আলিপুরদুয়ার

আলিপুরদুয়ার জেলা

আমাদের পশ্চিমবঙ্গ মূলত ২৩টি জেলাতে বিভক্ত। বেশীরভাগ জেলাই স্বাধীনতার আগে থেকে ছিল, কিছু জেলা স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে গঠিত, আবার কিছু জেলা একটি মূল জেলাকে দুভাগে ভাগ করে তৈরি হয়েছে মূলত প্রশাসনিক সুবিধের কারণে। প্রতিটি জেলাই একে অন্যের থেকে যেমন ভূমিরূপে আলাদা, তেমনি ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক দিক থেকেও স্বতন্ত্র। প্রতিটি জেলার এই নিজস্বতাই আজ আমাদের বাংলাকে সমৃদ্ধ করেছে।সেরকমই একটি জেলা হল আলিপুরদুয়ার।

২০১৪ সালের ২৫ জুন তারিখে গঠিত ভারতের তথা পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের জলপাইগুড়ি বিভাগের পাঁচটি জেলার মধ্যে অন্যতম আলিপুরদুয়ার।আলিপুরদুয়ার নাম হল কিভাবে সেই প্রসঙ্গটিও বেশ চমকপ্রদ।দুয়ার শব্দের অর্থ দরজা, আলিপুরদুয়ার থেকে ভুটানে প্রবেশ করা যায়, এই ভাবেই নামটি অর্থবহ হয়ে উঠেছে।

ভৌগলিক দিক থেকে দেখলে হিমালয়ের পাদদেশে জেলাটি অবস্থান করছে৷ আলিপুরদুয়ারের উত্তরে রয়েছে ভুটানের সীমারেখা,দক্ষিণে রয়েছে কুচবিহার,পূর্ব দিকে অবস্থান করছে আসাম এবং পশ্চিমে আছে জলপাইগুড়ির  সীমারেখা। তোর্সার উপনদী কালজানি নদী বয়ে গেছে আলিপুরদুয়ারের পূর্ব দিক থেকে।চারিপাশে পাহাড় নদী ও চা বাগানে ঘেরা জেলাটিতে বহমান নদীগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, তোর্সা, রায়ডাক, সঙ্কোশ এবং গদাধর৷

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

পশ্চিমবঙ্গে  দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার, কোচবিহার, উত্তর দিনাজপুর, দক্ষিণ দিনাজপুর ও মালদহ — গঙ্গার উত্তরে অবস্থিত এই জেলাগুলি একসঙ্গে উত্তরবঙ্গ নামে পরিচিত। এর মধ্যে আলিপুরদুয়ারের আয়তন ৩৩৮৩ বর্গ কিমি। আয়তন অনুসারে পশ্চিমবঙ্গে এর স্থান ত্রয়োদশ।   পৌরসভা ছাড়াও ছয়টি ব্লকের অধীনে নয়টি সেন্সাস টাউন ও ৬৬টি গ্রামপঞ্চায়েত নিয়ে জেলাটি গঠিত৷২০১১ সালের ভারতের জনগণনা অনুসারে প্রায় ১৭,০০,০০০ জন এখানে বসবাস করেন সেই হিসেবে জনঘনত্ব হল ৪০০ বর্গকিমি। জনসংখ্যার বিচারে আলিপুরদুয়ার পশ্চিমবঙ্গে বিংশ তম স্থান অধিকার করেছে৷

এখানে বাংলা(৫৭.৫১%) ভাষাভাষী মানুষই বেশী, তবে হিন্দি (৫.৩৭%) নেপালী (৯.৭৮%) ও সাদরি ( ১৭.০৩%) ভাষার চলও রয়েছে এছাড়া দপ্তরের কাজকর্মের জন্য ইংরাজি ভাষা ব্যবহৃত হয় ৷এই জেলার ব্লকগুলি হল মাদারিহাট-বীরপাড়া, আলিপুরদুয়ার-১, আলিপুরদুয়ার-২, ফালাকাটা, কালচিনি ও কুমারগ্রাম।

আলিপুরদুয়ারের কথা আলোচনা করলে যেই নামটা মনে চলে আসে সেটা হল বক্সা পাহাড়৷ এই বক্সা পাহাড় অঞ্চলে বক্সা জাতীয় উদ্যান অবস্থিত। এই উদ্যানের আয়তন হল ৭৬০ বর্গ কিলোমিটার। এখানে একটি ব্যাঘ্র সংরক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে। এই উদ্যানে বাঘ, সিভেট ও রেড জঙ্গল ফাউল দেখা যায়।সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল উদ্যানের মধ্যে অবস্থিত বক্সা দুর্গ। এটি অধুনা-পরিত্যক্ত দুর্গ, ভারত ও তিব্বতের মধ্যে যে রেশম বাণিজ্য পথটি ভুটানের মধ্যে দিয়ে যেত,সেটির একাংশ রক্ষার জন্য ভুটান রাজারা এই দুর্গটি ব্যবহার করতেন।আবার ১৯৫০ সালে চীন তিব্বত দখল করে নিলে,বহু শরণার্থী এই অঞ্চলে উপস্থিত হলে এই পরিত্যক্ত দুর্গটি শরণার্থী আশ্রয় শিবির হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল। বলা হয় ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকে এই দুর্গে কিছুদিন বন্দী করে রাখা হয়েছিল।

১৪১ বর্গকিলোমিটার আয়তন নিয়ে পূর্ব হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত জলদাপাড়া জাতীয় উদ্যান৷এই উদ্যানটিকে বলা যেতে পারে তোর্সা নদীর তীরে অবস্থিত একটি নদী কেন্দ্রিক বনাঞ্চলময় সুবিস্তীর্ণ তৃণভূমি। এখানকার জীবজন্তুর মধ্যে অবলুপ্তপ্রায় একশৃঙ্গ গণ্ডার বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এছাড়া এখানকার মূল আকর্ষণ হল পর্যটকদের জন্য এলিফ্যান্ট সাফারির মাধ্যমে জীবজন্তু পরিদর্শন।

জলদাপাড়ায় অবস্থিত টোটো পাড়া একটি নৃতাত্ত্বিক পর্যটনস্থল। এটি বিশ্বে টোটো উপজাতির একমাত্র আবাসস্থল।

জলদাপাড়া জাতীয় উদ্যান ও বক্সা জাতীয় উদ্যানের মাঝে হাতি করিডোর চিলাপাতা বনাঞ্চল একটি গভীর বনাঞ্চল। এই বনে বিভিন্ন প্রজাতির জীবজন্তু দেখা যায় যার মধ্যে চিতাবাঘ উল্লেখযোগ্য।

এই জেলায় পর্যটন শিল্প ক্রমে বিকাশ লাভ করেছে৷ পশ্চিমবঙ্গ বন উন্নয়ন পর্ষদ চিলাপাতার কোদালবস্তিতে একটি পরিবেশ-পর্যটন রিসর্ট স্থাপন করেছে। এখানকার প্রধান পর্যটন আকর্ষণ হল নলরাজার গড়, বলা হয় এটি খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতাব্দীতে গুপ্ত যুগে নির্মিত।এটি আসলে স্থানীয় নল রাজাদের দুর্গ।

আলিপুরদুয়ারের উল্লেখযোগ্য লোকাচারকেন্দ্রিক নৃত্যগীত হল মেছেনি খেল বা মেছেনি নাচ। এই নাচগান উত্তরবঙ্গের রাজবংশী সম্প্রদায়ের গ্রামীন মহিলাদের দ্বারা তিস্তাবুড়ির ব্রতপূজা উপলক্ষে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।

4 comments

আপনার মতামত জানান