বাংলার একটি অন্যতম ঐতিহ্যবাহী রথযাত্রা হল মেদিনীপুরের মহিষাদলের রথযাত্রা উৎসব। মহিষাদলের রথযাত্রার ইতিহাস দুই শতাব্দীরও বেশি প্রাচীন।মহিষাদল রাজ পরিবারের কুমার দেবপ্রসাদ গর্গ ১৩৭৬ বঙ্গাব্দে ‘ল্যাকেটু’ পত্রিকায় রথ নিয়ে দীর্ঘ একটি প্রতিবেদন লেখেন। সেখানে তিনি জানান রানী জানকী ১৭৬৬ সালে এই রথ নির্মান করেন। দেওয়ান আনন্দ ঘোষের ডায়রি উল্লেখ করে তিনি রথের যে বিবরণ দিয়েছেন তা থেকে জানা যায় তখন চারতলা রথটির ছিল ১৭টি চূড়া এবং ৩৪টি লোহার চাকা। তাঁর তথ্য সত্যি ধরলে রানী জানকীই রথযাত্রা উৎসবের সূচনা করেছিলেন। এটি তৈরির খরচ দেখিয়েছেন ৬০০০০ সিক্কা।
আবার অন্য একটি সূত্র মতে, রানী জানকী নন, মতিলাল পাঁড়ে (উপাধ্যায়) এই রথযাত্রা উৎসবের সূচনা করেছিলেন। অপুত্রক অবস্থায় রাজা আনন্দলাল ও পরে রানী জানকী মারা গেলে নিজেকে তাঁদের পোষ্যপুত্র হিসেবে দাবি করে মতিলাল সিংহাসনে বসেন। কিন্তু রাজপরিবার তাঁর এই দাবি মানে না। এই নিয়ে মামলা মোকদ্দমাও হয়। মতিলাল বর্তমান গুন্ডিচাবাটির কাছে আলাদা অট্টালিকা নির্মাণ করে বসবাস করতে শুরু করেন। তিনি ১৮০৪ সালে ১৭ চূড়া বিশিষ্ট রথটি নির্মাণ করেন। মহিষাদলের রাজ পরিবারের ইতিহাস নিয়ে প্রথম কোনে প্রামান্য গ্রন্থ হল ভগবতীচরণ প্রধানের লেখা ‘মহিষাদল রাজবংশ’। এই বইতে তিনি স্পষ্টভাবে বলেছেন, “মতিলাল রাজকার্যে প্রবৃত্ত হইয়া সর্বপ্রথম গোপালের নিমিত্ত সপ্তদশ চূড়ক সমন্বিত বৃহৎ দারুময় রথ নির্মাণ করেন। জগন্নাথদেবের রথযাত্রার অনুকরণে প্রতি বর্ষের আষাড়ীয় শুক্লা দ্বিতীয়াতে ঐ রথোৎসব গুঞ্চাবাটী নামক প্রাসাদে সপ্তাহকাল ব্যাপিয়া সম্পন্ন হইয়া থাকে। প্রজাগণ এই উৎসবের সমস্ত ব্যায়ভার বহন করিতে স্বীকৃত হয়।” উল্লেখ্য বইটি তিনি রাজা জ্যোতিঃপ্রসাদ গর্গকে উৎসর্গ করেছেন। সবচেয়ে লক্ষণীয়, এই বইয়ের ‘বিজ্ঞাপন’ শিরোনামের লেখাটি লেখক এই বলে শেষ করেছেন, “এই পুস্তক মুদ্রাঙ্কনকালে মহিষাদল স্টেটের মহামান্য ম্যানেজার শ্রীযুক্ত বাবু নীলমণি মণ্ডল মহাশয় ইহার আদ্যোপান্ত পাঠ শ্রবণ করিয়া মুদ্রাঙ্কণন অনুমতি দান না করিলে মুদ্রিত ও পাঠকবর্গের নেত্রপথে উপস্থিত হইত না। এজন্য তাঁহার নিকট চিরকৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ রহিলাম।”
মহিষাদলের প্রথম রথটির বেশ কয়েকবার সংস্কার হয়েছে।১৮৬০ সালে রাজা লছমনপ্রসাদের বন্ধু মঁসিয়ে পেরু রথ সংস্কারের জন্য যে প্রস্তাব দেন সেই প্রস্তাব মেনে রথের ১৭টি চূড়া কমিয়ে ১৩টি চূড়া করা হয়। প্রত্যেক তলার চারপাশে ঘুর বারান্দা করা হয় এবং চার কোণে চারজন ঋষির মূর্তি বসানো হয়। ১৯১২ সালে রাজা সতীপ্রসাদ গর্গ রথের সামনে দুটি শ্বেতহস্তী যোগ করেন। সেই রথ আজও চলছে। পাঁচতলা কাঠের তৈরি এই রথটি সম্ভবত বিশ্বের উচ্চতম কাঠের তৈরি রথ। এই রথের চাকার সংখ্যা ৩৬টি।
আগে এই রথযাত্রা রাজ পরিবারের তরফে পরিচালনা করা হত, বর্তমানে মহিষাদল পঞ্চায়েত সমিতি ও রাজ পরিবারের যৌথ উদ্যোগে এই উৎসব হয়ে থাকে। রথের আগের দিন রথের সামনে হয় বিশেষ মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান যা ‘লেদ উৎসব’ বা ‘নেত্র উৎসব’ নামে পরিচিত।‘লেদ উৎসব’ হল রাজ পরিবারের সদস্যদের দ্বারা রথের রশি বাঁধন প্রক্রিয়া। আগে রাজ পরিবারের কোনো সদস্য রথের সামনে হাতির ওপর বসে রথ সঞ্চালনা করে নিয়ে যেতেন। এখন অবশ্য আর তা হয় না। এখন রথযাত্রার আগে রাজপরিবারের সদস্য হরিপ্রসাদ গর্গ পাল্কিতে চেপে এসে রথে রশি বেঁধে (লেদ উৎসব) রথযাত্রার শুভারম্ভ করেন। রথযাত্রার এই শুভারম্ভে আকাশ বাতাস মাতিয়ে দেয় বন্দুক থেকে বেরনো গুলির শব্দ। মহিষাদলের রথযাত্রার অন্যতম বৈশিষ্ট্য এই তোপধ্বনি যা সমগ্র রথযাত্রা ধরেই চলতে থাকে। রথ টেনে নিয়ে যাওয়ার চারটি রশির একটি সংরক্ষিত থাকে মহিলাদের জন্য। মহিষাদলের রথে জগন্নাথদেবের পাশাপাশি মদনগোপালজিউর মূর্তি থাকে।
আগের তুলনায় মহিষাদলের রথ তার জৌলুস অনেকটাই হারিয়েছে ঠিকই তবুও এই উৎসব নিয়ে মানুষের আবেগ, উন্মাদনা আজও বিদ্যমান।