দুর্গাপূজা

দুর্গাপূজা

শরতের পেঁজা তুলোর মতো মেঘ আশ্বিনের শুভেচ্ছা বয়ে নিয়ে আসে। সেই মেঘের ওপার থেকে ভেসে আসে আগমনীর সুর। মা আসেন মর্ত্যধামে এইসময়। গিরিরাজের কন্যা উমা আসেন সপরিবারে তাঁর মায়ের কাছে, কৈলাস ছেড়ে পিতৃগৃহে আসা উমা যেন আমাদেরই ঘরের মেয়ে। আর তাই তো আমরা আপামর বাঙালিরা ঠিক এই সময়টাতেই উমার আগমনকে কেন্দ্র করে আরাধনা করি দেবী দুর্গার। তিনিই এ বিশ্ব সংসারের শুভ শক্তির জাগরণ ঘটান। দেবী দুর্গা বাঙালিদের অন্যতম প্রধান দেবী, বাঙালিদের শ্রেষ্ঠ পুজো এই দুর্গাপূজা । কিন্তু শরৎকালেই নয়, চৈত্রমাসে বসন্তকালেও দেবী দুর্গার পূজা করা হয়। দুর্গাকে নিয়ে প্রচলিত আছে হাজারো পৌরাণিক কাহিনি। শুধুই ভারত নয়, বিশ্বের যেখানে যেখানে বাঙালিরা আছেন, সেখানেই মহা আড়ম্বর সহকারে পালিত হয় দুর্গাপূজা।

আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষে পাঁচ দিন ধরে আয়োজিত হয় এই দুর্গাপূজা। এই মাসের আগের পক্ষটি কৃষ্ণপক্ষ যাকে বলা হয় পিতৃপক্ষমহালয়ার মধ্য দিয়ে এই পিতৃপক্ষের অবসান ঘটে সূচিত হয় দেবীপক্ষ। দিনের বিচারে শুক্লপক্ষের প্রথম দিন অর্থাৎ প্রতিপদের দিনটিই মহালয়া আর তারপর দেবীপক্ষের পঞ্চম দিন থেকে দশম দিন পর্যন্ত পঞ্চমী, ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী এবং দশমীর পূজা চলে। দেবীপক্ষের একেবারে অন্তিমে বাঙালি হিন্দুরা কোজাগরী লক্ষ্মী পুর্ণিমায় দেবী লক্ষ্মীর আবাহন করেন। পঞ্চমীতে আসেন মা দুর্গা আমাদের ঘরে, ষষ্ঠীতে হয় বোধন আর তারপর সবশেষে দশমীতে মায়ের বিসর্জনের মধ্য দিয়ে বিজয়ার সূচনা। ঘরে ঘরে ভরে ওঠে বিষাদ আর দীর্ঘ অপেক্ষা আবার পরের বছরের জন্য। 

আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে ওঠে আলোকমঞ্জীর, মহালয়ার পুণ্য প্রভাতে পিতৃপুরুষের তর্পণের পাশাপাশি মায়ের আগমনবার্তা ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বে। এই শারদীয়া দুর্গাপূজার সঙ্গেই জড়িয়ে আছে পুরাণের অকালবোধনের প্রসঙ্গে। কালিকাপুরাণ এবং বৃহদ্ধর্মপুরাণ অনুসারে রামচন্দ্র সীতা উদ্ধারের লক্ষ্যে রাবণের সঙ্গে যুদ্ধের আগে শরৎকালে করেছিলেন দেবীর পূজা। পূজায় প্রয়োজন ছিল একশো আটটি নীলপদ্ম।একশো আটটি নীল পদ্মের মধ্যে একটি ছিল না। সেই অভাব পূরণ করতে নিজের নীলাভ চোখ তীরবিদ্ধ করে অর্পণ করতে চেয়েছিলেন দেবীর পায়ে। এ কথা লেখে । মূল রামায়ণে এই কাহিনী যদিও পাওয়া যায় না। দেবীর পূজা সনাতনীভাবে আগে হতো চৈত্রমাসে – বর্তমানে বসন্তকালে পূজিত দেবী বাসন্তীই দেবী দুর্গার আসল রূপ, বাসন্তীপূজাই দেবীর সনাতনী পূজা বলে মনে করা হয়। তবে যুগে যুগে নানা পুরাণে দেবীকে নিয়ে রচিত হয়েছে নানা কাহিনী। কখনো মধু-কৈটভের ভয়ে ভীত ব্রহ্মা, কখনো ত্রিপুরাসুরের সন্ত্রাসে তটস্থ শিব দেবীর পূজা করেন; কখনো আবার পাওয়া যায় রাজা সুরথের গল্প, মহিষাসুরের গল্প, শুম্ভ-নিশুম্ভের গল্প আরো কত কি! মার্কণ্ডেয় পুরাণেই প্রথম বিস্তারিতভাবে দেবী দুর্গার পৌরাণিক মাহাত্ম্য বর্ণনা করা হয়। এই পুরাণেই ‘শ্রীশ্রীচণ্ডী’ অংশে দেবীর মাহাত্ম্য বর্ণিত হয়। পৃথিবীর রাজা সুরথ যখন যবনদের কাছে পরাজিত ও লুণ্ঠিত হয়ে বনে চলে যান, সেখানে মেধস ঋষির আশ্রমে এসে উপনীত হন। এই মেধস ঋষিই সুরথকে দেবী মহামায়ার তিনটি আলাদা আলাদা গল্প বলেন। এই গল্পেই জানা যায় ঋষি মেধসের আশ্রমে রাজা সুরথই প্রথম দুর্গাপূজা করেন এই মর্ত্যধামে আর সেটাই বিশ্বের প্রথম দুর্গাপূজা । যোগনিদ্রায় মগ্ন বিষ্ণুর কর্ণমল থেকে জাত মধু ও কৈটভ দুই অসুরকে নিধন করেন মহামায়া। তারপরে প্রবল প্রতাপী মহিষাসুরকেও নিধন করেন তিনি। কিন্তু তখন আর তিনি মহামায়া নন, সকল দেবতার প্রার্থনায় ও মিলিত তেজঃপুঞ্জে বলীয়ান হয়ে তিনি তখন দেবী দুর্গা। তাঁর দশ হাতে দশটি অস্ত্র তুলে দেন দশ জন দেবতা। একেক অস্ত্রের একেক নাম, একেক তাৎপর্য। দেবীর বাহন সিংহ। পরবর্তীকালে যদিও শুম্ভ-নিশুম্ভ বধের সময় দেবী কৌশিকীর রূপে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। দেবী কৌশিকী পার্বতীর এক বিশেষ রূপ। হিন্দু পুরাণে পার্বতী, উমা, দুর্গা, মহামায়া সবই মিলেমিশে একই মহাশক্তির প্রতীক হয়ে ওঠে।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

আজ যে আমরা দুর্গাপ্রতিমা দেখি, তেমনটা বহু প্রাচীনকালে ছিল না। রাজা কংসনারায়ণই প্রথম এই রীতিতে দেবীর প্রতিমা নির্মাণ করান আর সেই রীতিই আজও বহমান। বিভিন্ন স্থানে দুর্গাপ্রতিমার শিল্পরীতির বিভিন্ন রূপ লক্ষ করা যায়। কিন্তু সব মিলিয়ে কখনো একচালায়, কখনো বা পাঁচ চালায় দেবী দুর্গার দুই পাশে থাকেন তাঁর সন্তানেরা – গণেশ, কার্তিক, লক্ষ্মী, সরস্বতী আর থাকে সকলের নির্দিষ্ট বাহন। গণেশের ইঁদুর, কার্তিকের ময়ূর, লক্ষ্মীর পেঁচা আর দেবী সরস্বতীর বাহন হাঁস। দেবী দুর্গার পূজার উপচার সজ্জিত হয় একেক দিন একেকভাবে। ষষ্ঠীতে হয় দেবীর বোধন, সপ্তমীতে নবপত্রিকা স্নান, অষ্টমীতে কুমারীপুজো আর সন্ধিপুজোর কথা তো আমরা সকলেই কমবেশি জানি।

কলকাতা ছাড়া পুরো পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় বহু দুর্গাপুজো হয়। কোথাও বারোয়ারি পুজো, কোথাও সার্বজনীন পুজো। কলকাতার বনেদী বাড়িগুলির দুর্গাপুজোর ঐতিহ্য তো ইতিহাসখ্যাত। বিভিন্ন বাড়ির বিভিন্ন রীতি-নীতি, পুজোর বিভিন্ন উপচার। মূর্তিও কোথাও কোথাও আলাদা। বনেদী বাড়িগুলিতে বেশিরভাগ সময়েই একচালার মূর্তি দেখা যায়, আর অন্যান্য সময়ে পাঁচ চালার মূর্তিতেই বেশি পুজো দেখা যায়। কীভাবে বাংলায় এই দুর্গাপুজোর প্রচলন তারও এক আলাদা ইতিহাস আছে। সব মিলিয়ে বাঙালির সংস্কৃতিতে দুর্গাপূজা বিরাট এক জায়গা জুড়ে আছে, এই পূজাই বাঙালির গৌরব ও গর্বের অন্যতম উপাদান বলা যায়।

36 comments

  1. পিংব্যাকঃ মহালয়া | সববাংলায়

আপনার মতামত জানান