বিশ্বে প্রচলিত বিবিধ রকমের খেলার মধ্যে উল্লেখযোগ্য এবং খুবই জনপ্রিয় একটি আউটডোর খেলা হল গল্ফ খেলা (Golf)। সর্বনিম্ন দুই থেকে চারজনের মধ্যে এই গল্ফ খেলা হয়ে থাকে। গল্ফ খেলোয়াড়কে একটি ধাতব দন্ড বা গল্ফ ক্লাবের সাহায্যে একটি গল্ফ বলকে গর্তের মধ্যে ফেলতে হয়। সবচেয়ে কম সংখ্যক স্ট্রোকের সাহায্যে বলটিকে গর্তে ফেলার চেষ্টা করেন খেলোয়াড়রা। গল্ফ কোর্স বা গল্ফ খেলার মাঠে নয়টি বা আঠারোটি এমন গর্ত থাকে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই খেলাটি জনপ্রিয় হলেও আয়ারল্যান্ডে এর জনপ্রিয়তা সবচেয়ে বেশি। এছাড়াও কানাডা, ইংল্যান্ড, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, দক্ষিণ আফ্রিকা, জাপান গল্ফ খেলার জন্য সমগ্র বিশ্বে বিশেষভাবে পরিচিত।
আধুনিক গল্ফ খেলাটির উদ্ভব হয় পনেরো শতকে স্কটল্যান্ডে। তবে এর আরও প্রাচীন উৎস নিয়ে নানা মতামত ও বিতর্ক রয়েছে। কোন কোন ঐতিহাসিক এই খেলার উৎস হিসেবে রোমান প্যাগানিকা খেলার কথা বলে থাকেন, যেখানে প্রতিযোগীরা একটি চামড়ার বলকে বাঁকানো একটি লাঠির সাহায্যে আঘাত করত। অনেকে আবার চীনের প্রাচীন খেলা চুইওয়ানের (‘চুই’-এর অর্থ সজোরে আঘাত করা এবং ‘ওয়ান’ মানে ছোট বল) থেকে গল্ফের উৎপত্তি হয়েছে বলে মনে করেন। মধ্যযুগে খেলাটি ইউরোপে চালু হয়েছিল বলে মনে করা হয়। আধুনিক গল্ফের মত একটি খেলা ইংল্যান্ডে ক্যাম্বুকা এবং ফ্রান্সে চ্যাম্বট নামে পরিচিত ছিল। ইংরেজ পর্যটক উইলিয়াম ওসেলির মতে, পার্সিয়ান খেলা চৌগান গল্ফের আরেকটি সম্ভাব্য প্রাচীন উৎস হতে পারে।
গল্ফ খেলা প্রচলিত থাকার সর্বপ্রথম লিখিত নথি পাওয়া যায় স্কটল্যান্ডে। ১৪৫৭ সালের সেই নথিতে তীরন্দাজি শেখার জন্য গল্ফ খেলাকে নিষিদ্ধ করার উল্লেখ পাওয়া যায়। ১৫০২ সালে চতুর্থ জেমস সেই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন অবশ্য। ১৭৬৪ সালে স্কটল্যান্ডের সেন্ট অ্যান্ড্রুজে ১৮টি গর্তসম্পন্ন স্ট্যান্ডার্ড গল্ফ কোর্স তৈরি করা হয়েছিল। গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস দ্বারা বিশ্বের প্রাচীনতম গল্ফ কোর্স হিসাবে নথিভুক্ত করা হয়েছে স্কটল্যান্ডের মুসেলবার্গ লিঙ্কসকে। বর্তমানে প্রচলিত বিশ্বের প্রাচীনতম গল্ফ টুর্নামেন্ট দ্য ওপেন চ্যাম্পিয়নশিপ প্রথম ১৮৬০ সালের ১৭ অক্টোবর স্কটল্যান্ডের আইরশায়ারে প্রেস্টউইক গল্ফ ক্লাবে খেলা হয়। ১৮৮৮ সালে জন রিড এবং রবার্ট লকহার্ট নামের দুইজন স্কটিশ ব্যক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম গল্ফ প্রদর্শন করেন। ঐ একই বছরে রিড সেন্ট অ্যান্ড্রু’স গল্ফ ক্লাব নামে নিউইয়র্কের ইয়ঙ্কার্সে আমেরিকার প্রথম গল্ফ ক্লাব স্থাপন করেন ।
গল্ফ খেলার নিয়মগুলি যৌথভাবে দ্য রয়্যাল অ্যান্ড এনসিয়েন্ট গল্ফ ক্লাব অফ সেন্ট অ্যান্ড্রুজ (দ্য আর এন্ড এ) এবং ইউনাইটেড স্টেটস গল্ফ অ্যাসোসিয়েশন (ইউএসজিএ) দ্বারা পরিচালিত হয়। গল্ফ খেলায় প্রথাগত লিখিত নিয়ম ছাড়াও, গল্ফাররা ‘গল্ফ এটিকেট’ নামক কিছু নির্দেশাবলী মেনে চলে। শিষ্টাচার সংক্রান্ত এই নির্দেশাবলী না মানার জন্য কোন জরিমানা না থাকলেও খেলোয়াড়রা সাধারণত নিজেদের খেলার মান বাড়ানোর স্বার্থে গল্ফ শিষ্টাচারের এই নিয়মগুলি অনুসরণ করে।
গল্ফে খেলার মাঠকে গল্ফ কোর্স বলা হয়। প্রতিটি গল্ফ কোর্স আঠারোটি গর্ত নিয়ে গঠিত যার মধ্যে প্রথম নয়টিকে বলা হয় ফ্রন্ট নাইন এবং বাকিগুলিকে বলে ব্যাক নাইন। আঠারোটি গর্ত ছাড়াও শুধুমাত্র নয়টি গর্তের নির্দিষ্ট গল্ফ কোর্সও রয়েছে। নয়টি গর্তের রাউন্ডের জন্য সাধারণত দুই ঘন্টা এবং আঠারোটি গর্তের রাউন্ডের জন্য চারঘন্টা সময় নির্ধারিত থাকে। খেলার শুরুতে খেলোয়াড়রা ‘টি’ (Tee) নামক স্টার্টিং ব্লকে দাঁড়িয়ে ক্লাব বা গল্ফ খেলার দন্ড দিয়ে গর্তের দিকে তাক করে গল্ফ বলটিকে আঘাত করে। গল্ফের জন্য বিশেষ বৈশিষ্ট্যসমন্বিত বিভিন্ন ক্লাব বা দন্ড রয়েছে। বিভিন্ন ধরণের শট মারার জন্য সেই বিভিন্ন ধরণের গল্ফ ক্লাব ব্যবহার করে থাকেন গল্ফাররা। আয়রনস, উডস, ড্রাইভার, ওয়েজ, চিপার এবং পাটার হল বিভিন্ন ধরণের গল্ফ ক্লাবের ধরণ। একজন গল্ফার যেকোনো রাউন্ডের শুরুতে তাঁর ব্যাগে থাকা ক্লাবগুলির মধ্যে থেকে যেকোন একরকম ক্লাব বাছাই করতে পারেন। একটি রাউন্ড শেষ না হওয়া অবধি তিনি এই ক্লাব পরিবর্তন করতে পারেননা।
গল্ফ খেলোয়াড়দের সর্বদা নিজেদের বলের ট্র্যাক নিজেকে রাখতে হয় কারণ নিজের বলের পরিবর্তে অন্য কোনো বলকে আঘাত করলে শাস্তি হিসেবে পেনাল্টি হতে পারে। খেলোয়াড়দের শুরুর স্ট্রোকের জন্য একটি ছোট্ট স্ট্যান্ড ব্যবহার করার অনুমতি দেওয়া হয় যার ওপরে বলটিকে রেখে বলকে উঁচু করে মারা যায়। এই স্ট্যান্ডটিকেও ‘টি’ বলা হয়। গল্ফ খেলায় প্রথম স্ট্রোকের পর বল যেখানে গিয়ে পড়বে সেখানে গিয়েই প্রতিযোগীকে পুনরায় মারতে হয় বলটিকে। অত্যন্ত জোরালো শট মারার ফলে বল যদি সীমানার বাইরে বেরিয়ে যায় বা হারিয়ে যায় তাহলে ওই খেলোয়াড়ের জরিমানা হতে পারে। খেলা অফিসিয়ালি একবার শুরু হয়ে গেলে আর কোনোরকম অনুশীলনমূলক শট মারা যায় না। মিস করা শট পুনরায় তখন আর চেষ্টা করা যাবে না।
কমপক্ষে কুড়িটি পেশাদার গল্ফ ট্যুর রয়েছে এই খেলায়। গল্ফের সবচেয়ে জনপ্রিয় টুর্নামেন্টগুলির মধ্যে অন্যতম একটি হল পিজিএ ট্যুর। বর্তমানে পিজিএ ট্যুরের পুরস্কার তালিকার শীর্ষে থাকার সম্মান কিংবদন্তি গল্ফার টাইগার উডসের নামে রয়েছে। এছাড়াও আরেকটি জনপ্রিয় গল্ফ ট্যুর হল ইউরোপীয়ান ট্যুর। বিশ্বব্যাপী প্রতিপত্তিতে এর স্থান পিজিএ ট্যুরের ঠিক পরেই।
পুরুষদের অন্যান্য গল্ফ ট্যুরগুলির মধ্যে রয়েছে জাপান গল্ফ ট্যুর, এশিয়ান ট্যুর, অস্ট্রেলিয়ান পিজিএ ট্যুর এবং সানশাইন ট্যুর (প্রাথমিকভাবে দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত)। পঞ্চাশ বা তার বেশি বয়সী পুরুষদের জন্য বেশ কয়েকটি সিনিয়র ট্যুর রয়েছে। সবচেয়ে বেশি পরিচিত যার মধ্যে আমেরিকা-ভিত্তিক পিজিএ ট্যুর চ্যাম্পিয়নস। আবার মহিলা গল্ফারদের জন্য ছয়টি প্রধান ট্যুর রয়েছে যার প্রতিটি ভিন্ন দেশ বা মহাদেশে খেলা হয়ে থাকে। এর মধ্যে সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ হল আমেরিকা ভিত্তিক এলপিজিএ ট্যুর। পুরুষদের প্রধান চারটি গল্ফ টুর্নামেন্টগুলি হল – দ্য মাস্টার্স, ইউএস ওপেন, দ্য ওপেন চ্যাম্পিয়নশিপ (উত্তর আমেরিকাতে ব্রিটিশ ওপেন হিসাবে উল্লেখ করা হয়) এবং পিজিএ চ্যাম্পিয়নশিপ। দ্য মাস্টার্স একমাত্র বড় চ্যাম্পিয়নশিপ যা প্রতি বছর একই কোর্সে খেলা হয়। ইউএস ওপেন এবং পিজিএ চ্যাম্পিয়নশিপ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আশেপাশের কোর্সে খেলা হয়, অন্যদিকে ওপেন চ্যাম্পিয়নশিপ যুক্তরাজ্যের চারপাশে খেলা হয়। সিনিয়রদের চ্যাম্পিয়নশিপের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল – সিনিয়র পিজিএ চ্যাম্পিয়নশিপ, দ্য ট্র্যাডিশন, সিনিয়র প্লেয়ার্স চ্যাম্পিয়নশিপ, ইউনাইটেড স্টেটস সিনিয়র ওপেন এবং দ্য সিনিয়র (ব্রিটিশ) ওপেন চ্যাম্পিয়নশিপ। মহিলাদের কয়েকটি জনপ্রিয় টুর্নামেন্টের নাম হল – ইউএস উইমেনস ওপেন, উইমেনস ব্রিটিশ ওপেন, ইভিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ, শেভরন চ্যাম্পিয়নশিপ ইত্যাদি।
গল্ফের ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ খেলোয়াড়দের মধ্যে প্রথমেই যাঁর নাম করতে হয় তিনি হলেন গ্যারি প্লেয়ার। ১৫০টিরও বেশি পেশাদার টুর্নামেন্ট জিতেছিলেন তিনি৷ এছাড়াও অবশ্যই করতে হবে টাইগার উডসের নাম। পনেরোটি পেশাদার মেজর গল্ফ চ্যাম্পিয়নশিপ এবং আঠারোটি বিশ্ব গল্ফ চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জিতেছিলেন তিনি৷ মহিলা গল্ফারদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন, লরেনা ওচোয়া।
গল্ফ খেলার দুনিয়ায় বেশ কয়েকজন কৃতী ভারতীয় খেলোয়াড়ও নিজেদের অসাধারণ দক্ষতা প্রদর্শন করে সম্মানের আসন লাভ করেছেন। ভারতীয় গল্ফারদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন: জীব মিলখা সিং, অনির্বান লাহিড়ী, অর্জুন অটওয়াল, জ্যোতি রন্ধাওয়া প্রমুখ। জীব সিং ইউরোপীয়ান ট্যুরে তিনটি, জাপান গল্ফ ট্যুরে চারটি এবং এশিয়ান ট্যুরে ছয়টি শিরোপা জিতেছেন। ভারতের পুরুষ দল গল্ফে ১৯৮২ সালের এশিয়ান গেমসে সোনা, ২০০৬ এশিয়ান গেমস এবং ২০১০ এশিয়ান গেমসে রুপো জিতেছিল। লক্ষ্মণ সিং ১৯৮২ এশিয়ান গেমসে ব্যক্তিগত স্বর্ণপদক জিতেছিলেন। এশিয়ান ট্যুর অর্ডার অফ মেরিট জয় করা প্রথম ভারতীয় হলেন জ্যোতি রন্ধাওয়া। ২০০২ সালে এই খেতাব জিতেছিলেন তিনি।
ভারতের একটি পেশাদার গল্ফ ট্যুরও আছে। ভারতের প্রধান গল্ফ টুর্নামেন্ট হিরো ইন্ডিয়ান ওপেন। ইন্ডিয়ান গল্ফ ইউনিয়ন প্রতিনিয়ত গল্ফের মান উন্নয়নের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সাম্প্রতিককালে ‘ইন্ডিয়ান পিচ অ্যান্ড পুট ইউনিয়ন’ (IPPU) তৈরি হয়েছে। এছাড়াও গড়ে তোলা হয়েছে ‘প্রফেশনাল গল্ফারস অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্ডিয়া’। ভারতে গল্ফ পরিকাঠামোর পাশে থাকার এবং একে সমর্থন করার জন্য IPPU-এর প্রচেষ্টাকে ওয়ার্ল্ড গল্ফ ফাউন্ডেশনও প্রশংসা করেছে। ভারতে বর্তমানে ১৯৬টি গল্ফ কোর্স রয়েছে। বিশ্বের দরবারে ভারতও গল্ফের জগতে নিজের নাম সম্মানের সঙ্গে তুলে ধরতে প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত।