিংবা বর্গভীমার মন্দিরও। গাদিয়াড়া থেকে হলদিয়া বন্দর বা দীঘাও চলে যাওয়া যায়। সবশেষে বলা যায়, বাসে করে বা নিজের গাড়িতে গাদিয়াড়া থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরের গড়চুমুকের ডিয়ার পার্ক ঘুরে আসতেই পারেন। এই গড়চুমুক আবার ৫৮ গেট নামেও পরিচিত।
নদীর পাড়েই প্রচুর ডাব বিক্রি হয় সাইকেলে, ভ্যানে বিভিন্ন ভাবে। ডাবের স্বাদ অতুলনীয়। তাই গাছের ছায়ায় বসে বসে দু-একটাডাব খেয়ে দেখতেই পারেন। অনেকসময় লোক বুঝে দাম বেশি চেয়ে বসে, তাই কেনার সময় দরদাম করে নেওয়া দরকার।
বছরের যেকোন সময়ই গাদিয়াড়া আসা যায়। তবে বর্ষাকালটা এড়িয়ে চলাই ভালো। কারণ বর্ষায় এখানে জলস্তর যেমন অত্যধিক বেড়ে যায়, তেমনি স্রোতও বাড়ে। দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা থেকে যায়। তাছাড়া বৃষ্টিতে ঘোরার মজাও মাটি হয়ে যেতে পারে। শীতকাল এবং গরমকাল আদর্শ সময় গাদিয়াড়া ভ্রমণের জন্য।
ট্রিপ টিপস
- কীভাবে যাবেন – ট্রেনে করে বাগনান বা উলুবেড়িয়া স্টেশনে নেমে বাস ধরে গাদিয়াড়ায় আসা যায়। কলকাতার ধর্মতলা থেকেও সরাসরি বাসে করে আসা যায় এখানে। নিজের গাড়িতেও আসার সুবিধে আছে।
- কোথায় থাকবেন – ছোট-বড় অনেক হোটেল আছে এখানে। তবে নদীর পাড়েই ‘রূপমঞ্জরী ট্যুরিজম প্রপার্টি লজ’ থাকার জন্য আদর্শ জায়গা।
- কী দেখবেন – গাদিয়াড়ার তিন নদীর মিলনস্থল এখানকার বিশেষ দ্রষ্টব্য। প্রশস্ত শান্ত অথচ গভীর নদীর সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেন ভেসেলে চেপে নদীপথে ভ্রমণ করে। তাছাড়া আশেপাশে সাইটসিইং-এর মধ্যে দেখে আসা যায় নদী পেরিয়ে মহিষাদল রাজবাড়ি, গড়চুমুক কিংবা বর্গভীমা মন্দিরও।
- কখন যাবেন – বর্ষাকালটা বাদ দিয়ে অন্য যেকোন সময়েই আসতে পারেন গাদিয়াড়ায়।
- সতর্কতা –
- পিকনিকে ছোট বাচ্চা সঙ্গে থাকলে অবশ্যই সাবধানতা অবলম্বন করুন যাতে নদীর ধারে সে না চলে আসে।
- নদীর পাড়ে ইঁট বাঁধানো জায়গায় পিছন ঘুরে বসার ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত।
- নদীপাড়ে বাইক বা স্কুটি রাস্তার উপর রেখে সেখানে বসে থাকা ঠিক নয়, গাড়ি চলাচলের রাস্তা না আটকে বসা উচিত।
- জলে নামার চেষ্টা করা ঠিক নয়। এখানে স্রোত প্রবল।
- পর্যটনের মরশুমে আসতে চাইলে আগে থেকে হোটেল বুক করে রাখা দরকার।
- ভেসেলে বা লঞ্চে ভ্রমণের সময় নদীতে কোনো বর্জ্য পদার্থ ফেলবেন না।
- বিশেষ পরামর্শ – বন্ধু-বান্ধব নিয়ে এলে এখানে নদীর পাড়ে ছোট-খাটো একটা পিকনিক করে ফেলতেই পারেন। তাছাড়া নদীবক্ষে ভেসেলে চেপে সূর্যাস্ত দেখার স্বাদ উপভোগ করার কথা ভুলে যাবেন না কিন্তু।