সোনার অন্নপূর্ণা

সোনার অন্নপূর্ণা মন্দির ভ্রমণ

সোনার অন্নপূর্ণা মন্দির
সোনার অন্নপূর্ণা মন্দির

দক্ষিণেশ্বর মন্দির থেকে মাত্র পনেরো কিলোমিটারের মধ্যেই হুবহু দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের মত দেখতে একটি মন্দির রয়েছে। মন্দিরটির নাম সোনার অন্নপূর্ণা মন্দির। দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা রানী রাসমণির ছোট মেয়ে জগদম্বা এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা।

সোনার অন্নপূর্ণা মন্দির ব্যারাকপুর রেল স্টেশন থেকে আড়াই কিলোমিটার দূরে হুগলী নদীর তীরে অবস্থিত। ব্যারাকপুরের তৎকালীন নাম ছিল চানক,তাই মন্দিরটিকে চানক মন্দিরও বলা হয়।

প্রচলিত জনশ্রুতি অনুসারে ১৮৪৭ সালে কলকাতার জানবাজারের রানী রাসমণিদেবী কাশীতে অন্নপূর্ণা দর্শনের জন্য যাত্রা করছিলেন। তীর্থযাত্রার ঠিক আগের দিন রাতে রানী দেবী কালীর স্বপ্নাদেশ পান যে তাঁর কাশী যাওয়ার প্রয়োজন নেই। গঙ্গাতীরেই একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করে পূজা করলে দেবী সেই মূর্তিতে আবির্ভূত হয়েই পূজা গ্রহণ করবেন। তখন রানী দক্ষিণেশ্বর মন্দির তৈরি করেন। কিন্তু তাঁরা কাশীতে যেহেতু অন্নপূর্ণা দর্শনে যাচ্ছিলেন, তাই রানী রাসমণির জামাই মথুরমোহন বিশ্বাসের ইচ্ছে ছিল যদি দেবী অন্নপূর্ণার মন্দির প্রতিষ্ঠা করা যায়। কিন্তু নিজের জীবনকালে তা করে যেতে পারেননি। তবে তাঁর সেই ইচ্ছেপূরণ করেছিলেন তাঁর স্ত্রী, রানি রাসমণির ছোট মেয়ে জগদম্বা। তিনি হুগলী নদীর তীরে তৎকালীন চানক নগরে (বর্তমান ব্যারাকপুর) দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের আদলে তৈরি করলেন দেবী অন্নপূর্ণার মন্দির, স্থানীয়দের কাছে যা সোনার অন্নপূর্ণা মন্দির বলে পরিচিত। মন্দিরের প্রবেশদ্বারের লোহার গ্রিলের অংশ হিসাবে এই নামটি খোদাই করা আছে। তবে এই মন্দিরের পোশাকি নাম শিবশক্তি অন্নপূর্ণা মন্দির। ১৮৭৫ সালের ১২ এপ্রিল চৈত্র সংক্রান্তির দিনে এই মন্দিরের উদ্বোধন হয়। তারিখ সমেত মন্দিরের পোশাকি নামটি মন্দিরের গায়ে খোদাই করা আছে।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

 মন্দির চত্বরের ছয়টি শিবমন্দির
মন্দির চত্বরের ছয়টি শিবমন্দির

অবিকল দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের আদলে তৈরি সোনার অন্নপূর্ণা মন্দির বঙ্গীয় স্থাপত্যশৈলীর নবরত্ন স্থাপত্যধারায় নির্মিত। দক্ষিণেশ্বরের মতই এখানেও রয়েছে আটচালা স্থাপত্যরীতিতে নির্মিত শিবমন্দির। অন্নপূর্ণা পূজা, বাসন্তী পূজা এই সব উৎসবে এখানে প্রচুর ভিড় হয়। তাছাড়াও চৈত্র সংক্রান্তির দিন মন্দিরের প্রতিষ্ঠা দিবস এবং অন্যান্য উৎসবেও ভিড় হয়। মন্দিরে প্রতিদিন অন্নভোগ দেওয়া হয় দেবীকে। মায়ের ভোগে থাকে মাছ। আগে পাঁঠাবলি হলেও এখন তা বন্ধ।

ট্রেনে করে এলে হাওড়া থেকে ব্যারাকপুরের জন্য প্রচুর ট্রেন পাওয়া যায়। চক্ররেলে করেও ব্যারাকপুর আসা যায়। তারপর টোটো বা রিক্সা করে মন্দির অবধি আসতে পারেন। বাসে এলে তালপুকুর বাসস্টপে নেমে হাঁটা পথে আসা যায় এই মন্দিরে। গাড়ি করে এলে বিটি রোড ধরে ব্যারাকপুর এসে তারপর বামদিকে পার্ক রোড ধরে এক কিলোমিটার এলেই মন্দিরে আসা যায়। মন্দির চত্বরের একদম বাইরে পার্কিং এর ব্যবস্থা রয়েছে।

সোনার অন্নপূর্ণা মন্দির ঘোরার জন্য রাত্রিবাসের কোনো প্রয়োজন নেই। একদিনের জন্য এখানে সহজেই ঘুরতে আসা যায়। তাও থাকতে চাইলে ব্যারাকপুরের কাছাকাছি হোটেলে থাকা যায়। সেখান থেকেই একদিনের জন্য এই মন্দিরে ঘুরতে আসা যায়।

মন্দিরের বিগ্রহ। ছবি ইন্টারনেট

পাঁচিল দিয়ে ঘেরা মন্দির চত্বরে প্রবেশ করার সময় মন্দিরের মূল দরজার উপর একটি সিংহমূর্তি রয়েছে। ব্রিটিশ প্রশাসন সেটি সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিল। তাঁদের বক্তব্য ছিল সিংহমূর্তি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রতীক। তাই মন্দির কর্তৃপক্ষ এটি ব্যবহার করতে পারবে না। তবে দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পরে আদালতের রায়ে সিংহমূর্তিটি রয়ে যায় এবং আজও সেখানেই আছে। মন্দিরে ওঠবার জন্য দক্ষিণ, পশ্চিম ও উত্তর দিকে সিঁড়ি আছে। মন্দিরের ভেতরে শ্বেতপাথরের বেদীর উপর রুপোর তৈরী সিংহাসনে রাখা দেবী অন্নপূর্ণার মূর্তি। তাঁর ডান হাতে অন্নদান করার হাতা এবং বাঁ হাতে অন্নপাত্র। চালচিত্র ও সিংহাসন রুপোর তৈরি। তাঁর পাশে শিবের মূর্তি। সোনার অন্নপূর্ণা মন্দির নাম হলেও মূর্তিগুলো অষ্টধাতুর তৈরি। প্রচলিত জনশ্রুতি অনুসারে অন্নপূর্ণার মূর্তি তৈরি হয়েছে তিনভাগ সোনা ও একভাগ অষ্টধাতু দিয়ে। শিবমূর্তি তৈরি হয়েছে একভাগ সোনা আর তিনভাগ অষ্টধাতু দিয়ে। মন্দিরের বিগ্রহের ছবি তোলা নিষেধ মন্দির চত্বরে রয়েছে ছয়টি শিবমন্দির। এদের নাম হল যথাক্রমে কল্যাণেশ্বর, কাম্বেশ্বর, কিন্নরেশ্বর, কেদারেশ্বর, কৈলাসেশ্বর ও কপিলেশ্বর। এছাড়াও মন্দির চত্বরে রয়েছে নাট মন্দির, দু’টি নহবৎখানা, ভোগের ঘর ইত্যাদি। ভোগের ঘরে জগদম্বা দেবীর ছবি, মথুরবাবুর ছবি ইত্যাদি বেশ কিছু পুরনো ছবি রয়েছে। মূল মন্দিরের সামনে জগদম্বা দেবীর একটি মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে। ভোর পাঁচটা থেকে দুপুর দেড়টা পর্যন্ত এবং বিকেল চারটে থেকে সন্ধে আটটা পর্যন্ত মন্দির খোলা থাকে। ভোগের প্রসাদ বিতরণ করা হয় দুপুর দেড়টা থেকে দুটো পর্যন্ত। ভোগের জন্য মাথাপিছু ১২০ টাকা দিতে হয়। এছাড়াও আপনি যদি মায়ের পূজার জন্য বা মায়ের গহনা বা মন্দির সংস্কারের জন্য বা মন্দিরের উন্নতির জন্য কিছু দান করতে চান, মন্দিরের ভিতরে অফিসে যোগাযোগ করতে পারেন।

মন্দিরের কাছে ঘুরে দেখবার বেশ কিছু জায়গা আছে। মন্দিরের একদম কাছে গঙ্গার যে ঘাটটি আছে তা রানী রাসমণি ঘাট নামে পরিচিত। প্রচলিত জনশ্রুতি অনুসারে এখানে শ্রীরামকৃষ্ণ শিখ সৈন্যদের সঙ্গে স্নান করেছিলেন। এছাড়াও টোটো বা রিক্সা ভাড়া করে ঘুরতে পারেন জহর কুঞ্জ, গান্ধী ঘাট, গান্ধী স্মারক সংগ্রহালয়, মঙ্গল পাণ্ডে পার্ক ও স্মৃতিসৌধ ইত্যাদি জায়গা। টোটো করে ঘুরবার আগে ভাড়া এবং কোন কোন জায়গা দেখাবে জেনে নিন। নিজের গাড়ি বা গাড়ি বুক করে ঘুরলে সবচেয়ে ভাল। ব্যারাকপুরের অন্যান্য জায়গা সমেত ভ্রমণের খুঁটিনাটি জানতে এখানে পড়ুন।

সারা বছর ধরেই এখানে আসা যায়। বিভিন্ন উৎসব যেমন অন্নপূর্ণা পূজা, বাসন্তী পূজা, নীলষষ্ঠী, শিবরাত্রি, মঙ্গলচণ্ডী পূজা, বিপত্তারিণী, অম্বুবাচী, দুর্গাপূজা, কালীপূজা, জগদ্ধাত্রী পূজা এইসব দিনে প্রচুর ভিড় হয়। তবে উৎসবের দিনগুলো ছাড়া বছরের বাকি দিনগুলো মন্দির প্রায় ফাঁকাই থাকে। তাই বিকালের পর এখানে না থাকাই ভালো।


ট্রিপ টিপস

  • কিভাবে যাবেন – ট্রেনে করে এলে হাওড়া থেকে ব্যারাকপুরের জন্য প্রচুর ট্রেন পাওয়া যায়। চক্ররেলে করেও ব্যারাকপুর আসা যায়। তারপর টোটো বা রিক্সা করে মন্দির অবধি আসতে পারেন। বাসে এলে তালপুকুর বাসস্টপে নেমে হাঁটা পথে আসা যায় এই মন্দিরে।
  • কোথায় থাকবেন – মন্দিরের কাছাকাছি থাকবার ব্যবস্থা নেই। ব্যারাকপুরের কাছাকাছি হোটেলে থাকা যায়। সেখান থেকেই একদিনের জন্য এই মন্দিরে ঘুরতে আসা যায়।
  • কি দেখবেন – অন্নপূর্ণা মন্দির, ছয়টি শিবমন্দির। মন্দিরের একদম কাছে রানী রাসমণি ঘাট। এছাড়াও টোটো বা রিক্সা ভাড়া করে ঘুরতে পারেন জহর কুঞ্জ, গান্ধী ঘাট, গান্ধী স্মারক সংগ্রহালয়, মঙ্গল পাণ্ডে পার্ক ও স্মৃতিসৌধ ইত্যাদি জায়গা।
  • কখন যাবেন – সারা বছর ধরেই এখানে আসা যায়। বিভিন্ন উৎসবে প্রচুর ভিড় হয়।
  • সতর্কতা
    • মন্দিরের সময়সূচি দেখে নেবেন বা স্থানীয়দের জিজ্ঞেস করে নিতে পারেন।
    • উৎসবের দিনগুলো ছাড়া বছরের বাকি দিনগুলো মন্দির প্রায় ফাঁকাই থাকে। তাই বিকালের পর এখানে না থাকাই ভালো।
    • মন্দিরের বিগ্রহের ছবি তোলা নিষেধ।
  • বিশেষ পরামর্শ
    • গাড়ি করে এলে সবথেকে সুবিধা। মন্দির চত্বরের একদম বাইরে পার্কিং এর ব্যবস্থা রয়েছে। এর খুব কাছেই ঘোরার জায়গাগুলো সহজেই গাড়ি করে ঘুরে নিতে পারবেন।

এই মন্দির ভ্রমণের তথ্য ভিডিও আকারে দেখুন এখানে

তথ্যসূত্র


  1. নিজস্ব প্রতিনিধি
  2. https://www.anandabazar.com/
  3. https://www.calcuttanewstv.com/
  4. https://www.bangodesh.com/
  5. https://www.jiyobangla.com/

2 comments

আপনার মতামত জানান