সতীপীঠ বগুড়া

সতীপীঠ বগুড়া

সতীপীঠ বগুড়া মন্দিরটি বাংলাদেশের রাজশাহী বিভাগের অন্তর্গত বগুড়া জেলার শেরপুরে অবস্থিত। বগুড়া সদর শহর থে কে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই মন্দিরের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে করতোয়া নদী। এটি একান্ন সতীপীঠের একটি পীঠ। পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে এখানে সতীর তল্প পড়েছিল। মতান্তরে বলা হয় এখানে সতীর বাম পায়ের নুপূর বা বাম পাঁজর পতিত হয়েছিল। এখানে অধিষ্ঠিত দেবী অপর্ণা তথা মা ভবানী এবং ভৈরব হলেন বামেশ ওরফে বামন। সতীপীঠ বগুড়া মূলত ভবানীপুর শক্তিপীঠ নামেও পরিচিত। প্রতি বছর শারদীয় উৎসবের পাশাপাশি মাঘী পূর্ণিমা, রামনবমী, শ্যামা পূজা ইত্যাদি অনুষ্ঠানে পুণ্যার্থীদের সমাবেশ ঘটে এই মন্দিরকে ঘিরে।

পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে মাতা সতী বাবার কাছে স্বামীর অপমান সহ্য করতে না পেরে নিজের বাপের বাড়িতেই দেহত্যাগ করেছিলেন। মাতা সতীর দেহত্যাগের খবর মহাদেবের কাছে পৌঁছাতেই মহাদেব সেখানে উপস্থিত হন। সতীর মৃতদেহ দেখে ক্রোধে উন্মত্ত মহাদেব এই দেহ কাঁধে নিয়ে তান্ডব নৃত্য শুরু করেন। মহাদেবের তান্ডব নৃত্যে পৃথিবী ধ্বংসের আশঙ্কায় শ্রীবিষ্ণু তার সুদর্শন চক্র দ্বারা মাতা সতীর দেহ একান্নটি খণ্ডে খণ্ডিত করেন। সেই দেহখণ্ডগুলিই যে যে স্থানে পড়েছিল সেখানে একটি করে সতীপীঠ প্রতিষ্ঠা হয়। বলা হয় সতীর তল্প বা বাম পায়ের নুপূর বা বাম পাঁজর ভূপতিত হয়ে জন্ম হয়েছে এই বগুড়া সতীপীঠের।

ভবানীপুর মন্দির তথা বগুড়া সতীপীঠকে নিয়ে বহু পৌরাণিক আখ্যান গড়ে উঠেছে। সুপ্রাচীন এই মন্দিরের উৎপত্তির ইতিহাস লোকমুখে প্রচারিত। প্রায় দেড়শো বছরের পুরনো এই মন্দিরের একতলার ঘর থেকে নাকি দুপুরবেলা জঙ্গলের মধ্যেকার পুকুরে দেবী অপর্ণা তথা ভবানী মাটি নিয়ে ধুলোখেলা করতেন। তাঁকে দেখে মনে হতো সদ্য বিবাহিতা কোনো বালিকা বধূ। জনশ্রুতি অনুযায়ী, একদিন এই জঙ্গলের মধ্যে দিয়েই এক শাঁখারি যাওয়ার সময় তাঁকে ডেকে দেবী অপর্ণা তাঁরথেকে একজোড়া শাঁখা চাইলেন। কিন্তু শাঁখার দাম চাইতে গেলে দেবী শাঁখারিকে বলেন যে তিনি নাটোরের রাজকন্যা, নাটোরের মহারানির কাছে গিয়ে শাঁখারি যদি দেবীর নাম করে বলেন যে রাজবাড়ির একটি ঝুড়িতে কিছু পয়সা রাখা আছে তাহলেই তিনি শাঁখার দাম পেয়ে যাবেন। দেবীকে নাটোরের রাজকন্যা ভেবে আশ্বস্ত হয়ে দাম না নিয়েই শাঁখারি দেবীকে একজোড়া শাঁখা দিয়ে দেন। পরে নাটোরের রাজবাড়িতে কথামতো দাম চাইতে গেলে এই ঘটনা-বৃত্তান্ত শুনে মহারানি স্তম্ভিত হয়ে যান। লোকজন নিয়ে শাঁখারির কথামতো ঐ জঙ্গলঘেরা পুকুরের কাছে এলে শাঁখা-পুকুর থেকেই মা ভবানী তখন তাঁর দুই শাঁখা পরা হাত তুলে দেখান। এই দৃশ্য দেখে মহারানি এবং নাটোরের রাজবাড়ির উপস্থিত লোকজন সকলে বিস্মিত হয়ে গেল। দেবীর মাহাত্ম্য বুঝতে পেরে রানি ঐ অঞ্চলটি সংস্কার করান। তারপর থেকেই লোকের বিশ্বাস যে এই শাঁখা-পুকুর দেবীর মাহাত্ম্যে বিখ্যাত হয়ে উঠেছে। ভবানীপুর মন্দির তথা বগুড়া সতীপীঠের সঙ্গে তাই জড়িয়ে আছে শাঁখা-পুকুরের কিংবদন্তী। এই লোকবিশ্বাসের কারণে বহু ভক্ত পুণ্যার্জনের আশায় এই পুকুরে স্নান করে থাকেন। নাটোরের রাজবাড়ির মানুষরাই মূলত এই মন্দির নির্মাণ করিয়েছিলেন।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

সমগ্র মন্দিরটি প্রায় চার একর জমির উপর স্থাপিত। মূল মন্দির ছাড়া মন্দির চত্বরে রয়েছে বেলবরণ তলা, পাতাল ভৈরব মন্দির, গোপাল মন্দির, বাসুদেব মন্দির আর আটচালার নাটমন্দির। সামগ্রিকভাবে এই মন্দিরের চারপাশে রয়েছে শাঁখা পুকুর, নারায়ণের সেবা অঙ্গন, স্নানের ঘাট এবং চারটি শিবমন্দির ও একটি পঞ্চমুণ্ডীর আসন।

প্রত্যেকটি শক্তিপীঠ বা সতীপীঠে দেবী ও ভৈরব অধিষ্ঠিত থাকেন। দেবী হলেন সতীর রূপ। ভৈরব হলেন দেবীর স্বামী। সতীপীঠ বগুড়াতে দেবী অপর্ণা এবং ভৈরব হলেন বামন। দেবী অপর্ণাকেই অনেকে মা ভবানী বলে মনে করেন।

নিত্যদিনই এই মন্দিরে পূজার্চনা হয়ে থাকে। ভোরে প্রভাতী পূজা ও বাল্যভোগ, দুপুরে অন্নভোগ এবং সন্ধ্যায় সন্ধারতির পরে ভোগ অর্পণ করা হয় দেবীকে। মাঘী পূর্ণিমা, রামনবমী, শারদীয়া দুর্গাপূজা এবং দীপান্বিতা শ্যামাপূজাতেও বগুড়া সতীপীঠে অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। অঘ্রাণ মাসের তিথি অনুযায়ী নবান্নের অনুষ্ঠান উপলক্ষেও এই মন্দিরে ভক্তরা পুজো দিতে আসেন।

আপনার মতামত জানান