বিদ্যাধর সূর্যপ্রসাদ নাইপল (Vidiadhar Surajprasad Naipaul) একজন ভারতীয়-নেপালীয় বংশোদ্ভূত ত্রিনিদাদীয় নোবেলজয়ী সাহিত্যিক যিনি ব্রিটিশ নাগরিকত্ব লাভ করেছিলেন। পঞ্চাশ বছরে তাঁর ত্রিশটিরও বেশি বই প্রকাশিত হয়েছে। তবে কিছু বই তাঁর যথেষ্ট বিতর্ক সৃষ্টিও হয়েছে।
১৯৩২ সালের ১৭ আগস্ট ত্রিনিদাদ ও টোবাগোর চাগুয়ানাসে এক হিন্দু পরিবারে বিদ্যাধর সূর্যপ্রসাদ নাইপলের জন্ম হয়। তাঁর বাবার নাম সিপ্রসাদ নাইপল ও মায়ের নাম দ্রোয়াপতি কাপিলদেও। তিনি ছিলেন বাবা-মায়ের দ্বিতীয় সন্তান। ১৮৮০-এর দশকে তাঁর ঠাকুরদা ও ঠাকুরমা শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে ভারত থেকে ত্রিনিদাদ ও টোবাগো যান। ত্রিনিদাদে ভারতীয় অভিবাসী সম্প্রদায়ে নাইপলের বাবা ইংরেজি ভাষায় সাংবাদিকতা করতেন। তাঁর বাবা ১৯২৯ সালে ত্রিনিদাদ গার্ডিয়ানে প্রবন্ধ লেখা শুরু করেন। ১৯৩২ সালে নাইপলের জন্মের বছরে তাঁর বাবা চাগুয়ানাসে সংবাদদাতা হিসেবে যোগ দেন। নাইপল ২০০১ সালে নোবেল পুরস্কারের ভাষণে বলেন, বাবার দিক থেকে তিনি নেপালি বংশোদ্ভূত।
১৯৩৯ সালে ছয় বছর বয়সে নাইপলের পরিবার ত্রিনিদাদের রাজধানী পোর্ট অব স্পেনে চলে যায়। শিশু বয়সে বাবার কাছে নাইপল উইলিয়াম শেক্সপীয়ার, চার্লস ডিকেন্স পড়েন। তাঁর বাবার অনুপ্রেরণায় তিনি ইউরোপীয় সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত হন। ত্রিনিদাদে তিনি সরকারী কুইন্স রয়্যাল কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকে পাস করার পর নাইপল ত্রিনিদাদের সরকারী বৃত্তি লাভ করেন যার ফলে তিনি উচ্চ শিক্ষার জন্য ব্রিটিশ কমনওয়েলথের যে কোন প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনার সুযোগ পান। তিনি ১৯৫০ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্য বিষয়ে পড়াশোনার জন্য ভর্তি হন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় হতাশা ও একাকীত্বে ভুগতেন তিনি, এমনকি আত্মহত্যারও চেষ্টা করেছেন। তাঁর জীবন বাঁচিয়েছেন তাঁর বাবা। চিঠির মাধ্যমে ছেলের সাথে যোগাযোগ রাখতেন তিনি। বাবা ও ছেলের এই চিঠিগুলি ১৯৯৯ সালে প্রকাশ করা হয়।
১৯৫৩ সালে তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হন। কিন্তু সেই বছরে তাঁর বাবা মারা যান। ফলে তিনি তীব্র অর্থ কষ্টের সম্মুখীন হন। ১৯৫৪ সালে তিনি লন্ডনে আসেন। ১৯৫৫ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি প্যাট্রেসিয়া অ্যান হেল (Patricia Ann Hale) নামে এক ব্রিটিশ সহপাঠিনীকে বিয়ে করেন। প্যাট্রেসিয়া তাঁর জীবনে আশীর্বাদ হয়ে আসেন। বিয়ের আগে অর্থনৈতিক সঙ্কটে পড়ে প্যাট্রেসিয়ার কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে তাঁর জীবন চলত। ১৯৯৬ সালে প্যাট্রেসিয়ার মৃত্যু হয়। তিনি ছিলেন আদর্শ জীবন সঙ্গিনী। নাইপলের জীবনের নানান কঠিন সময় তিনি সর্বদা তাঁর পাশে থেকে পরিস্থিতির মোকাবিলা করেছেন। তবে নাইপলের জীবনীকার প্যাট্রিক ফ্রেঞ্চ তাঁর ‘দ্য ওয়ার্ল্ড ইজ হোয়াট ইট ইজ’ (The World is What it is) গ্রন্থে লিখেছেন, তাঁদের দাম্পত্য জীবন ছিল অসুখী। তাঁদের কোন সন্তান ছিল না। মার্গারেট মারি গুডিং (Margaret Murray Gooding) নামে এক অ্যাংলো আর্জেন্টাইন নারীর সঙ্গে প্রবল যৌনসম্পর্ক ছিল নাইপলের। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন অসহিষ্ণু, উদ্ধত, বদমেজাজি, দুর্মুখ ও অত্যাচারী। প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর তিনি পাকিস্তানী সাংবাদিক নাদিরা আলভিকে বিয়ে করেন। তিনি নাদিরার কন্যা সন্তানকে দত্তক নেন।
রাজনৈতিক চিন্তাভাবনায় তিনি ছিলেন প্রতিক্রিয়াশীল। ১৯৫২ সালে নাইপল মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। প্রচন্ড অর্থকষ্ট, বই ছাপার ব্যাপারে নতুন অশ্বেতাঙ্গ লেখক নাইপলের প্রতি প্রকাশকদের অনাগ্রহের ফলে তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। এই সময় প্যাট্রেসিয়া তাঁকে সুস্থ করে তোলেন।
তাঁর রচনাগুলো মূলত তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়- উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী এবং আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস। ভি এস নাইপলের লেখা সবথেকে জনপ্রিয় উপন্যাসগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘অ্যা বেন্ড ইন দ্য রিভার’, ‘ইন অ্যা ফ্রি স্টেট’, ‘এন এরিয়া অব ডার্কনেস’, ‘হাফ এ লাইফ’। ‘এ হাউজ ফর মিস্টার বিশ্বাস’ তাঁর সেরা সাহিত্য সৃষ্টি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই উপন্যাসটি লিখতে তাঁর তিন বছর সময় লেগেছিল।
নাইপল ১৯৫৪ সালে বিবিসি-তে সপ্তাহে একদিন ‘ক্যারিবিয়ান ভয়েস’ অনুষ্ঠানটি উপস্থাপন করতেন। বিবিসির ফ্রিল্যান্সার সাংবাদিকদের কক্ষে বসে তিনি তাঁর প্রথম গল্প ‘বোগার্ট’ রচনা করেন যা পরবর্তী সময়ে ‘মিগুয়েল স্ট্রিট’ গল্পগ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়ে প্রকাশিত হয় এবং প্রশংসিত হয়। এরপরই লন্ডনের এক সহৃদয় প্রকাশক তাঁকে উপন্যাস লিখতে উৎসাহিত করেন। উৎসাহী নাইপল ‘দ্য মিস্টিক ম্যাসিউর’ উপন্যাসটি লেখেন। এই উপন্যাসটি ১৯৫৫ সালে প্রকাশিত হয়।
নাইপল তাঁর শৈশবের গল্প দিয়েই লেখা শুরু করেন। তাঁর প্রথম তিনটি বই- ‘দ্য মিস্টিক ম্যাসিউর'(১৯৫৭), ‘দ্য সাফ্রেজ অব অ্যালভিরা’ (১৯৫৮) এবং ‘মিগুয়েল স্ট্রিট’ (১৯৫৯)। আর এই তিনটি বইয়ের কাহিনীই মূলত ক্যারিবীয় দ্বীপকে ঘিরে। তিনটি বই যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ১৯৬১ সালে তাঁর বাবা ও প্রপিতামহের জীবনের দরিদ্র ও করুণ কাহিনী নিয়ে ‘আ হাউজ ফর মি. বিশ্বাস’ লিখে তিনি প্রভূত খ্যাতি অর্জন করেন। এই উপন্যাসে তিনি একটি পরিবারের সংগ্রামমুখর জীবনের চিত্র তুলে ধরেন। পরবর্তী সময়ে তিনি বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমণ শুরু করেন। তিনি নতুন জায়গা, ভিন্ন সংস্কৃতি ও ভিন্ন মানুষ দেখতে পছন্দ করতেন।
১৯৬২ সালে তিনি ভারত ভ্রমণে আসেন। ভারত ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিয়ে একটি প্রবন্ধের বই ‘অ্যান এরিয়া অব ডার্কনেস’ লেখেন। ১৯৬৪ সালে বইটি প্রকাশিত হলে তিনি কঠোর সমালোচনার মুখোমুখি হন। ভারত সরকার বইটি নিষিদ্ধ করে। তিনি ভারত বিষয়ে তিনটি প্রবন্ধগ্রন্থ রচনা করেন- ‘অ্যান এরিয়া অব ডার্কনেস’, ‘ইন্ডিয়া : এ উন্ডেড সিভিলাইজেশন’ এবং ‘ইন্ডিয়া : এ মিলিয়ন মিউটিনিজ নাও’। কিন্তু এই তিনটি বই-ই কঠোরভাবে সমালোচিত হয়। ১৯৭৯ সালে এশিয়ার চারটি দেশ ইরান, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও পাকিস্তান ভ্রমণের পর লেখেন – ‘অ্যামাং দ্য বিলিভারস : অ্যান ইসলামিক জার্নি’। ১৯৮১ সালে বইটি প্রকাশিত হয় এবং তিনি আবার তীব্র সমালোচনার সম্মুখীন হন। সতেরো বছর পর এই চারটি দেশ আবার ভ্রমণ করেন তিনি। ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত হয় ‘বিয়ন্ড বিলিফ : ইসলামিক এক্সকারসন্স অ্যামাং দ্য কনভার্টেড পিপলস’। এই ভ্রমণকাহিনী যথেষ্ট বিতর্কের সৃষ্টি করে। বিয়ন্ড বিলিফ গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি লিখেছেন: ”This is a book about people. It is not a book of opinion. It is a book of stories”।
তিনি এরপর আফ্রিকা ভ্রমণ করেন এবং এই ভ্রমণকে কেন্দ্র করে লেখেন ‘দ্য মাস্ক অব আফ্রিকা: গ্লিম্পসেস অফ আফ্রিকান বিলিফ’। তাঁর এই রচনাটিও সমালোচনার শিকার হয়েছিল। তাঁর আরো কয়েকটি বিখ্যাত উপন্যাস হল – ‘আ ফ্ল্যাগ অন দি আইল্যান্ড’, ‘আ ওয়ে ইন দ্য ওয়ার্ল্ড’, ‘ইন আ ফ্রি স্টেট’, ‘দি এনিগমা অব অ্যারাইভাল’ (১৯৮৭), ‘ম্যাজিক সিডস’। গৃহহীনতা ও স্থানচ্যুতি – এই বিষয় দুটি তাঁর অধিকাংশ উপন্যাসে ঘুরেফিরে এসেছে। তিনি তিরিশটির বেশি গ্রন্থ রচনা করেছেন। তাঁর প্রবন্ধ গ্রন্থ ‘আ রাইটার্স পিপল : ওয়েস অফ লুকিং এন্ড ফিলিং’ -আত্মজীবনী মূলক আঙ্গিকে রচিত হয়েছে। ত্রিনিদাদের ওপর লেখা তাঁর একটি গ্রন্থ ‘দ্য লস অব এলডোরাডো’। বর্ণনা, স্মৃতিময়তা উপন্যাসটিতে একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
১৯৭১ সালে তিনি ‘বুকার’ পুরস্কার লাভ করেন তাঁর ‘ ইন আ ফ্রি স্টেট’ বইটির জন্য। ১৯৯০ সালে তিনি ‘ট্রিনিটি ক্রস’ পুরস্কারে পুরস্কৃত হন। ত্রিনিদাদ এবং টোবাগোর সর্বোচ্চ জাতীয় সম্মান হল ‘ট্রিনিটি ক্রস’। ১৯৯০ সালে তিনি ব্রিটেনের ‘নাইটহুড’ উপাধিও পান। ২০০১ সালে তিনি সাহিত্যে ‘নোবেল’ পুরস্কার (Nobel Prize) পান।
২০১৮ সালের ১১ আগস্ট লন্ডনে নিজের বাড়িতে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর।