জগদ্ধাত্রী 

জগদ্ধাত্রী পূজা

জগদ্ধাত্রী হলেন হিন্দুদের এক আরাধ্যা দেবী। এই দেবীর পূজাই হল জগদ্ধাত্রী পূজা।কার্তিক মাসের শুক্লা নবমী তিথিতে এই জগদ্ধাত্রী পূজা প্রধানত পশ্চিমবঙ্গে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।জগদ্ধাত্রী দেবী ত্রিনয়না, চতুর্ভূজা ও সিংহবাহিনী। তাঁর হাতে এক হাতে শঙ্খ, এক হাতে চক্র, এক হাতে ধনুক ও এক হাতে বাণ; গলায় নাগযজ্ঞোপবীত।এই দেবীর বাহন সিংহ।কিন্তু এই সিংহ করীন্দ্রাসুর অর্থাৎ হস্তীরূপী অসুরের পিঠে দাঁড়িয়ে থাকে। দেবীর গায়ের রঙ সদ্য উদিত সূর্যের রঙের মত।

বিভিন্ন তন্ত্র ও পুরাণ গ্রন্থ অনুযায়ী জগদ্ধাত্রী হলেন দেবী দুর্গার আর এক রূপ। উপনিষদে এই জগদ্ধাত্রীর নাম  উমা হৈমবতী । জগদ্ধাত্রীর সৃষ্টি সম্পর্কে বিভিন্ন পৌরাণিক উপাখ্যানে বিভিন্ন রকম কাহিনী বর্ণিত হয়েছে।যেমন ‘কেন উপনিষদ’ অনুসারে-  দেবতা এবং অসুরদের মধে যুদ্ধে দেবতারা অসুরদের পরাজিত করে এতটাই দাম্ভিক এবং অহংকারী হয়ে উঠলেন যে তারা ভাবতে শুরু করলেন ব্রহ্মের বলে বলীয়ান হয়ে নয় তাদের এই যুদ্ধ জয় তাদের নিজের ক্ষমতায়। ব্রহ্ম তখন যক্ষের বেশে অহংকারী দেবতাদের সামনে উপস্থিত হয়ে তাদের সম্মুখে এক টুকরো ঘাস  রেখে যার যার শক্তি প্রয়োগ করতে বললেন ঘাসটির ওপর।অগ্নি ও বায়ু তাঁদের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করেও সেই ঐ এক টুকরো ঘাসকে না পুড়িয়ে দিতে বা উড়িয়ে দিতে পারলেন। দেবগণ তখন ঠিক করলেন ইন্দ্রকে যক্ষের আসল পরিচয় জানবার জন্য পাঠানো হবে। ইন্দ্র অহংকার-মদমত্ত হয়ে নয়, যক্ষের কাছে এসেছিলেন জিজ্ঞাসু হয়ে। ইন্দ্রের বিনয়ে সন্তুষ্ট যক্ষ তাঁর সামনে থেকে অদৃশ্য হলেন এবং ইন্দ্র দেখলেন আকাশে দিব্য স্ত্রীমূর্তিতে আবির্ভূত হলেন হৈমবতী উমা।ইনিই জগদ্ধাত্রী। জগদ্ধাত্রী এভাবে আবির্ভূতা হয়ে দেবতাদের জ্ঞানচক্ষুটি উন্মীলিত করলেন। বুঝিয়ে দিলেন, তিনিই এই জগতের ধারিণী শক্তি।

জগদ্ধাত্রী যে দুর্গারই আরেক রূপ, তার প্রথম সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় শ্রীশ্রীচণ্ডীতে । শ্রীশ্রীচণ্ডী অনুযায়ী, যুদ্ধের সময়  মহিষাসুর নানা ছলনার আশ্রয়ে, নানান রূপে  বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছিলেন দেবীকে।  মহিষাসুরের সেই বিভিন্ন রূপের একটি হল  হস্তীরূপ। সেই হস্তী দেবীকে বধের চেষ্টা করলে দুর্গা ধারণ করলেন এক চতুর্ভুজা মূর্তি। চক্রের আঘাতে তিনি ছিন্ন করেন হাতির শুঁড়টি। সেই রূপটিই জগদ্ধাত্রীর। এই কারণেই ধ্যানমন্ত্রে কোথাও উল্লেখ না থাকলেও মূর্তিতত্ত্বে  জগদ্ধাত্রী বাহন সিংহ এক হস্তীর মৃত শরীরের উপর দাঁড়িয়ে।সংস্কৃতে হাতির একটি নাম করী, সেই অনুসারে অসুরটির নাম করীন্দ্রাসুর। এই করীন্দ্রাসুরকে বধ করেন বলে জগদ্ধাত্রীর অপর নাম করীন্দ্রাসুরনিসূদিনী।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

জগদ্ধাত্রী সত্ত্বগুণের প্রতীক, তাই উদিত সূর্যের মতো তাঁর গায়ের রং কমলা। কিন্তু, দুর্গার সঙ্গে তাঁর সংযোগ স্থাপন করতে গিয়ে বর্তমানে তাঁর মূর্তিটির রঙ করা হয় কাঁচা সোনার রঙে। কমলা রঙের জগদ্ধাত্রী প্রতিমা এখন এই বাংলায় প্রায় দেখাই যায় না।জগদ্ধাত্রী পূজার নিয়মটি একটু আলাদা। দুটি পদ্ধতিতে এই পূজা হয়ে থাকে। কোথাও সপ্তমী থেকে নবমী অবধি দুর্গাপূজার ধাঁচে জগদ্ধাত্রী পূজা হয়ে থাকে আবার কোথাও নবমীর দিনই তিন বার পূজার আয়োজন করে সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী পূজা সম্পন্ন করা হয়ে থাকে।

পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী  ও নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী  উৎসব জগদ্বিখ্যাত। এছাড়াও জয়রামবাটীর  জগদ্ধাত্রী পূজা, গুপ্তিপাড়ার জগদ্ধাত্রী , ধাত্রীগ্রামের জগদ্ধাত্রীও ঐতিহ্যে এবং জৌলুষে কোন অংশে কম নয়।

2 comments

আপনার মতামত জানান