গেঁওখালি ভ্রমণ

গেঁওখালি ভ্রমণ

পশ্চিম বাংলার বুকে এমন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ছড়িয়ে আছে, যা সৌন্দর্যপিপাসুদের বারংবার আকর্ষণ করে। পশ্চিমবঙ্গের নানা জেলার গ্রামেগঞ্জে ঘুরলে যে নৈসর্গিক দৃশ্যপটের অভিজ্ঞতা লাভ করা যায়, তা ভ্রমণপিপাসুদের কাছে চিরকাঙ্ক্ষিত বস্তু। পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব মেদিনীপুর জেলার মহিষাদল ব্লকের তেমনই একটি অতি সুন্দর গ্রাম হল গেঁওখালি। দামোদর, রূপনারায়ণের রূপোলি জলরেখা বেষ্টন করে আছে এই সুন্দরী গ্রামটিকে। প্রকৃতিপ্রেমী পর্যটকের জন্য এই গেঁওখালি গ্রাম নিঃসন্দেহে এক উপযুক্ত স্থান হতে পারে ।

কলকাতা থেকে ১৩০ কিলোমিটার দূরে হুগলি, রূপনারায়ণ এবং দামোদর নদীর সঙ্গমস্থলে এই গেঁওখালি গ্রামটি অবস্থিত। তিনটি নদীর সঙ্গমস্থল এই গেঁওখালিতে নদীটি সমুদ্রের মতো প্রশস্ত। একটি জল শোধনাগার গড়ে ওঠার কারণে এই গেঁওখালির উন্নতি হয়েছে এখানে । এখান থেকে হলদিয়ায় বিশুদ্ধ জল সরবরাহ করা হয়ে থাকে।

গেওখালির রূপ

বাংলার তিনটি গুরুত্বপূর্ণ নদী দ্বারা বেষ্টিত এই গ্রাম খুব বেশি জনবহুল নয়। ফলে শহরের কোলাহল থেকে দূূরে জনবিরল নির্জনতা খুঁজে পেতে চাইলে গেঁওখালির নাম উঠে আসবেই। এখানে নদী যেহেতু সমুদ্রের মতোই প্রশস্ত, সেকারণে জাহাজ চলাচলও এখানকার নদীতে দেখা যেতে পারে। সূর্যাস্তের সময় গেঁওখালির রূপ দেখবার মত হয়। সন্ধের মুখে নদীর বুকের ওপর সিঁদুরে রঙ ছড়িয়ে দিয়ে যখন সূয্যিমামা পাটে বসেন, বিচিত্রবর্ণ আকাশ আর নদী মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় তখন। নদী তীরবর্তী নির্জন পথের ওপর সেই সূর্যাস্তের দিকে মুখ করে দাঁড়ালে জীবনের ক্লান্তি, ক্লেদ, গ্লানি সব যেন তুচ্ছ হয়ে যায়। গোধুলির সেই রাঙা আলোয় বিমোহিত হতে হয়। নদীর তরঙ্গধ্বনি, পাখিদের ঘরে ফেরার ডাক, সূর্যাস্তের উজাড় করা রঙ, সবকিছু মিলে এক নৈসর্গিক আবহের জন্ম হয় যেন। এছাড়াও বাবলা, শিরিশ, আকাশমনি, আম গাছের সবুজ প্রান্তরে ঘেরা স্নিগ্ধ শ্যামল নদীপথ ধরে হেঁটে গেলে মন উদাস হয়ে পড়ে। প্রকৃতির সবুজ মায়ায় হৃদয়জোড়া মুগ্ধতা থাকে শুধু। 

কলকাতা থেকে গেঁওখালি বাসে যেতে হলে ধর্মতলা বা এসপ্ল্যানেড থেকে নূরপুরে যাওয়ার বাস ধরা যায়। দূরত্ব প্রায় ৫২ কিলোমিটার। নূরপুর থেকে লঞ্চে করে নদী পেরিয়ে পৌঁছনো যায় গন্তব্যস্থলে। ট্রেনে যেতে হলে হাওড়া স্টেশন থেকে মেদিনীপুর, পাঁশকুড়া বা খড়গপুর যে-কোনো লোকাল ধরে বাগনান স্টেশন এবং সেখান থেকে অটোরিক্সা ধরে গাদিয়াড়া চলে যাওয়া যাবে। সেখান থেকে তারপর নদী পারাপারের জন্য নৌকো। তাছাড়াও এই গেঁওখালির নিকটতম রেলস্টেশনটি হল হাওড়া-হলদিয়া রুটের সতীশ সামন্ত হল্ট স্টেশনটি। সেখানে নেমে টোটো ধরেও চলে যাওয়া যাবে। তবে কেউ যদি ব্যক্তিগত গাড়িতে যেতে চান তাহলে কোলাঘাট হয়ে হলদিয়ার দিকে এনএইচ ৪৭ (NH 47) ধরে নিতে হবে।

গেঁওখালি মূলত নদী তীরবর্তী একটি গ্রাম, ফলত তিন নদীর সঙ্গমস্থলই এই জায়গাটির মূল আকর্ষণবিন্দু। নদীর ধারে অনেক জরাজীর্ণ লঞ্চও দেখতে পাওয়া যাবে। নদী তীরবর্তী লাল মোরামের পথ ধরে নদীর হাওয়া মেখে হাঁটতে থাকার অভিজ্ঞতা স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এখানকার অধিকাংশ মানুষেরই পেশা মাছ ধরা, ফলে জাল ফেলে মাছ ধরার দৃশ্যও এখানে বিরল নয়। তবে নদী ছাড়াও মহিষাদল প্রাসাদ বা রাজবাড়ি এবং নিকটবর্তী কোলাঘাট দর্শন করা যেতে পারে। এছাড়াও মহিষাদলের রাধাকৃষ্ণ মন্দিরটিও একটি দ্রষ্টব্য স্থান। এমনকি নদীর ওপারে অবস্থিত গাদিয়াড়াতেও ঘুরে আসা যায়। চলে যাওয়া যায় হলদিয়া ডকের দিকেও।

যেহেতু পর্যটকদের আনাগোনা এখানে লেগেই থাকে, সেকারণেই গেঁওখালিতে থাকা এবং খাওয়ার জন্য বেশকিছু হোটেল পাওয়া যাবে। মৎসপ্রেমীরা এখানে মাছের নানারকম পদ উপভোগ করবার সুযোগ পাবেন।

মূলত শীতকালে গেঁওখালিতে ঘুরতে গেলে চমৎকার সৌন্দর্য উপভোগ করা যেতে পারে। শীতের সকালে কুয়াশামাখা নদীতীর এবং সবুজঘেরা পিচঢালা পথ এক নৈসর্গিক দৃশ্যের জন্ম দেয়। এসময় প্রচুর মানুষ পিকনিক করবার জন্যও এদিকে বেড়াতে আসেন। আসলে বছরের যে-কোনো সময়তেই গেঁওখালি এসে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দুচোখ ভরে উপভোগ করা যেতে পারে। তবে ভীড় এড়াতে চাইলে একটু অফ-সিজন বেছে নেওয়াই ভালো।


ট্রিপ টিপস

  • কীভাবে যাবেন – ধর্মতলা থেকে বাসে নূরপুর তারপর সেখান থেকে লঞ্চে নদী পেরিয়ে যাওয়া যায়। তাছাড়া খড়গপুর বা মেদিনীপুর লোকালে বাগনান স্টেশনে নেমে গাদিয়াড়া গিয়ে সেখান থেকে নৌকোয় নদী পেরিয়ে যাওয়া যায়। ব্যক্তিগত গাড়িতে গেলে কোলাঘাট হয়ে হলদিয়ার দিকে এনএইচ ৪৭ (NH 47) ধরতে হবে।
  • কোথায় থাকবেন – গেঁওখালিতে থাকার জন্য সেখানে বেশ কিছু হোটেল রয়েছে।
  • কী দেখবেন – গেঁওখালিতে মূলত তিনটি নদীর সঙ্গমস্থলই প্রধান আকর্ষণের বিষয়। কিন্তু নদী ছাড়াও মহিষাদল রাজবাড়ি, মহিষাদলের রাধাকৃষ্ণ মন্দির, নদীর ওপারে গাদিয়াড়া, নূরপুর, আরেকটু দূরে হলদিয়া ডক ইত্যাদি স্থানেও ভ্রমণ করা যেতে পারে।
  • কখন যাবেন – বছরের যে-কোনো সময়তেই গেঁওখালিতে যাওয়া যায়। তবে অনেকে শীতকালের আনন্দ উপভোগের এবং পিকনিকের জন্যও বেছে নেয় নদী তীরবর্তী এই সুন্দর গ্রামটিকে।
  • সতর্কতা
    • যেহেতু গেঁওখালিতে জল পরিশোধনাগার গড়ে উঠেছে, তাই সেখানে ইতস্তত অনেক জলের ট্যাঙ্ক লক্ষ্য করা যাবে। সূর্যাস্তের পর একা একা সেইসব ট্যাঙ্কের কাছাকাছি ঘোরাঘুরি না-করাই ভালো।
  • বিশেষ পরামর্শ
    • নদী তীরবর্তী এই গেঁওখালিতে বেড়াতে গেলে অবশ্যই ভোরবেলা নদীর ধার বরাবর রাস্তা ধরে প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়ে পড়া উচিত। যদি শীতকাল হয়, তবে তো কথাই নেই। কুয়াশাবৃত ভোরবেলা একরাশ সবুজ এবং নদীর স্নিগ্ধ হাওয়ার মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাওয়ার অভিজ্ঞতা অসাধারণ।

সর্বশেষ সম্পাদনার সময়কাল – ২০২৩

আপনার মতামত জানান