আমাদের পশ্চিমবঙ্গ মূলত ২৩টি জেলাতে বিভক্ত। বেশীরভাগ জেলাই স্বাধীনতার আগে থেকে ছিল, কিছু জেলা স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে গঠিত, আবার কিছু জেলা একটি মূল জেলাকে দুভাগে ভাগ করে তৈরি হয়েছে মূলত প্রশাসনিক সুবিধের কারণে। প্রতিটি জেলাই একে অন্যের থেকে যেমন ভূমিরূপে আলাদা, তেমনি ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক দিক থেকেও স্বতন্ত্র। প্রতিটি জেলার এই নিজস্বতাই আজ আমাদের বাংলাকে সমৃদ্ধ করেছে। সেরকমই একটি জেলা হল কোচবিহার (Cooch Behar)।
ভারতবর্ষের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের একটি অন্যতম জেলা হল কোচবিহার। কোচবিহার বলতেই ইতিহাস সমৃদ্ধ একটি জেলার কথা মনে পড়ে যে জেলার প্রাণ কেন্দ্রে রয়েছে কোচবিহার রাজবাড়ি, মদন মোহনের মন্দির, গোঁসাইমারি রাজপাটের খননকাজ। কোচবিহার কেবল ইতিহাসের কথাই বলে না, দিনহাটার শীতলপাটি, বাবুর হাটের জিলিপি নিয়ে কোচবিহার আপন মহিমায় মহিমান্বিত।
ভৌগলিক দিক থেকে দেখলে এই জেলার উত্তরে রয়েছে আলিপুরদুয়ার জেলা, দক্ষিণে অবস্থান করছে বাংলাদেশের রংপুর বিভাগ, পূর্বে রয়েছে আসামের ধুবড়ী জেলা এবং পশ্চিমে জলপাইগুড়ি জেলা অবস্থান করছে৷ কোচবিহারের ভূমিরূপ উত্তরবঙ্গ সমভূমির অন্তর্গত৷ পাহাড় বা পর্বত না থাকলেও এই জেলায় বিশালাকার ঝিলের আধিক্য দেখতে পাওয়া যায়। তিস্তা, জলঢাকা, তোর্ষা,কালজানি, রায়ডাক, দুধকুমার, গদাধর, ধরলা প্রভৃতি এখানকার উল্লেখযোগ্য নদী ।
৩৩৮৩ বর্গ কিমি বিস্তৃত কোচবিহার আয়তনের বিচারে সমগ্র রাজ্যে দ্বাদশতম স্থান অধিকার করেছে। ২০১১ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী জনসংখ্যার বিচারে কোচবিহার সমগ্র রাজ্যে সতেরোতম জনবহুল জেলা যার জনসংখ্যা প্রায় ২৮২২৭৮০৷
আজকের কোচবিহার জেলা একসময় প্রাচীন বৃহত্তর কামরূপ রাজ্যের অন্তর্গত ছিল। ১৯৫০ সালে কোচবিহার পশ্চিমবঙ্গের একটি জেলায় পরিণত হয়৷ কামরূপের রাজধানী ভাগ হলে কোচবিহার ‘কামতা’-র অন্তর্গত হয়। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাঞ্চলের জলপাইগুড়ি বিভাগের একটি জেলা। সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে রচিত “শাহজাহাননামা” গ্রন্থে কোচবিহার নামটির উল্লেখ পাওয়া যায়। কোচবিহার শব্দটির অর্থ ‘কোচ জাতির বাসস্থান’। কোচবিহার নামকরণ বিষয়ে বিশদে জানতে পড়ুন ।
অষ্টাদশ শতাব্দীতে মেজর রেনেলের মানচিত্রে কোচবিহার ‘বিহার’ নামে উল্লিখিত হয়েছে৷ ১৭৭২ সালে কোচবিহারের রাজা ধৈর্যেন্দ্র নারায়ণ ও ওয়ারেন হেস্টিংসের মধ্যে সাক্ষরিত চুক্তি অনুসারে কোচবিহার ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে একটি করদ রাজ্যে পরিণত হয়। আবার ১৭৭৩ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে রাজা ধৈর্যেন্দ্র নারায়ণের যে চুক্তি হয় তার ফলস্বরূপ এই করদ রাজ্যটি ‘কোচ বিহার’ নামে পরিচিত হয় এবং এই রাজ্যের রাজধানীর নাম হয় “বিহার ফোর্ট”৷ ১৯৪৯ সালের ২৮ আগস্ট রাজা জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণ কোচবিহার রাজ্যকে ভারত সরকারকে হস্তান্তরিত করলে ১২ সেপ্টেম্বর থেকে কোচবিহার ভারতের কমিশনার শাসিত প্রদেশে পরিণত হয় এবং ১৯৫০ সালের ১ জানুয়ারি ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের ২৯০ক ধারা বলে কোচবিহার পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের একটি জেলায় পরিণত হয়।
প্রশাসনিক দিক থেকে কোচবিহার জেলাকে মোট পাঁচটি মহকুমা ও বারোটি সমষ্টি উন্নয়ন ব্লকে বিভক্ত করা হয়েছে এই জেলায় মোট ৬টি পুরসভা রয়েছে৷
কোচবিহারের উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থানের মধ্যে কোচবিহার রাজবাড়ি (ভিক্টর জুবিলি প্যালেস) যা ১৮৮৭ সালে মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণের রাজত্বকালে লন্ডনের বাকিংহাম প্রাসাদের আদলে তৈরি হয়েছিল। মহারাজা হীরেন্দ্র নারায়ণের আমলে তৈরী সাগর দীঘি এখানকার অন্যতম আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র ৷ এছাড়া বাণেশ্বরের শিব মন্দির ও মন্দির সংলগ্ন শিব পুকুরে থাকা মোহন নামক কচ্ছপ, মদন মোহনের মন্দির ও সেখানে অনুষ্ঠিত রাস মেলা, গোঁসাইমারি রাজপাটের খননকাজও বিখ্যাত।
কোচবিহারে তিস্তাবুড়ির ব্রতপূজা উপলক্ষে যে নাচগান অনুষ্ঠিত হয় তা মেছেনি খেল বা মেছেনি নাচ নামে পরিচিত। কোচবিহারের জনপ্রিয় লোকসংঙ্গীত হল ভাওয়াইয়া। এই জেলার দিনহাটার শীতলপাটি ও বাবুর হাটের জিলিপি বিখ্যাত।
নিউ কোচবিহার এই জেলার প্রধান রেলস্টেশন এবং কোচবিহার বিমানবন্দর এই জেলার একমাত্র বিমানবন্দর।
5 comments