টাকি

টাকি ভ্রমণ

ইছামতী নদীর বাঁধানো পাড়। ছবি সববাংলায়

শীতকালে বাঙালীর প্রিয় পিকনিকের জায়গাগুলোর মধ্যে একটি হতে পারে টাকি। তবে শুধু শীতকালেই না, সারা বছর ধরেই  এখানে আছে বাঙালি, সারা বছর জুড়েই চলে পিকনিক। বিভিন্ন স্কুল থেকেও একদিনের ভ্রমণের জন্য নিয়ে আসা হয় টাকি। কলকাতা থেকে মাত্র ২ ঘণ্টার দূরত্বে ইছামতী নদীর পাড়ে টাকি শহরে একদিনের ভ্রমণের জন্য আসাই যায় আবার এখানে এসে থাকাও যায়। এখানে খুব কাছ থেকে বাংলাদেশকে দেখা যায় কারণ ইছামতীর অন্য পাড়েই বাংলাদেশ। টাকি শহরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান, তবে টাকির সবচেয়ে আকর্ষণীয় বা দর্শনীয় স্থান হল গোলপাতার জঙ্গল বা মিনি সুন্দরবন। এটি ইছামতীর ধারে মানুষের দ্বারা তৈরি করা ছোট্ট ম্যানগ্রোভ জঙ্গল। এছাড়াও অন্যান্য দর্শনীয় স্থানের পাশাপাশি ইছামতীতে নৌকা নিয়ে নদী ভ্রমণ করা যায়, যাওয়া যায় কাছাকাছি একটি ছোট দ্বীপ, যার নাম মাছরাঙা দ্বীপ।

পশ্চিমবঙ্গের ইছামতী নদীর তীরে উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলার একটি শহর হল টাকি। ইছামতী নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত টাকি এবং নদীর পূর্ব তীরে ভারতের প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশ। কলকাতা থেকে টাকির দুরত্ব ৭০ কিমি।

টাকির জমিদারবাড়ির ভগ্নাবশেষ (২০১৫)। ছবি সববাংলায়

এককালে টাকি ছিল জমিদারদের শহর। এখনও টাকির চারপাশে বিভিন্ন ভগ্ন জমিদারবাড়ি অতীতের সেইসব কাহিনীর সাক্ষ্য বয়ে চলেছে। যেমন ইছামতী নদী সাক্ষ্য বয়ে চলেছে দেশভাগের। এককালে যখন দুই দেশ এক ছিল তখন এই নদী সেই দেশের জমিকে ভাগ করে বয়ে যেত নিজের মত। এখন দুই দেশ এই নদীকেই কাল্পনিক সীমানা দিয়ে ভাগ করে নিয়েছে। তাই নদীতে যে নৌকাগুলো চলে, তাতে কোন দেশের নৌকাটা বোঝাতে সেই পতাকা বেঁধে রাখা জরুরী। তবে দুর্গাপূজার সময়ে নদীর দুইপাড়েই কিন্তু মেতে ওঠে দুই দেশ। আর দশমীর সময়ে প্রতিমা বিসর্জন তো টাকির আরেক দর্শনীয় বিষয়। সেই সময়ে স্বাভাবিক কারণেই সীমান্তরক্ষী বাড়িয়ে দেওয়া হয় এখানে। টাকি যখনই ঘুরতে আসবেন, সঙ্গে সরকারী পরিচয়পত্র আনতে কিন্তু ভুলবেন না।

২০১৬ সালে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী কলকাতা থেকে টাকি যেতে সময় লাগে দুই ঘণ্টার মত। কলকাতা থেকে  টাকি যাওয়ার জন্য সবচেয়ে ভালো হচ্ছে শিয়ালদহ থেকে লোকাল ট্রেন। ভোর থেকেই শিয়ালদহ হাসনাবাদ লোকাল চালু হয় এবং প্রায় প্রতি ঘন্টায় একটি লোকাল চলে। আর সেই ট্রেন চলে প্রায় রাত দশটা অবধি। এই ট্রেনে করে নামতে হবে টাকিরোড স্টেশনে।  সুবিধার জন্য শিয়ালদহ হাসনাবাদ লোকাল ট্রেনের সকালের সময়সূূূচি এখানে দেওয়া হল।

ট্রেন নাম্বারট্রেনের নামকখন ছাড়বেটাকিরোড স্টেশান কখন পৌঁছবে
৩৩৫১১শিয়ালদহ হাসনাবাদ লোকালভোর ৫টা ২০ মিনিটসকাল ৭টা ১৪ মিনিট
৩৩৫১৩শিয়ালদহ হাসনাবাদ লোকালসকাল ৬টা ১২ মিনিটসকাল ৮টা ১০ মিনিট
৩৩৫১৫শিয়ালদহ হাসনাবাদ লোকালসকাল ৭টা ৪০ মিনিটসকাল ৯টা ৪৩ মিনিট
৩৩৫১৭শিয়ালদহ হাসনাবাদ লোকালসকাল ৮টা ২২ মিনিটসকাল ১০টা ১৪ মিনিট
৩৩৫১৯শিয়ালদহ হাসনাবাদ লোকালসকাল ৯টা ২০ মিনিটসকাল ১১টা ১৭ মিনিট
৩৩৫২১শিয়ালদহ হাসনাবাদ লোকালবেলা ১১টা ৭ মিনিটদুপুর ১২টা ৫৮ মিনিট
৩৩৫২৩শিয়ালদহ হাসনাবাদ লোকালদুপুর ১২টা ১৮ মিনিটদুপুর ২টো ১০ মিনিট

যাত্রীদের জন্য অপেক্ষা করছে নৌকা। ছবি সববাংলায়

তারপর স্টেশান থেকে ভ্যানরিক্সা ভাড়া করে নদীর পাড়ে আসা যায়। এখানে বসার জন্য সুন্দর বাঁধানো জায়গা আছে। আবার জেটিঘাটে যেতে চাইলে সেখানেও নামতে পারেন। আর যদি থাকতে চান তাহলে তো সরাসরি গেস্ট হাউসে চলে আসুন। আর যদি একদিনের ভ্রমণের জন্য এসে থাকেন, তাহলে টাকি ভ্রমণের জন্য স্টেশান  থেকেও ভ্যানরিক্সা ভাড়া করে নিতে পারেন বা নদীর পাড় থেকেও করতে পারেন। ২০১৬ সালের পাওয়া তথ্য অনুযায়ী টাকি ঘুরতে ভ্যানরিক্সার ভাড়া মোটামুটি ৫০০ টাকা।

বাসে করে গেলে এসপ্ল্যানেড থেকে বাস চলে। তার মধ্যে একটি হল লোকাল বাস ২৫২, যে এসপ্ল্যানেড থেকে হাসনাবাদ যায়। মাঝে টাকিতে নেমে যেতে পারেন। আর নিজের গাড়ি নিয়ে এলে তো সোজা টাকিতে চলে আসুন। তবে একদিনের ভ্রমণের জন্য এলে নিজের গাড়ি না নিয়ে ট্রেন বা বাসে আসুন। থাকার জন্য হলে গাড়ি নিয়ে আসতেই পারেন।

টাকিতে থাকার জন্য অনেক গেস্টহাউস আছে। বেশ কিছু রিসোর্ট আছে, যেখান থেকে ইছামতীর ভালো দৃশ্য দেখা যায়।

মিনি সুন্দরবনে যাওয়ার রাস্তা
মিনি সুন্দরবনে যাওয়ার রাস্তা। ছবি সববাংলায়

টাকির সবচেয়ে আকর্ষণীয় বা দর্শনীয় জায়গা হল গোলপাতার জঙ্গল বা মিনি সুন্দরবন। এটি ইছামতীর ধারে মানুষের দ্বারা তৈরি করা ছোট্ট ম্যানগ্রোভ জঙ্গল। জঙ্গলে ঢোকার জন্য বাঁধানো একটা পথ আছে, বা বলা যেতে পারে একটা ছোট ব্রিজ। এই ব্রিজের তলায় কাদা মাখা পথ। ব্রিজের শেষে একটা ভিউ পয়েন্ট বানানো হয়েছে বনের মধ্যে। তার সিঁড়ি ধরে নেমে গেলে কাদা মাখা জঙ্গলের পথ।  সেখানে সুন্দরবনের আদলেই তৈরি নোনামাটি আর তাতে দাঁড়িয়ে আছে বিভিন্ন গাছ আর তাদের ছোট ছোট শ্বাসমূল। নোনামাটিতে অক্সিজেন নিতে গাছ তার শিকড় এভাবেই মাটির উপর তুলে রাখে। কাদামাটিতে বিভিন্ন পোকামাকড়, ব্যাঙ্গাচি আর কাঁকড়াদের চলাফেরা দেখতে দেখতে সময় কেটে যাবে। জঙ্গলের পথে না যাওয়াই ভালো। ভিউপয়েন্টের শেষে সিঁড়ি দিয়ে জঙ্গলের মধ্যে যে রাস্তা নেমে গেছে, সে রাস্তা ভয়ানক পিচ্ছিল। এই কাদায় বেসামাল হলেই পড়ে গিয়ে বাজেরকম চোট লাগতে পারে। সঙ্গে সাপ বা অন্য পোকামাকড় কামড়ানোর ভয় থাকেই।

টাকির কাঁকড়া
মিনি সুন্দরবনের নোনামাটিতে কাঁকড়া। ছবি সববাংলায়

গোলপাতার জঙ্গলের  থেকে বেরিয়ে অন্যপথে নদীর পাড় অবধি যাওয়া যায়। বিভিন্ন গাছের সারিতে ঘেরা নদীর পাড়ে বসে বন্ধুদের সাথে গল্প করতে করতে সময় চলে যাবে । এই যাবার পথে বিভিন্ন জন্তু, পাখি বা বিভিন্নধরনের গাছ দেখতে পাবেন। যেমন এখানে গোঁয়ারগেল (গোসাপ) বা বেজি হঠাৎ করেই জঙ্গলের  এক প্রান্ত থেকে বেরিয়ে অন্যপ্রান্তে চলে যেতে পারে। এখানে পুরনো জমিদার বাড়িগুলো ঘুরে আসতে পারেন, যদিও ভেতরে ঢোকার সুযোগ পাওয়া যাবে না। নদীর পাড়ে জমিদারবাড়ি তো ইতিমধ্যেই ভেঙে গেছে, সেখানে খুব বেশি ভেতরে না যাওয়াই ভালো, কারণ সাপ বা পোকামাকড় থাকতে পারে। বাইরে থেকে এই জায়গাগুলো দেখতে দেখতে পুরনো ভারতের পুরনো বাংলার কথা মনে পড়া স্বাভাবিক। এছাড়াও কাছাকাছি কিছু মন্দির বা মঠ আছে যেগুলো ঘুরে দেখতে পারেন। টাকির আরেক আকর্ষণ অবশ্যই ইছামতীতে নৌকাভ্রমণ। ইছামতীতে নৌকা চড়ে কাছাকাছি একটি দ্বীপ আছে , যার নাম মাছরাঙা দ্বীপ, সেখানে যেতে পারেন।

সারা বছর ধরেই মানুষ জন্য এখানে ঘুরতে আসে। বিশেষ করে শীতের সময় এখানে বেশ মনোরম পরিবেশ থাকে যখন পিকনিকের জন্য এখানে প্রচুর মানুষ ভিড় করে। আর দুর্গাপূজার বিসর্জনের সময় এখানের প্রতিমা বিসর্জন দেখতে আসা আলাদা এক আনন্দের বিষয়।

এখানে এলে অবশ্যই কিন্তু মালপোয়া খেতে ভুলবেন না। এছাড়াও গেস্ট হাউসে থাকলে ইলিশ এবং অন্যান্য কিছু মাছের খাবার খেয়ে দেখতে পারেন।

গোলপাতার জঙ্গল বা মিনি সুন্দরবনের দায়িত্বে স্থানীয় পঞ্চায়েত এবং বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স। জঙ্গলে ঢোকার সময় তাদের কাছে সরকারী পরিচয়পত্র জমা দিয়ে ঢুকতে হয়। আবার বেরনোর সময় সেটি ফেরত পাওয়া যায়। তাই টাকি ভ্রমণকালে সঙ্গে সরকারী পরিচয়পত্র রাখা আবশ্যিক। আর এই জঙ্গলের বাঁধানো ব্রিজের মত রাস্তা দিয়ে যতটুকু দেখা যায় ততটা দেখাই ভালো। নিচে নেমে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে নদীর পাড় আসার পথ খুব বিপদজনক, সেখানে যাবেন না। ব্রিজ থেকেই জঙ্গলের ভিউ উপভোগ করুন।


ট্রিপ টিপস

  • কিভাবে যাবেন – কলকাতা থেকে টাকি মাত্র ৭০ কিমি এবং যেতে সময় লাগে দুই ঘণ্টার মত। কলকাতা থেকে  টাকি যাওয়ার জন্য সবচেয়ে ভালো হচ্ছে শিয়ালদহ থেকে লোকাল ট্রেন। তারপর স্টেশান থেকে ভ্যানরিক্সা ভাড়া করে নদীর পাড়ে আসা যায়। আর যদি একদিনের ভ্রমণের জন্য এসে থাকেন, তাহলে টাকি ভ্রমণের জন্য স্টেশান  থেকেও ভ্যানরিক্সা ভাড়া করে নিতে পারেন বা নদীর পাড় থেকেও করতে পারেন। বাসে করে গেলে অনেক লোকাল আছে যার মধ্যে ২৫২, যে এসপ্ল্যানেড থেকে হাসনাবাদ যায়। মাঝে টাকিতে নেমে যেতে পারেন। আর নিজের গাড়ি নিয়ে এলে তো সোজা টাকিতে চলে আসুন। তবে একদিনের ভ্রমণের জন্য এলে নিজের গাড়ি না নিয়ে ট্রেন বা বাসে আসুন।
  • কোথায় থাকবেন – টাকিতে থাকার জন্য অনেক গেস্টহাউস আছে। বেশ কিছু রিসোর্ট আছে, যেখান থেকে ইছামতীর ভালো দৃশ্য দেখা যায়।
  • কি দেখবেন – টাকির সবচেয়ে আকর্ষণীয় বা দর্শনীয় জায়গা হল গোলপাতার জঙ্গল বা মিনি সুন্দরবন। গোলপাতার জঙ্গলের  থেকে বেরিয়ে অন্যপথে নদীর পাড় অবধি যাওয়া যায়।  এই যাবার পথে বিভিন্ন জন্তু, পাখি বা বিভিন্নধরনের গাছ দেখতে পাবেন। এখানে পুরনো জমিদার বাড়িগুলো ঘুরে আসতে পারেন, যদিও ভেতরে ঢোকার সুযোগ পাওয়া যাবে না। এছাড়াও কাছাকাছি কিছু মন্দির বা মঠ আছে যেগুলো ঘুরে দেখতে পারেন। টাকির আরেক আকর্ষণ অবশ্যই ইছামতীতে নৌকাভ্রমণ। ইছামতীতে নৌকা চড়ে কাছাকাছি একটি দ্বীপ আছে , যার নাম মাছরাঙা দ্বীপ, সেখানে যেতে পারেন। আর দুর্গাপূজার বিসর্জনের সময় এখানের প্রতিমা বিসর্জন দেখতে আসা আলাদা এক আনন্দ।
  • কখন যাবেন – বছরের যে কোনো সময়।
  • সতর্কতা
    • জঙ্গলের বাঁধানো ব্রিজের মত রাস্তা দিয়ে যতটুকু দেখা যায় ততটা দেখাই ভালো। নিচে নেমে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে নদীর পাড় আসার পথ খুব বিপদজনক, সেখানে যাবেন না। ব্রিজ থেকেই জঙ্গলের ভিউ উপভোগ করুন।
    • নদীর পাড়ে জমিদারবাড়ি তো ইতিমধ্যেই ভেঙে গেছে, সেখানে খুব বেশি ভেতরে না যাওয়াই ভালো, কারণ সাপ বা পোকামাকড় থাকতে পাড়ে।
  • বিশেষ পরামর্শ – টাকি ভ্রমণকালে সঙ্গে সরকারী পরিচয়পত্র রাখা আবশ্যিক, কারণ গোলপাতার জঙ্গল বা মিনি সুন্দরবনে ঢোকার সময় সরকারী পরিচয়পত্র জমা দিয়ে ঢুকতে হয়।

তথ্যসূত্র


  1. নিজস্ব প্রতিনিধি
  2. https://en.wikivoyage.org/wiki/Taki
  3. https://indiarailinfo.com/search/sdah-sealdah-to-tkf-taki-road/

One comment

আপনার মতামত জানান